।। ৫।।

শ্রীশ্রীমা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, অন্তত শেষ সময় অর্থাৎ দেহ যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে ঠাকুর তাঁর ভক্তদের দেখা দেবেন এবং হাত ধরে নিয়ে যাবেন—“ঠাকুর বলতেন, ‘যারা আমাকে ডাকবে তাদের জন্য আমাকে অন্তিমে দাঁড়াতে হবে।’ এটি তাঁর নিজের মুখের কথা।” “তাঁর মুখের কথা কি ব্যর্থ হতে পারে?”৯৩ এখানে যে-ভক্তদের কথা বলা হচ্ছে, ধরে নেওয়া যায় তাঁদের মন–প্রাণ শ্রীরামকৃষ্ণে সমর্পিত, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁদের জীবনসর্বস্ব। এই অবস্থা লাভ রামকৃষ্ণ–চেতনা চর্চার স্বাভাবিক পরিণতি।

ভক্তদের দেহান্তের পরবর্তী অবস্থা সম্বন্ধে ঠাকুর বা মায়ের মুখে বারবার যা শুনি এবং যা পূর্ব অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো—ঠাকুর হাত ধরে তাঁদের নিয়ে যাবেন। এখন প্রশ্ন হলো, ঠাকুর বাস্তবিক যে দেহান্তে প্রকৃত ভক্তদের সামনে এসে দঁাড়ান এবং হাত ধরে নিয়ে যান—এর উদাহরণ প্রচুর। এখানে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করছি।

মহাপুরুষ মহারাজ বলরাম বসুর প্রয়াণ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন : “দেহত্যাগের দু–তিনদিন আগে থেকে (বলরামবাবু) আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে কাছে আসতে দিতেন না; আমাদেরই কেবল দেখতে চাইতেন। যতটুকু কথাবার্তা বলতেন, তা খালি ঠাকুর সম্বন্ধে।… বলরামবাবুর স্ত্রী শোকে মুহ্যমান হয়ে গোলাপ–মা, যোগীন–মা প্রভৃতির সঙ্গে অন্দর মহলে বসে আছেন। এমন সময় বলরামবাবুর স্ত্রী আকাশের গায়ে একখণ্ড কালো মেঘের মতো দেখতে পেলেন। পরে ঐ মেঘ ঘনীভূত হয়ে ক্রমে নীচে নেমে আসতে লাগল এবং একটি রথের আকার ধারণ করে বলরাম-মন্দিরের ছাদের উপর নামল। ঐ রথের ভিতর হতে ঠাকুর নেমে এসে বলরামবাবু যে ঘরে ছিলেন, সেই দিকে গেলেন এবং খানিক পরেই বলরামবাবুর হাত ধরে রথে এসে বসলেন। তখন সেই রথ ঊর্ধ্বে উঠে শূন্যে বিলীন হয়ে গেল। এই vision (অলৌকিক দৃশ্য) দেখতে দেখতে বলরামবাবুর স্ত্রীর মন এমন এক উচ্চ অবস্থায় চলে গিয়েছিল, যেখানে শোকতাপ স্পর্শ করতে পারে না। যখন তাঁর চমক ভাঙল, তখন তিনি ঐ দর্শনের কথা গোলাপ–মাকে বললেন। গোলাপ–মা এসে আমাদের ঘটনাটি জানালেন। তার কিছুক্ষণ আগেই বলরামবাবুর দেহত্যাগ হয়েছিল।”৯৪

