১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমি প্রথমবার বেলুড় মঠে আসি। সেই সময়ই আমি শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দর্শন করার সুযোগ লাভ করেছিলাম। সেটি ছিল স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর প্রথম জন্মতিথিপূজার দিন।

বেলুড় মঠ থেকে আমাকে কলকাতায় শ্রীশ্রীমা যেখানে থাকতেন সেখানে নিয়ে আসা হয়। সেই প্রথম তাঁকে সশরীরে দর্শন করলাম। আমাদের একজন নেতৃস্থানীয় সঙ্গী, পরবর্তিকালে স্বামী শুভানন্দ, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সেখানে পৌঁছাতেই একজন ভক্ত আমাদের ওপরতলায় যেতে বললেন, শ্রীশ্রীমাই তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। ওপরে উঠে দেখলাম, তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমরা সাষ্টাঙ্গ হয়ে তাঁর চরণস্পর্শ করে প্রণাম করলাম। তিনি আশীর্বাদ করে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন প্রশান্তির প্রতিমূর্তি। সেই দর্শনকালে আমাদের জগতের মা—সকলের মার একটু আভাস অনুভব করলাম। একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে দেখা হলে যেমন অন্তরঙ্গ, সরল, স্নেহপূর্ণ স্বরে কথা বলেন, তিনিও ঠিক সেইভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এটি ব্যাখ্যা করা আমার সাধ্যাতীত। শ্রীশ্রীমা সম্পর্কে সেই প্রথম সামান্য কিছু ধারণা হলো। তিনি আমাদের কয়েকটি সন্দেশ খেতে দিলেন এবং একটু অপেক্ষা করে মন্দিরে পূজা শেষ হলে প্রসাদ পেয়ে যেতে বললেন। কিছুক্ষণ বসার পর আমরা আবার মায়ের পাদস্পর্শ করে সাষ্টাঙ্গ প্রণামান্তে নেমে এলাম।

নিচে একটি ঘরে স্বামী সারদানন্দজী বসেছিলেন। তিনি শ্রীশ্রীমার সুখসুবিধার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। কেউ শ্রীশ্রীমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে মহারাজ একজন ব্রহ্মচারীকে আগে পাঠিয়ে তাঁর সম্মতি আছে কি না জেনে নিতেন। তাঁর সম্মতি ছাড়া মহারাজ কাউকে যেতে দিতেন না। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যিনি দলনেতা ছিলেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : “তোমরা ওপরে গেলে কিভাবে?” তাঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, আমাদের তিরস্কার করার জন্য যেন প্রস্তুত হচ্ছেন। আমরা বললাম, শ্রীশ্রীমা নিজেই আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এতে আমাদের কোনো দোষ নেই। আমরা মায়ের ইচ্ছাতেই তাঁর কাছে গিয়েছিলাম জেনে তিনি খুব সন্তুষ্ট হলেন। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে আমরা বেলুড় মঠে ফিরে এলাম।

১৯১২ সালে কালীপূজার সময় শ্রীশ্রীমা কাশীতে ছিলেন। পূজনীয় স্বামী ব্রহ্মানন্দজী, স্বামী শিবানন্দজী এবং স্বামী তুরীয়ানন্দজীও সেই সময় কাশীতে রয়েছেন। মা অদ্বৈত আশ্রমের কাছেই এক ভক্তের নতুন তৈরি বাড়িতে থাকতেন। প্রথম দিন তাঁকে স্টেশনে দর্শন করি এবং তারপর একদিন তিনি যেখানে ছিলেন সেখানে তাঁকে দর্শন করতে যাই। আমি যখন তাঁকে সাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণাম করছিলাম, সেই সময় মনে মনে ভাবছিলাম—মা যদি একবার আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন তাহলে আমার অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমার এই মনোগত ইচ্ছা পূর্ণ করেন—মুহূর্তের মধ্যেই তিনি আমার মাথায় করস্পর্শ করে আশীর্বাদ করেন। কেউই সেটি দেখতে পাননি। এতে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যাই।

ঐ সময়েই বোধহয় স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর সঙ্গে আলোচনার পর তিনি তাঁর সঙ্গে আসা কয়েকজন আত্মীয়ার সাথে আমাকে এলাহাবাদ, মথুরা, বৃন্দাবন দর্শন করতে পাঠান। সেই দলে কোয়ালপাড়া আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী কেশবানন্দও ছিলেন। ওঁদের নিয়ে ঐসব স্থান দর্শন করে ফিরে এলে শ্রীশ্রীমা খুব খুশি হন। একদিন সংঘের বরিষ্ঠ সন্ন্যাসী স্বামী শান্তানন্দের মাধ্যমে আমাকে তাঁর ঘরে বসে প্রসাদগ্রহণের জন্য বলে পাঠান। মনে একটু সংকোচ থাকলেও তাঁর আদেশ অমান্য করার সাধ্য আমার ছিল না। আমাকে একাই যেতে হলো। অন্য সকলকে যেরকম প্রসাদ দিতেন, তিনি আমাকেও সেইভাবে প্রসাদ দিয়ে তাঁর ঘরে বসেই খেতে বললেন। জগ থেকে জল ঢেলে দিলেন। আমি তখন যেন সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছি, কী বলেছি তাও আমার মনে নেই। তবে জল ঢালতে ঢালতে তিনি বললেন : “বাবা, তোমরা ঠাকুরের সন্তান, এইটিই তোমাদের শেষ জন্ম।”

