একটি ঘোষণা

সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গিয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি-বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক বিশেষ সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সেই সম্মেলনে ঘোষিত হয়েছে এক ঐতিহাসিক সংবাদ—’National Ignition Facility (NIF)’-এর বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ‘fusion ignition’ প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছেন। অনেকের ধারণা, একুশ শতকে বিজ্ঞানের অন্যতম মাইলফলক হলো এই সাফল্য। আগামী কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর হাল-হকিকত বদলে দিতে পারে এই আবিষ্কার।

কেন এই আবিষ্কার এত গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝার জন্য আমাদের আগে বুঝতে হবে fusion ignition কী, আর তারও আগে বুঝতে হবে fusion কাকে বলে। এককথায় বললে fusion একটি নিউক্লীয় বিক্রিয়া, অর্থাৎ এমন বিক্রিয়া যাতে পরমাণুর নিউক্লিয়াস অংশগ্রহণ করে।

পরমাণুর সংসারে ঠোকাঠুকি

আমরা জানি, তিনধরনের কণা পরমাণু গঠন করে—প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন। এর মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রন কণারা একসঙ্গে ঠাসাঠাসি অবস্থায় থেকে গঠন করে পরমাণুর কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস। আর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন কণারা। দিন-প্রতিদিনের জীবনে আমরা যা যা পরিবর্তন দেখি তার একটা বড় অংশই রাসায়নিক পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনের মূল কারিগর হলো ইলেকট্রন—নিউক্লিয়াসে তার কোনো অাঁচ লাগে না। কয়লা পুড়ে ছাই হওয়া, আম পেকে মিষ্টি হওয়া, চুল পেকে সাদা হওয়া—এই সমস্ত ঘটনারই মূলে আছে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান। কিন্তু প্রকৃতির বুকে এমন ঘটনাও ঘটে যেখানে পরিবর্তনের কারিগর নিউক্লিয়াসের কণারা (প্রোটন ও নিউট্রন), ইলেকট্রনের ভূমিকা সেখানে তুচ্ছ। এই ধরনের প্রক্রিয়াকে বলে নিউক্লীয় পরিবর্তন বা নিউক্লীয় বিক্রিয়া। নিউক্লীয় বিক্রিয়া আবার দুরকমের। নিউক্লীয় বিভাজন (nuclear fission বা ‘fission’)—যেখানে একটি ভারি নিউক্লিয়াস ভেঙে গিয়ে দুই বা ততোধিক হালকা নিউক্লিয়াসের জন্ম দেয়; আর নিউক্লীয় সংযোজন (nuclear fusion বা ‘fusion’)—যেখানে একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস একসঙ্গে জুড়ে গিয়ে ভারি নিউক্লিয়াসের জন্ম দেয়। মজার ব্যাপার হলো, সংযোজন ও বিভাজন—এই দুধরনের বিক্রিয়ার একটা বিষয়ে মিল আছে; তা হলো ভরের গরমিল। দুটি প্রক্রিয়াতেই কিছুটা পরিমাণ ভর হারিয়ে যায়।

বিভাজন বিক্রিয়ায় ভারি নিউক্লিয়াস ভেঙে যে হালকা নিউক্লিয়াসগুলির জন্ম দেয়, তাদের মোট ভর ভারি নিউক্লিয়াসের ভরের চেয়ে কিছুটা কম। আবার সংযোজন বিক্রিয়ায় অংশ নেওয়া হালকা নিউক্লিয়াসগুলির মোট ভরের তুলনায় সংযোজনের ফলে জন্ম নেওয়া ভারি নিউক্লিয়াসের ভর কিছুটা কম হয়। এই হারিয়ে যাওয়া ভর আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর-শক্তির সমীকরণ (E=mc2) অনুযায়ী সরাসরি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আর তাই নিউক্লীয় সংযোজন ও বিভাজন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি।