আরেকজন বিশিষ্ট ভক্ত কালীপদ ঘোষ বা ‘দানাকালী’ ঠাকুরের কাছে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন যে, তিনি অন্তিম সময়ে যখন চারিদিক আঁধার দেখবেন এবং তাঁর স্ত্রী–পুত্রাদি পরিজন কেউ তাঁর সঙ্গে থাকবেন না, সেই ভীতিজনক ও অসহায় অবস্থায় একমাত্র রক্ষাকর্তা ঠাকুর যেন একহাতে আলো অন্যহাতে তাঁর হাত ধরে তাঁর কাছে নিয়ে যান। কালীপদ ঘোষের দেহত্যাগের যে-বর্ণনা আছে তা পাঠ করে নিঃসন্দেহে বলা যায়, করুণাবতার ও সত্যমূর্তি ঠাকুর তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন।৯৫ প্রতাপচন্দ্র হাজরা ও দক্ষিণেশ্বরের রসিক মেথরকেও ঠাকুর আশ্বাস দিয়েছিলেন তাঁরা শেষসময়ে তাঁর দর্শন পাবেন। তাঁদের মৃত্যুকালীন বর্ণনায় শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনদানের কথা জানা যায়।৯৬

স্বামী সুবোধানন্দজী কুসুম নামে রাঁচির একটি মেয়েকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সে ভক্তিমতী ও সেবাপরায়ণা ছিল। অকস্মাৎ কোনো এক অসুখে তার মৃত্যু হয়। স্বামী সুবোধানন্দজী বলেছেন : “…কাশীতে যাই। সেখানে আমার বড্ড অসুখ হয়। আমাশয়, হাত পায় বেদনা। বেদনার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়ে আছি, তখন কু…এর (কুসুমের) কথা মনে পড়লো—সে তো আমার একটু অসুখ হলেই ছুটে আসতো, কত সেবা করতো। এই ভাবতে ভাবতে বলে ফেললুম, ‘কু…! এখন তুমি কোথায়? এই যে এত ভুগছি, কে দেখে?’ এই বলে একটু তন্দ্রার মতো এসেছে, দেখছি একটি আট নয় বছরের মেয়ে এসে হাজির। ‘তুমি কে?’ জিজ্ঞাসা করায় বললে—‘আমি কু…।’ ‘কেন এসেছ?’ জিজ্ঞাসা করায় বললে, ‘আপনি ডেকেছেন তাই এসেছি।’ ‘কোথায় ছিলে, কি করছিলে’ জিজ্ঞাসা করায় বললে—‘কেন, শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবা করতে বলেছেন, তাঁরই সেবা করছিলাম এবং তাঁর কাছেই ছিলাম।’ আমায় হাওয়া করতে বললুম—কু… হাওয়া করতে লাগলো, (এমনি করে হাত নেড়েচেড়ে)। বেশ হাওয়া লাগতে লাগলো কিন্তু। তখন আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি যখন মারা যাও তখন কি হয়েছিল বল দিকিন? কে তোমায় হাত ধরে নিয়ে এসেছিলো?’ এ কথার উত্তরে—কু… কোন্‌ জন্মের কথা জিজ্ঞেস করছি তাই প্রশ্ন করতে লাগলো, আর বলতে লাগলো—‘এক ঘুমেতে একদিনের কথাই মনে থাকে না, এ তো কত জন্ম হয়ে গেছে—কোন্‌ জন্মের কথা জিজ্ঞেস করছেন?’ তখন রাঁচির কথা বিশেষ করে বলাতে সে উত্তর করল—‘আমার যে রাত্রিতে মৃত্যু হয়, সে রাত্রিতে যন্ত্রণা এত বেশি হয় যে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলুম না, তবুও আপনাকে ভুলিনি। আপনাকে মনে করছি এমন সময় যেন আপনি এসে হাত ধরে বললেন—“চলে এসো।” আমিও অমনি চলে এলুম।’ অনেক দূর এসে আপনি খোকা মহারাজ জ্ঞানে আপনার সঙ্গে কথা কইছি, তখন যিনি আমার হাত ধরে এনেছেন, তিনি বললেন—‘আমি খোকা মহারাজ নই।’ ‘তবে কে?’ পুনরায় জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলিলেন, ‘খোকা মহারাজ তোমায় যাঁকে পুজো করতে বলেছেন, আমি সেই।’ ‘তবে আপনাকে খোকা মহারাজের মতো দেখায় কেন?’ পুনঃ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘নইলে আমায় চিনতে পারবে কেন? তাই খোকার রূপ ধরে তোমায় টেনে এনেছি।’ তখন পুনরায় জিজ্ঞেস করলুম—‘যদি তাই হয়ে থাকে তবে কৃপা করে আপনার স্বরূপ একবার দেখান।’ তখন শ্রীশ্রীঠাকুর খোকা মহারাজের চেহারা ছেড়ে নিজ মূর্তি ধারণ করলেন। সে রূপে কি জ্যোতি, কি স্নিগ্ধ শান্তিময় সে রূপ—তা কি আর কথায় বলা যায়? এখনও সেই ঠাকুরের কাছেই ছিলুম—আপনি বারবার ডাকছেন, তাই বলে এলুম যে তিনি ডাকছেন, একটু শুনে আসি। তখন কু…কে বললুম, ‘আচ্ছা বেশ—তবে যাও যেখানে ছিলে।’ অমনি সে মেয়েটি চলে গেল।”৯৭