অদ্বৈত আশ্রম ওখান থেকে খুব কাছেই, পূজনীয় স্বামী তুরীয়ানন্দজী তখন ওখানেই অবস্থান করছিলেন। তিনি আমাকে খুব ভালবাসতেন। তাঁর কাছে আমি নিঃসংকোচে যেকোনো প্রশ্ন করতে পারতাম। আমি তাঁকে গিয়ে বললাম : “মা এই কথা বলেছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি এর মানে কী। আমার তো ঈশ্বরলাভ করার বাসনা আছে, আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে জানতে ও উপলব্ধি করতে চাই। আমার তাহলে এখনো বাসনা অবশিষ্ট আছে।” তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বললেন : “আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি যে, তুমি মুক্ত।” ১৯০২ সালে আমি যখন প্রথম কাশীতে আসি তখনি তিনি আমাকে এই কথা বলেছিলেন। সেবাশ্রমের অধ্যক্ষ মহারাজকেও তিনি এই একই কথা বলেছিলেন। আমরা দুজনেই তখন সেখানে ছিলাম। সেই-ই আমার তাঁকে প্রথম দর্শন। বহুদিন পরে সেই মহাত্মাই আবার সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে (আমরা সাধারণত ভুলে যাই, সেটাই আমাদের স্বভাব) উচ্চৈঃস্বরে বললেন : “আমি তোমাদের বলিনি, তোমরা যারা স্বামীজীর সন্তান তারা সবাই মুক্ত হয়েই আছ? মাও এখন একই কথা বললেন। তিনিই হচ্ছেন এই কথা বলার সর্বোচ্চ অধিকারিণী।” তিনি আরো বললেন : “মা হচ্ছেন মূর্তিমতী ভালবাসা।”

শ্রীশ্রীমা সম্পর্কে যতটুকু আমরা জানি তা খুবই সামান্য। তিনি হলেন মহাশক্তি। তিনি এখনো আমাদের সঙ্গে আছেন। স্বামীজী বলতেন, সমস্ত শক্তির সম্মিলিত রূপই হচ্ছেন ঈশ্বর। তিনি এবং শক্তি অভেদ। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড হলো এই শক্তির প্রকাশ। আমাদের যেসব মুনি-ঋষি এটি উপলব্ধি করেছেন, তাঁরা এই কথাই বলেছেন। বাইরে থেকে দেখে তাঁকে খুব সাধারণ বলে মনে হয়। কিন্তু তাঁর ভিতরে র‍য়েছে এক প্রবল তেজোরাশি, একাধারে জ্ঞান এবং ভক্তির সমাহার। আমাদের পক্ষে এর সঠিক বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। শ্রীশ্রীমার অসীম ভালবাসার স্পর্শলাভ করে যেটুকু জেনেছি কেবল তাই বলছি। শুধু দিব্যাত্মারাই তাঁকে কিছুটা বুঝতে পারেন।

আমাদের যদি ঠাকুর ও মায়ের প্রতি বিশ্বাস থাকে তাহলে আমাদের জীবন হয়ে উঠবে শান্তিময়। আমরা অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের সঙ্গেও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব। আমাদের সকল সংকীর্ণতা দূর হয়ে যাবে, আমরা সকলকেই মানিয়ে নিয়ে চলতে পারব। সংকীর্ণতার কারণে আমরা নিজেরাও মাঝে-মাঝে বিভ্রান্ত হই এবং অন্যদেরও বিভ্রান্ত করি, এটি খুবই খারাপ।

আমাদের অবশ্যই সকল ধর্মের মতবাদ ও বিশ্বাসের প্রতি গ্রহিষ্ণুতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের নিন্দা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় তা আমাদের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে। আমরা যারা ঠাকুর ও মায়ের অনুগামী, আমাদের অন্তত যতটা সম্ভব তাঁদের পথ অনুসরণ করে চলতে হবে। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী গির্জায় গিয়ে বেদির সামনে নতজানু হয়ে মাতা মেরি ও যিশুখ্রিস্টের কাছে সেভাবেই প্রার্থনা করতেন—ঠিক যেমনভাবে তিনি মা ও ঠাকুরের সামনে করতেন।

আমরা যদি ঠাকুর ও মায়ের অনুগামী হতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই সকল মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, কিন্তু আমাদের নিজস্ব যে-ধারা সেটিকে অবিচলভাবে অনুসরণ করতে হবে।

স্বামী সদাশিবানন্দ স্বামীজীর সংস্পর্শে এসেছিলেন কাশীতে, ১৯০২ সালে। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত কাশীতে তিনি দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেন। তাঁর এই স্মৃতিকথাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বেদান্ত কেশরী’ পত্রিকায় ১৯৫৪ সালে। এটি বাংলায় রূপান্তরিত করেছেন দেবাশিস মৈত্র।