ভাঙা-গড়ার আজব খেলা

নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়ার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তেজস্ক্রিয়তা—যেখানে ইউরেনিয়াম, রেডিয়ামের মতো কিছু বিশেষ মৌলের নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙে গিয়ে নতুন নতুন মৌলের নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানী হেনরি বেকারেল ও ক্যুরি দম্পতির আবিষ্কারের হাত ধরে (১৮৯৬ সাল) নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়াকে চিনতে শেখে মানুষ। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় ১২৬ বছর। ততদিনে মানুষ নিউক্লীয় বিভাজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে নিয়েছে। মারণ বোমা বানিয়ে যেমন ধ্বংস করেছে হিরোশিমা ও নাগাসাকি, তেমনি বিশ্বজুড়ে নির্মাণ করেছে অজস্র নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট—বিভাজন বিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগে যেখানে প্রতিনিয়ত উৎপন্ন হচ্ছে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ-শক্তি।

নিউক্লীয় সংযোজনের আবিষ্কার হয়েছিল বেশ কিছুটা পরে, ১৯২০—৩০-এর দশকে। স্যার আর্থার এডিংটন Nature পত্রিকায় প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘The Internal Constitution of the Stars’। বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে তিনি বোঝান যে, সূর্য ও সূর্যের মতো আরো অসংখ্য নক্ষত্রের বিপুল শক্তির উৎস এক নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া। সেই বিক্রিয়ায় চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের মিলনে জন্ম নেয় একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। বিশ্বের বিজ্ঞানীমহল বুঝতে পারেন, নতুন ধরনের এই নিউক্লীয় বিক্রিয়ার ভিতর লুকিয়ে আছে অতুল সম্ভাবনা। শুধু নতুন মারণাস্ত্রই নয়, সংযোজন বিক্রিয়াকে কাজে লাগাতে পারলে পরিবেশের বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করেই উৎপাদন করা যাবে অফুরান শক্তি।

আসলে আমরা নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়াকে ব্যবহার করে যে শক্তি উৎপাদন করি, তার প্রধান দুটি সমস্যা হলো জ্বালানির অপ্রতুলতা ও পরিবেশের ক্ষতি। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে জ্বালানি হিসাবে সাধারণত ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম। আর পৃথিবীতে ইউরেনিয়াম ধাতুর পরিমাণ সীমিত। দ্বিতীয়ত, নিউক্লীয় বিভাজনে উৎপন্ন নতুন নিউক্লিয়াসগুলিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা দেখায়। কাজেই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ, যা পরিবেশের ক্ষতি করে। তুলনায় সংযোজন বিক্রিয়ার জ্বালানি হলো হাইড্রোজেন—যা সমুদ্রের জল থেকে সহজেই পাওয়া যায়। সংযোজন বিক্রিয়ার শেষে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়। হিলিয়াম তেজস্ক্রিয় নয়, এমনকী রাসায়নিকভাবেও হিলিয়াম নিষ্ক্রিয়। কাজেই পরিবেশের ক্ষতিও হয় না এতটুকু। সুতরাং নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে সাড়া পড়ে যাওয়ায় আশ্চর্য কিছু ছিল না।

দুঃখের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন—সংযোজন বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নতুন মারণাস্ত্র (হাইড্রোজেন বোমা) বানানো যতখানি সহজ, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে জনকল্যাণে কাজে লাগানো ততখানি সহজ নয়। শুরু হলো বিজ্ঞানের এক সুদীর্ঘ খোঁজ—‘Quest for Fusion Power’।