রামকৃষ্ণলোক

এর পরের প্রশ্ন হলো—শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তদের শেষ সময়ে দেখা দিয়ে তাদের কোথায় নিয়ে যান? এপ্রসঙ্গে ‘রামকৃষ্ণলোক’-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যদিও এসম্বন্ধে ঠাকুর কিছু বলেননি। স্বামীজী বা ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ত্যাগী ও গৃহিভক্তদের কাছ থেকেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রামকৃষ্ণলোকের কথা বিশেষ শোনা যায় না। কিন্তু শ্রীশ্রীমা স্বয়ং রামকৃষ্ণলোকের কথা বলেছেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে মা এক ভক্তকে বলছেন : “তোমরা অত ভাবনা কর কেন?… পরে রামকৃষ্ণলোকে গিয়ে চিরশান্তি ভোগ করবে। ঠাকুর তোমাদের জন্য নতুন রাজ্য তৈরি করেছেন।”৯৮ শ্রীরামকৃষ্ণে মনপ্রাণ সমর্পিত প্রকৃত ভক্তদের জন্য এ এক পরম আশ্বাসবাণী। এক সেবককে মা বলেছেন : “শ্রীরামকৃষ্ণ-লোকের বিশ্রামই হলো ধ্যান।… সেবার পরিশ্রমের মূল্য সেখানে বুঝতে পারবে।”৯৯ অন্য একটি প্রসঙ্গে তিনি রামকৃষ্ণলোকের কথা পরোক্ষে বলেছেন : “দুটি থাক আছে। একটি এখানকার মতো ভগবানের সেবাদি নিয়ে থাকে। অপরটি ঐ রকম পুতুলের মতো যুগ যুগান্তর ধরে ধ্যানমগ্ন।”১০০

একবার বলরামবাবুর বাড়ির ছাদে বসে ধ্যান করতে করতে মা সমাধিস্থা হন। পরে বাহ্যসংজ্ঞা ফিরে এলে তিনি বলেন : “দেখলুম, কোথায় চলে গেছি। সেখানে সকলে আমায় কত আদরযত্ন করছে। আমার যেন খুব সুন্দর রূপ হয়েছে। ঠাকুর রয়েছেন সেখানে। তাঁর পাশে আমায় আদর করে বসালো—সে যে কি আনন্দ বলতে পারিনে! একটু হুঁশ হতে দেখি যে, শরীরটা পড়ে রয়েছে। তখন ভাবছি, কি করে এই বিশ্রী শরীরটার ভিতর ঢুকব? ওটাতে আবার ঢুকতে মোটেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। অনেক পরে তবে ওটাতে ঢুকতে পারলুম ও দেহে হুঁশ এল।”১০১

এছাড়া মহাপুরুষ মহারাজও বলেছিলেন : দেহ ছেড়ে গেলে “আমরা রামকৃষ্ণলোকে চলে যাব। ঠাকুর থাকবেন, আমরাও সেখানে থাকব।”১০২ স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর মহাসমাধির পর তিনি আবার এও বলেছিলেন : “মহারাজ এখন ঠাকুরের কাছে আছেন। আমরাও দেহত্যাগ করে ঠাকুরের কাছে যাব—রামকৃষ্ণলোকে বাস করব। মহারাজের সঙ্গে এখানে যেমন ছিলাম, ওখানে গিয়েও তেমনি থাকব।”১০৩