দ্বন্দ্ব অহর্নিশ

আসলে গড়ার কাজটা চিরকালই ভাঙার চেয়ে কঠিন। সংযোজন বিক্রিয়াও তাই বিভাজনের তুলনায় অনেক অনেক কঠিন। কেন কঠিন তা বুঝতে আবার ফিরে যাই পরমাণুর অন্তস্তলে—নিউক্লিয়াসে। আগেই বলা হয়েছে, নিউক্লিয়াসে ঠাসাঠাসি করে থাকে নিউট্রন আর প্রোটন কণা। নিউট্রন কণা তড়িৎ-শূন্য, কিন্তু প্রোটন কণায় থাকে ধনাত্মক তড়িৎ আধান (পজিটিভ চার্জ)। কাজেই মোটের ওপর পরমাণুর নিউক্লিয়াসেও থাকে ধনাত্মক তড়িৎ আধান। দুটি নিউক্লিয়াস সংযোজন বিক্রিয়ায় অংশ নিতে যখনি কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে তখনি তাদের নিজেদের তড়িৎ আধান (উভয়ই ধনাত্মক হওয়ায়) পরস্পরকে তীব্রভাবে বিকর্ষণ করে। ফলে নিউক্লিয়াস দুটি কাছাকাছি আসতে পারে না, সংযোজন বিক্রিয়াও অধরা থেকে যায়।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দুটি নিউক্লিয়াস যদি ধনাত্মক তড়িৎ আধানের কারণে পরস্পরকে বিকর্ষণ করে কাছে আসতে না দেয়, তবে ধনাত্মক আধানযুক্ত একাধিক প্রোটন কণা কীভাবে নিউক্লিয়াসের ঠাসাঠাসি সংসারে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে? উত্তরটা লুকিয়ে আছে প্রকৃতির এক আশ্চর্য মৌলিক বলের ভিতরে, যার নাম ‘তীব্র নিউক্লীয় বল’ (strong nuclear force)। এই বল তড়িৎ-শক্তিজাত বলের (আকর্ষণ বা বিকর্ষণ) তুলনায় অনেক অনেক গুণ শক্তিশালী। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই বল শুধুমাত্র অত্যন্ত কম দূরত্বে কাজ করে। এক মিটারের এককোটি ভাগকে আবার এককোটি ভাগ করলে যে-দূরত্ব পাওয়া যায়—সেই দূরত্বে। এই দূরত্বকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ফেমটো মিটার দূরত্ব। পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলির ব্যাস এই ফেমটো মিটার দূরত্বের মধ্যে পড়ে। কাজেই নিউক্লিয়াসের মধ্যে তীব্র নিউক্লীয় বল ক্রিয়াশীল। এই বলের তীব্র আকর্ষণ সমান তড়িৎ আধানযুক্ত প্রোটন আর তড়িৎ-শূন্য নিউট্রন কণাগুলিকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে, তড়িৎ-শক্তিজাত বিকর্ষণকে মাথা তুলতে দেয় না।

এখন আমাদের কাছে দুটি চিত্র পরিষ্কার।—(১) সম-তড়িৎ আধানের দুটি নিউক্লিয়াস পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, কাছে আসতে দেয় না এবং (২) তড়িৎ আধানের বিকর্ষণকে উপেক্ষা করে একবার খুব কাছাকাছি (ফেমটো মিটার দূরত্বে) চলে এলে নিউক্লিয়াসের কণাগুলি পরস্পরকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে শুরু করে। সুতরাং সংযোজন বিক্রিয়া চালু করার উপায় হলো কোনোভাবে এই বিকর্ষণ বলকে অতিক্রম করিয়ে নিউক্লিয়াসগুলিকে কাছাকাছি আনা।

মিলনের পথ

বিকর্ষণকে অতিক্রম করানোর একটি উপায় হলো গতি। নিউক্লিয়াসগুলি যদি প্রবল বেগে পরস্পরের দিকে ছুটে যায় তবে গতিশক্তির প্রভাবে তড়িৎ-শক্তিজাত বিকর্ষণকে অতিক্রম করতে পারে (অনেকটা বাধার প্রাচীর ফুঁড়ে যাওয়ার মতো)। নিউক্লিয়াস (অথবা পরমাণুর) গতিশক্তি বাড়ানোর সহজতম পদ্ধতি হলো উত্তাপ। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, জ্বালানিকে অন্তত ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিয়ে যেতে পারলে কৃত্রিম উপায়ে সংযোজন বিক্রিয়া শুরু হয়। বিজ্ঞানীরা আরো দেখেছেন, আমাদের কাছের নক্ষত্র সূর্যে তুলনামূলক অনেক কম তাপমাত্রায় (সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা ৩ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি) নিউক্লীয় সংযোজন ঘটে। আসলে সূর্যের প্রবল মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসগুলি এমনিতেই খুব ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে, তাই অপেক্ষাকৃত অনেক কম তাপমাত্রাতেই সূর্যে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ঘটতে পারে।

সূর্যে ঘটে চলা সংযোজন বিক্রিয়ার সঙ্গে কৃত্রিম সংযোজন বিক্রিয়ার আরো একটা তফাত রয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, সূর্যে চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস (একাধিক ধাপে) সংযোজিত হয়ে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস উৎপন্ন করে। কৃত্রিম সংযোজন বিক্রিয়াতেও হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস উৎপন্ন হয় ঠিকই, তবে কিছুটা অন্য উপায়ে (চিত্র দ্রষ্টব্য)। চারটি সাধারণ হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের বদলে এখানে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেনের দুটি পৃথক আইসোটোপ—একটি ডয়টেরিয়াম ও একটি ট্রিটিয়াম নিউক্লিয়াস (সাধারণ হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসে থাকে শুধুমাত্র একটি প্রোটন, ডয়টেরিয়ামে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন এবং ট্রিটিয়ামে একটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন)। বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস (দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন), একটি মুক্ত নিউট্রন ও বিপুল পরিমাণে শক্তি। মাত্র ২ গ্রাম ডয়টেরিয়াম ও ৩ গ্রাম ট্রিটিয়ামের সংযোজন থেকে যে-পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায় তা প্রায় ১৪০০ কেজি কয়লা পুড়িয়ে পাওয়া তাপশক্তির সমান।

জমা-খরচের খাতা

নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ায় পাওয়া শক্তির পরিমাণ চমকপ্রদ, পরিবেশের জন্যও অনুকূল। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। আগেই বলা হয়েছে, নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া শুরু করতে জ্বালানিকে অন্তত ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে হয়। এই তাপমাত্রা কিছুটা কমানো সম্ভব যদি জ্বালানিকে চাপ দিয়ে সংকুচিত (compress) করা যায়। জ্বালানিকে এই বিরাট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে ও সংকুচিত করতে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল পরিমাণ শক্তির খরচ হয়। সংযোজন বিক্রিয়ায় যতখানি শক্তি পাওয়া যায়, তার চেয়েও বেশি শক্তি ব্যয় হয়ে যায়। ধরা যাক, কয়লার গাদায় পড়ে থাকা একটুকরো কয়লাকে জ্বালাতে একটা দেশলাই কাঠি ব্যয় করা হলো। একবার ধরে গেলে সেই একটুকরো কয়লার আগুনই কিন্তু বাকি কয়লাগুলিকে জ্বলে উঠতে সহায়তা করে। প্রতিটি কয়লাখণ্ডকে আলাদা আলাদা করে দেশলাই ঠুকে জ্বালাতে হয় না। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে, কয়লার গাদায় আগুন জ্বালানোর প্রক্রিয়াটি ‘শক্তি-দক্ষ’ (energy efficient—খরচ করা শক্তির তুলনায় প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ বেশি)।