জনৈক ভক্তের উদ্দেশে স্বামী অভেদানন্দজীর মন্তব্য এখানে স্মরণযোগ্য—“পার্থিব বস্তুর প্রতি যদি তোমার প্রবল আকর্ষণ থাকে, তাহলে তোমার spirit earth-bound হয়ে থাকবে, আর যদি তোমার শ্রীরামকৃষ্ণের পাদপদ্মে অনুরাগ হয়, তাহলে তোমার রামকৃষ্ণলোকে গতি হবে এবং মৃত্যুর সময় তোমাকে সেখানে যেতে সাহায্য করবার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ পার্ষদরা আসবেন।… ‘যান্তি দেবব্রতা দেবান্‌ পিতৃন যান্তি পিতৃব্রতাঃ।/ ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা’।। (গীতা, ৯।২৫)”১০৪

এবার দেখা যাক পরবর্তী প্রজন্মের বরেণ্য সন্ন্যাসীরা রামকৃষ্ণলোক সম্বন্ধে কী মন্তব্য করেছেন। স্বামী প্রেমেশানন্দ তাঁর বহু চিঠিতে রামকৃষ্ণলোকের প্রসঙ্গ এনেছেন। যেমন—“…জগৎ-জননীর প্রিয় সন্তান, ঋষি শান্তানন্দ মহারাজের উপস্থিতিতে তোমরা নন্দনকাননের আনন্দ সম্ভোগ করিতেছ। এইভাবে এই জীবনটা কাটাইয়া দিলে, পরজীবনে সকল স্বর্গের শ্রেষ্ঠ স্বর্গ, রামকৃষ্ণলোকে গিয়া, মায়ের সন্তান শত শত ঋষিমুনির সঙ্গে, অপরিসীম আনন্দে অনন্তকাল থাকিবে।”১০৫

পরবর্তী উদ্ধৃতিটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দশম সংঘগুরু এবং শ্রীশ্রীমায়ের দীক্ষিত সন্তান স্বামী বীরেশ্বরানন্দের একটি পত্র থেকে। প্রথমে স্বামী অতুলানন্দ ও পরে স্বামী মাধবানন্দের মহাপ্রয়াণের পর এই পত্রটি লেখা—“বার্লোগঞ্জে গুরুদাস মহারাজের সহিত দেখা করিবার বিশেষ ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছা অন্যরূপ। তাই এই ‘লোকে’ তাঁহার সহিত দেখা হইল না। তাঁহার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক। তবে রামকৃষ্ণলোকে আমাদের মিলন অবশ্যম্ভাবী। সেখানে কে আগে গেল, আর কে পরে গেল—তাহাতে কিছু আসে যায় না।” এরপর পূজনীয় মহারাজ একটু রহস্য করে লিখেছেন : “সময়ের জ্ঞান তো আপেক্ষিক, এই জগতের কয়েক বৎসর সেই জগতের তুলনায় কয়েক মিনিট মাত্র। নির্মল মহারাজ (স্বামী মাধবানন্দ) চলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তিনি main gate-এ পৌঁছিতে না পৌঁছিতে আমিও পরবর্তী বাসে G. T. Road-এ নামিয়া পড়িব।”১০৬

শ্রীশ্রীঠাকুর যখন তাঁর প্রকৃত ভক্তদের কৃপা করেন, তখন তাঁদের মুক্তিলাভ হয়। তবে এই মুক্তির প্রকারভেদ আছে—যেমন সালোক্য, সামীপ্য, সারূপ্য ও সাযুজ্য। ‘সালোক্য’ হলো শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে একই লোকে বাস করা; ‘সামীপ্য’ হলো তাঁর সমীপে বাস করা; ‘সারূপ্য’ হলো তাঁর সমরূপতা প্রাপ্তি এবং ‘সাযুজ্য’ হলো তাঁর সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়া। তবে সবই নির্ভর করবে ভক্তের মানসিক প্রবণতা, সাধনমার্গ, সিদ্ধিলাভের স্তর, সর্বোপরি শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপা ও ইচ্ছার ওপর।