কৃত্রিম নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার ব্যাবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হলো, প্রক্রিয়াটি energy efficient নয়। অর্থাৎ, সংযোজন বিক্রিয়াটিকে শুরু করতে (এবং চালু রাখতে) যে-পরিমাণ শক্তি খরচ হয় সেই পরিমাণ শক্তি সংযোজন বিক্রিয়া থেকে ফেরত পাওয়া যায় না। বিগত প্রায় ছয় দশক ধরে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এই বাধাটিকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে চলেছেন। খুঁজে পেতে চাইছেন এমন এক প্রযুক্তি, যাতে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত কম শক্তি খরচ করে বেশি পরিমাণ শক্তি ফেরত পাওয়া যায়। সংযোজন বিক্রিয়ায় জ্বালানিতে প্রযুক্তির দেশলাই ঠোকার এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় ‘fusion ignition’।

আশ্চর্য দেশলাই কাঠি

২০২২-এর ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার NIF-এর বিজ্ঞানীরা এই অসম্ভব কাজটিকেই প্রথমবারের জন্য করে দেখিয়েছেন। সংযোজন বিক্রিয়ায় খরচ হওয়া শক্তির তুলনায় দেড়গুণ বেশি শক্তি ফেরত পাওয়া গিয়েছে। আর তাতেই পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গিয়েছে। কীভাবে সম্ভব হলো fusion ignition?

NIF-এর ল্যাবরেটরিতে যে-পদ্ধতিতে fusion ignition করা সম্ভব হয়েছে, তাকে বলা হয় ‘Inertial Confinement Fusion (ICF)’। এই পদ্ধতিতে খুব সামান্য পরিমাণ (≈১ মিলিগ্রাম) সংযোজন জ্বালানি (ডয়টেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম) একটি ক্যাপসুলের ভিতরে নেওয়া হয়। এরপর চারিদিক থেকে তীব্র শক্তিসম্পন্ন লেজার রশ্মি দিয়ে ক্যাপসুলটিকে আঘাত করা হয়। তীব্র লেজারের অভিঘাতে জ্বালানির পরমাণু থেকে ছিটকে যায়, তৈরি হয় প্লাজমা (মুক্ত নিউক্লিয়াস ও মুক্ত ইলেকট্রন)। একইসঙ্গে লেজারের তীব্রতায় মুহূর্তের মধ্যে জ্বালানির তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে। জ্বালানির একদম বাইরের স্তরটি সবচেয়ে বেশি ও সবচেয়ে দ্রুত উত্তপ্ত হয় এবং তীব্র বিস্ফোরণে উবে যায়। বাইরের স্তরের এই বিস্ফোরণের অভিঘাত, নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী, জ্বালানির ভিতরের স্তরে একটি অন্তর্মুখী তীব্র প্রত্যাঘাত সৃষ্টি করে। জ্বালানির দ্রুত সংকোচন (compression) ঘটে। শুরু হয়ে যায় নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটিকেই দশকের পর দশক ধরে সংশোধিত ও ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টায় দিন কাটিয়েছেন NIF-এর বিজ্ঞানীরা। অবশেষে গত ৫ ডিসেম্বর ২০২২ তাঁরা ২.০৫ মেগাজুল (শক্তির একক) লেজার শক্তি ব্যবহার করে একটি সংযোজন বিক্রিয়া সম্পাদন করেন। শক্তি ফেরত পাওয়া যায় ৩.১৫ মেগাজুল—খরচ হওয়া শক্তির প্রায় দেড়গুণ।

সওয়াল-জবাবের পারে

এখানে দুটি প্রশ্ন মনে আসে।

(১) নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ব্যবহার করে ১৯৫২ সালেই প্রথম হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা হয়েছিল। তবে কি সেখানে fusion ignition সফল হয়নি? এর উত্তরে বলা যায়—অবশ্যই হাইড্রোজেন বোমায় fusion ignition সফল হয়েছিল, তবে তা করা হয়েছিল নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে। আসলে হাইড্রোজেন বোমার ভিতরে (কমপক্ষে) দুটি অংশ থাকে। একটি অংশে বিভাজন বিক্রিয়ার জন্য থাকে ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম জ্বালানি। দ্বিতীয় অংশে সংযোজন বিক্রিয়ার জন্য ডয়টেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম জ্বালানি। প্রথম বিস্ফোরণ হয় ইউরেনিয়াম/প্লুটোনিয়ামে। নিউক্লীয় বিভাজনে মুক্ত হওয়া বিপুল শক্তি সংযোজন বিক্রিয়ার দেশলাই কাঠির কাজটি করে। শুরু হয় দ্বিতীয় বিস্ফোরণ—নিউক্লীয় সংযোজন। এই প্রক্রিয়া মারণাস্ত্রের জন্য উপযুক্ত হলেও জনকল্যাণের কাজে অচল। কারণ, শক্তি উৎপাদনে সংযোজন বিক্রিয়ার ব্যবহারের উদ্দেশ্যই হলো পরিবেশের ক্ষতি না করা। ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের ব্যবহার সেই উদ্দেশ্যটিকেই ব্যর্থ করে দেয়। NIF-এর সাম্প্রতিক সাফল্য এই কারণে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

(২) এই আবিষ্কার কি আমাদের হাতে অফুরান শক্তির চাবিকাঠি তুলে দিল? এর উত্তর একইসঙ্গে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। ‘হ্যাঁ’ তার কারণ—এই আবিষ্কার অন্তত তত্ত্বগতভাবে প্রমাণ করে দিল fusion ignition সম্ভব, নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়াকে energy efficient করা সম্ভব। উত্তরে ‘না’ বলার কারণ অনেকগুলি। প্রথমত, যদিও বলা হচ্ছে ২.০৫ মেগাজুল শক্তির লেজার ব্যবহার করে ৩.১৫ মেগাজুল শক্তি পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু হিসাবটা এত সরল নয়। ২.০৫ মেগাজুল লেজার রশ্মি তৈরি করতেই প্রায় ৪০০ মেগাজুল অতিরিক্ত শক্তি খরচ হয়ে যায়। সেই খরচটুকু হিসাবে নিলে প্রাপ্ত শক্তি আর খরচ হওয়া শক্তির দেড়গুণ থাকে না, হয়ে যায় ১%-এরও কম। দ্বিতীয়ত, জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপের মধ্যে ট্রিটিয়াম প্রকৃতির বুকে অত্যন্ত বিরল। কাজেই জ্বালানির অপ্রতুলতার চিন্তাটিও থেকেই যায়। তৃতীয়ত, NIF-এর সফল বিক্রিয়াটিতে অতি অল্প পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছিল এবং বিক্রিয়াটি স্থায়ী হয়েছিল অতি অল্প পরিমাণ সময়ের জন্য (৯০ পিকো-সেকেন্ড; ১ পিকো-সেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের এক লক্ষকোটি ভাগের এক ভাগ)। বাস্তবে ব্যবহারের উপযোগী সংযোজন বিক্রিয়া এখনো অনেক দূরের পথ।

তবে কি এই সাফল্য আশা জাগানোর মতো নয়? এই সাফল্য অতি অবশ্যই অত্যন্ত আশাপ্রদ। পৃথিবীতে শক্তির চাহিদা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। এই সাফল্য ভবিষ্যতে পরিবেশ-বান্ধব এক অফুরান শক্তির ভাণ্ডার খুঁজে পাওয়ার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শুধুমাত্র সূর্যের শক্তির রহস্য ভেদ করেই মানবজাতি থেমে থাকেনি, পৃথিবীর বুকে বসে সেই শক্তিকে করায়ত্ত করে একদিন মানুষেরই কল্যাণে সে ব্যবহার করবে। NIF-এর সাফল্য আমাদের এই আশ্চর্য স্বপ্নটি দেখার সাহস জোগায়।  

তথ্যসূত্র

১ https://www.energy.gov
২ https://www.llnl.gov
৩ https://news.newenergytimes.net
৪ https://www.wikipedia.org