তবে আমাদের মনে রাখা ভাল যে, বহুজনপ্রার্থিত বহুজনবাঞ্ছিত রামকৃষ্ণলোকে প্রবেশের ছাড়পত্র সহজে মেলে না। অন্তত ভাসা–ভাসা ধ্যান–জপ করে বা প্রায় না করে, ভোগবাসনা ও আসক্তি ত্যাগের কোনো প্রয়াস না করে এবং ঠাকুরের প্রতি অগভীর ভক্তি, ভালবাসা ও বিশ্বাসের দ্বারা তো নয়ই।

বেলুড় মঠ

দক্ষিণেশ্বর ও বেলুড় মঠের মহিমা প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীমা একবার বলেছিলেন : “যাঁর জন্য কাশী যাওয়া, তিনি দক্ষিণেশ্বরে ও বেলুড়ে (মঠে) আছেন।”১০৭ বেলুড় মঠ এযুগের ‘মহাতীর্থ’—মন্তব্য করেছিলেন স্বামী শিবানন্দজী। একসময় বেলুড় গ্রামের গঙ্গার ধারে ছিল নেপালের রাজার কাঠের গোলা। নেপাল-রাজার কলকাতার প্রতিনিধি বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, ঠাকুর যাঁকে ‘কাপ্তেন’ বলে ডাকতেন, একবার ঠাকুরকে এই কাঠগোলাতে এনেছিলেন। এর নিকটে পরবর্তী যুগে বেলুড় মঠ স্থাপিত হয়। এছাড়া দক্ষিণেশ্বরে ত্রিশ বছর (১৮৫৫—১৮৮৫) বাসকালে ঠাকুর বহুবার নৌকা করে কলকাতায় যাতায়াত করেছেন। অনুমান করা অসংগত হবে না যে, সেই সময় মঠের বর্তমান ভূমি বারংবার তাঁর ঐশীদৃষ্টির দ্বারা অভিসিঞ্চিত হয়েছিল। পরবর্তী যুগে যেখানে বেলুড় মঠ হয় সেই জমি সম্বন্ধে শ্রীশ্রীমা মন্তব্য করেছিলেন : “আমি কিন্তু বরাবরই দেখতুম, ঠাকুর যেন গঙ্গার ওপারে ঐ জায়গাটিতে—যেখানে এখন (বেলুড়) মঠ, কলাবাগান-টাগান—তার মধ্যে ঘর, সেখানে বাস করছেন।”১০৮ বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার পর শ্রীশ্রীমা আরো বলেছিলেন : “ঠাকুর আগে থেকেই এই স্থানটি পছন্দ করেছিলেন। গঙ্গার পশ্চিমকূল বারাণসী সমতুল। এখানে মঠ করে নরেন খুব ভাল কাজ করেছে।”১০৯
এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ ঠাকুরের ভস্মাস্থিপূর্ণ ‘আত্মারামের কৌটা’ স্বামীজী নিজে কাঁধে করে নিয়ে এসে বেলুড় মঠে নতুন কেনা জমিতে একটি আসনের ওপরে রেখে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করেন। মঠে আসার আগে তিনি শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেন : “ঠাকুর আমায় বলেছিলেন, ‘তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি, আমি সেখানেই যাব ও থাকব…।’ সেজন্যই আমি স্বয়ং তাঁকে কাঁধে করে নূতন মঠভূমিতে নিয়ে যাচ্ছি।” সেই সময় শরচ্চন্দ্রকে এও বলেন : “নিশ্চয় জানবি, বহুকাল পর্যন্ত ‘বহুজনহিতায়’ ঠাকুর ঐ স্থানে স্থির হয়ে থাকবেন।”১১০

সংঘজননী শ্রীশ্রীমায়ের বেলুড় মঠের জমিতে শুভ পদার্পণ ঘটে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে। এর পরে তিনি আরো কয়েকবার এসেছেন, রাত্রিবাস করেছেন, ঠাকুরের প্রতিকৃতি বসিয়ে পূজাও করেছেন।

বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন্ত উপস্থিতির কথা আমরা নানা সূত্রে জানতে পারি। স্বামী প্রেমানন্দজী একদিন বলছেন : “আমি একখানি নূতন কাপড় ঠাকুরকে নিবেদন করে পরতে যাচ্চি, ঠাকুর এসে আমায় বল্লেন, হ্যাঁরে বাবুরাম, তুই নূতন কাপড় পরছিস আর আমার জামা যে কেটে দিয়েচে! আমায় তুই কি আর ভালবাসিস না!’”১১১ তারপর ঠাকুরঘরে গিয়ে দেখা গেল, সত্যিই ঠাকুরের ছবিতে পরানো জামা ইঁদুরে কেটে দিয়েছে। স্বামী প্রেমানন্দজী ও স্বামী শিবানন্দজীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, তাঁরা দেখতেন, ঠাকুর মন্দিরের বারান্দায় বা মঠপ্রাঙ্গণের এদিক-ওদিকে পায়চারি করছেন। সেজন্য তাঁরা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতেন মঠ-প্রাঙ্গণে যেন চোরকাঁটা বা ইটের টুকরো পড়ে না থাকে, যাতে শ্রীশ্রীঠাকুর স্বচ্ছন্দে সেখানে বেড়াতে পারেন।
শুধু ঠাকুর নন, তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদরাও স্থূলশরীর ত্যাগ করার পরে বেলুড় মঠে সূক্ষ্মশরীরে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৩৮ সালের ১৪ জানুয়ারি, মকর সংক্রান্তির দিন বেলুড় মঠে শ্রীশ্রীঠাকুরের নবনির্মিত সুদৃশ্য বিশাল মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকার্য সমাপনের পরে সংঘের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং ঠাকুরের পার্ষদ স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী যখন নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর সেবক-সন্ন্যাসী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন : “আপনি বলেছিলেন, ঠাকুর ও স্বামীজীকে কী বলবেন, বলেছিলেন?” মহারাজ উত্তর দিলেন : “হ্যাঁ, বলেছি। স্বামীজীকে বললাম, ‘স্বামীজী! আপনি ওপর থেকে দেখবেন বলেছিলেন। এবারে দেখুন, আপনারই প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর আজ আপনার পরিকল্পিত নূতন মন্দিরে বসেছেন।’ তখন আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম—স্বামীজী, রাজা মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ, শরৎ মহারাজ, হরি মহারাজ ও গঙ্গাধর মহারাজ সকলেই দাঁড়িয়ে দেখছেন।”১১২ বিজ্ঞান মহারাজ আঙুল দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দিকে দেখালেন।

স্বামী নির্বাণানন্দ স্মৃতিচারণা করছেন : “শুনেছি, (বেলুড় মঠে) মায়ের শরীর দাহ হয়ে যাবার পর মহাপুরুষ মহারাজ উপস্থিত সাধু ও ভক্তদের বলেছিলেন, ‘সতীর শরীরের এক একটি অঙ্গ বুকে নিয়ে সারা দেশে একান্নটি পীঠ গড়ে উঠেছে। সেই সতীর সমস্ত শরীর আজ বেলুড় মঠের মাটিতে মিশে রইল। তাহলেই বুঝে দেখ, বেলুড় মঠ কত বড় তীর্থ!’১১৩ মহাপুরুষ মহারাজ বলেছিলেন : “বেলুড় মঠ কি কম স্থান গা! স্বয়ং শিবাবতার স্বামীজী এখানে বাস করতেন—এখানেই তিনি সমাধিযোগে দেহত্যাগ করেন, কিন্তু এখনও তিনি সূক্ষ্মদেহে এ মঠে রয়েছেন। তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়…।”১১৪
“গুরু আর গঙ্গা দুদিকে আর মাঝখানে আমি বেশ আনন্দে আছি। এ স্থান তো বৈকুণ্ঠ! স্বয়ং জগন্নাথ এখানে রয়েছেন জগতের কল্যাণের জন্য…। কত ভাব, কত মহাভাব হয়েছে এখানে! আমাদের আত্মারাম ঠাকুর রয়েছেন। আর ঠাকুরের পার্ষদরা সকলেই এ স্থানে এখনো সূক্ষ্ম দেহে রয়েছেন, তাঁদের দেখাও পাওয়া যায়। কোথায় কোন একজন সাধক সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাতেই সেই স্থান তীর্থে পরিণত হয়েছে; আর এ যে মহাতীর্থ! এ স্থানের প্রত্যেক ধূলিকণাও যে কত পবিত্র! ঠাকুর, স্বামীজী এঁরা যে কী ছিলেন, তা লোকের বুঝতে ও জানতে এখনো ঢের দেরি। জগতের হিতের জন্য এত বড় আধ্যাত্মিক শক্তি সহস্র সহস্র বৎসরের মধ্যেও জগতে আবির্ভূত হয়নি।… এই বেলুড় মঠের ধুলিতে গড়াগড়ি দেবার জন্য দেশ দেশান্তর থেকে কত লোক ছুটে আসবে!”১১৫

শ্রীরামকৃষ্ণের নিত্যলীলা

দেহান্তে তো বটেই, শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তরা কি জীবৎকালেই রামকৃষ্ণলোকে বাস করছেন না? শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন মন্তব্য করেছিলেন : “আমি দেখছি যেখানে থাকি, রামের অযোধ্যায় আছি।”১১৬ রামকৃষ্ণ–চেতনার চরমে উপনীত হয়ে যখন অনুভূত হবে—অন্তরে তিনি বাইরেও তিনি, তখন এই মর্তলোকই কি রামকৃষ্ণলোকে রূপান্তরিত হয়ে যাবে না? স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী বলেছিলেন : “ঠাকুরকে সদাসর্বদা মনে রাখতে পারলে, তাঁকে ক্ষণমাত্র না ভুলে গেলেই তাঁর কাছে থাকা হলো। মন যখন সদাসর্বদাই ঠাকুরের ভাবে ও চিন্তায় ডুবে থাকবে, যখন মুহূর্তের জন্যও বিস্মরণ হবে না, তখন যেখানেই থাকি না কেন, সেই রামকৃষ্ণলোকেই থাকা হলো।”১১৭ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সম্বন্ধে যেমন বলা হয়—“অদ্যাপিহ সেই লীলা করেন গোরা রায়,/ কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।” ‘দক্ষিণেশ্বরের গোরা রায়’ সম্বন্ধেও একই কথা কি প্রযোজ্য নয়?

রামকৃষ্ণ-সাধনার সিদ্ধি

উপসংহারে বলা যায় যে, রামকৃষ্ণ–সাধনায় আমরা তখনি সিদ্ধ হব, রামকৃষ্ণ–চেতনায় আমরা তখনি প্রতিষ্ঠিত হব যখন আমরা রামকৃষ্ণ-চেতনার রঙে নিজেদের সম্পূর্ণ রাঙিয়ে নেব, তাঁর সত্তায় সত্তাবান হব, ক্ষণকালের জন্যও তাঁকে বিস্মৃত হব না। উপলব্ধি করব—তিনিই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, আবার জগৎপালক ঈশ্বর যিনি আমাদের প্রতি কৃপাবশত এযুগে অবতাররূপে অবতীর্ণ; তিনিই আমাদের চিরসখা, চিরবন্ধু, চির-আশ্রয়।

অন্তিম প্রার্থনা

সাধ্যমতো রামকৃষ্ণ-চেতনা সাধন করলেও শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আমাদের অন্তিম প্রার্থনা যেন হয়—প্রভু, শেষসময়ে যখন এই রূপ-রস-গন্ধের মায়ার জগৎ ছায়ার মতো বিলীন হয়ে যাবে, দু-চোখে যখন নিবিড় আঁধার ঘনিয়ে আসবে—সেই ঘনান্ধকারে একক যাত্রার সময় তুমি কৃপা করে এসে আমাদের হাত ধরে, আলো দেখিয়ে তোমার জ্যোতির্ময়, চির আনন্দময়, চির মঙ্গলময় লোকে নিয়ে যেও! [সমাপ্ত]

তথ্যসূত্র

৯৩ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ২০১, ৮৭
৯৪ দেবলোকে, পৃঃ ২৪৩
৯৫ দ্রঃ শ্রীশ্রীলাটু মহারাজের স্মৃতি-কথা, পৃঃ ৩৭৪
৯৬ দ্রঃ কথামৃত, পৃঃ ১২৩৭; দেবলোকে, পৃঃ ১৪২-৪৩
৯৭ স্বামী সুবোধানন্দের স্মৃতিকথা, পৃঃ ৩২-৩৩
৯৮ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ২৯৪
৯৯ মাতৃদর্শন, পৃঃ ১০১
১০০ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ২০৩
১০১ শ্রীমা সারদা দেবী, পৃঃ ১২৯
১০২ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলক), স্বামী বিজ্ঞানানন্দের স্মৃতিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৪, পৃঃ ১০০-০১
১০৩ দেবলোকে, পৃঃ ২৩০
১০৪ স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দ ও স্বামী চন্দ্রকান্তানন্দ (সংকলক ও সম্পাদক), স্বামী অভেদানন্দ : জন্মসার্ধশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৯, পৃঃ ১৯০-৯১
১০৫ ধর, ডঃ সচ্চিদানন্দ (সংকলক ও প্রকাশক), স্বামী প্রেমেশানন্দজীর পত্র-সংকলন, বোসপুকুর রোড, কলকাতা, ২০০৫, পৃঃ ১৯৯
১০৬ স্বামী সুহিতানন্দ (সংকলক), মুসাফিরের গাঁটরি, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৫, পৃঃ ৫৪
১০৭ মাতৃদর্শন, পৃঃ ১৮০
১০৮ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ১৯০
১০৯ দেবলোকে, পৃঃ ১৭৭
১১০ স্বামি-শিষ্য-সংবাদ, পৃঃ ৮৫
১১১ দ্রঃ ব্রহ্মচারী অ‌ক্ষয়চৈতন্য, প্রেমানন্দ-প্রেমকথা, নব ভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৩৭৩, পৃঃ ৫৬
১১২ স্বামী বিজ্ঞানানন্দের স্মৃতিকথা, পৃঃ ১৫১-৫২
১১৩ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ (সম্পাদক), শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৯৬, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৭
১১৪ দেবলোকে, পৃঃ ৬১; বেলুড় মঠের মহিমা সম্বন্ধে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর উক্তি : “আহা, আহা; এ স্থান কৈলাস, কৈলাস। এখানে গুরু গঙ্গা একসঙ্গে রয়েছেন। এখানে স্বামীজী দেহ রেখেছেন। এ স্থান বৈকুণ্ঠ। দেবদুর্লভ স্থান।” [স্বামী কমলেশ্বরানন্দ, ‘ব্রহ্মানন্দ-প্রসঙ্গ’, স্বামী চেতনানন্দ (সম্পাদক ও সংকলক), স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্মৃতিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৪, পৃঃ ১৪৭]
১১৫ স্বামী অপূর্বানন্দ, (সংকলিত), শিবানন্দ-বাণী, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০২১, ২য় ভাগ, পৃঃ ১০৪-০৫
১১৬ কথামৃত, পৃঃ ৬৮৬
১১৭ স্বামী বিজ্ঞানানন্দের স্মৃতিকথা, পৃঃ ১০১

‘স্বামী গহনানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।