[পূর্বানুবৃত্তি : পৌষ ১৪২৯ সংখ্যার পর]

।।১৯।।

আত্মা বোধক্রিয়ার কর্তা—এই মত খণ্ডন

শাঙ্করভাষ্য—যদা পুনর্বোধক্রিয়াকর্তেতি বোধক্রিয়া-লক্ষণেন তৎকর্তারং বিজানাতীতি বোধলক্ষণেন বিদিতং প্রতিবোধবিদিতমিতি ব্যাখ্যায়তে। যথা যো বৃক্ষশাখাশ্চা-লয়তি, স বায়ুরিতি তদ্বৎ। তদা বোধক্রিয়াশক্তিমানাত্মা দ্রব্যম্‌, ন বোধস্বরূপ এব। বোধস্তু জায়তে বিনশ্যতি চ। যদা বোধো জায়তে, তদা বোধক্রিয়য়া সবিশেষঃ। যদা বোধো নশ্যতি, তদা নষ্টবোধো দ্রব্যমাত্রং নির্বিশেষঃ। তত্রৈবং সতি, বিক্রিয়াত্মকঃ সাবয়বোঽনিত্যোঽশুদ্ধ ইত্যাদয়ো দোষা ন পরিহর্তুং শক্যন্তে।

ব্যাখ্যা—অনেকে আবার এই ‘প্রতিবোধবিদিতম্‌’ শব্দের অন্য ব্যাখ্যা করে থাকে। সেই বিষয়েই এখানে তর্কের প্রসঙ্গ আসছে। ‘যদা পুনঃ বোধক্রিয়াকর্তা ইতি’—[যাদের মতে জ্ঞান একটি ক্রিয়া, তাদের দ্বারা ‘প্রতিবোধ-বিদিতম্‌’ পদের অর্থ] যখন এরূপ ব্যাখ্যা করা হয় যে, আত্মা হলেন বোধক্রিয়ার কর্তা; তখন ‘বোধক্রিয়ালক্ষণেন’—বোধরূপ বা জ্ঞানরূপ ক্রিয়ার লক্ষণের দ্বারা ‘তৎকর্তারং বিজানাতি ইতি’—সেই বোধক্রিয়ার কর্তাকে জানা যায়। ‘বোধলক্ষণেন বিদিতং প্রতিবোধবিদিতম্‌ ইতি ব্যাখ্যায়তে’—সেক্ষেত্রে বোধরূপ বা জ্ঞানরূপ ক্রিয়ার লক্ষণ দ্বারা বিদিত আত্মাকেই প্রতিবোধবিদিত বলা হয়। অর্থাৎ ‘প্রতিবোধবিদিতম্‌’-এর অর্থ হচ্ছে—প্রত্যেক বোধরূপ ক্রিয়ার দ্বারা সেই বোধক্রিয়ার কর্তারূপে যিনি বিদিত হন, তিনিই আত্মা। ‘যথা যঃ বৃক্ষশাখাঃ চালয়তি, সঃ বায়ুঃ ইতি তদ্বৎ’—যেমন, যে বৃক্ষশাখা সঞ্চালিত করছে সে বায়ু; সেইরকম যিনি বোধক্রিয়া করছেন তিনি আত্মা। অর্থাৎ বৃক্ষশাখার স্পন্দন বা চলন-রূপ ক্রিয়ার দ্বারা সেই ক্রিয়ার কর্তারূপে যেমন বায়ুকে জানা যায়, সেইরূপ প্রত্যেক বোধরূপ ক্রিয়ার দ্বারা বোধক্রিয়ার কর্তারূপে আত্মাকে জানতে পারা যায়। [অর্থাৎ শাখাকম্পনকারিত্ব যেমন বায়ুর লক্ষণ, জ্ঞানক্রিয়াকর্তৃত্ব সেইরূপ আত্মার লক্ষণ। এই মতে আত্মা জ্ঞানস্বরূপ নন, জ্ঞানক্রিয়ার কর্তা।] কিন্তু এইপ্রকার সিদ্ধান্ত করা হলে ‘তদা বোধক্রিয়াশক্তিমান্‌ আত্মা দ্রব্যম্‌’—তখন বোধক্রিয়ারূপ যে-শক্তি, সেই শক্তিবিশিষ্ট আত্মা ‘দ্রব্য’ বলে সিদ্ধ হয়ে যায়। দ্রব্যকে আশ্রয় করে গুণ আর ক্রিয়া থাকে। দ্রব্যকে আশ্রয় না করে তারা থাকতে পারবে না। সেইজন্য এখানে বোধক্রিয়া আত্মাকে (দ্রব্য) আশ্রয় করে রইল। যদি আত্মা দ্রব্য হন, তাহলে বোধক্রিয়া আর আত্মা ভিন্ন হবে। গুণ আর গুণীর তফাত হবে। আশ্রয়-আশ্রয়ী ভিন্ন হলে আশ্রয়-আশ্রয়ী সম্পর্ক হয়। সেক্ষেত্রে আত্মা বোধক্রিয়ার কর্তা হলেন, ‘ন বোধস্বরূপ এব’—সাক্ষাৎ বোধস্বরূপ বলে সিদ্ধ হলেন না। বোধক্রিয়ার কর্তা যিনি, তিনি বোধস্বরূপ হলেন না। অতএব প্রতিবোধক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মা থাকবেন, কিন্তু বোধক্রিয়ার কর্তারূপে থাকবেন—বোধস্বরূপে নয়। আর ‘বোধস্তু জায়তে বিনশ্যতি চ’—বোধ জন্মায় আবার বিনাশপ্রাপ্ত হয়। ‘যদা বোধো জায়তে, তদা বোধক্রিয়য়া সবিশেষঃ’—যখন বোধ উৎপন্ন হয়, তখন বোধক্রিয়ারূপ লক্ষণ দ্বারা আত্মা বিশিষ্ট হন এবং ‘যদা বোধো নশ্যতি, তদা নষ্টবোধো দ্রব্যমাত্রং নির্বিশেষঃ’—যখন সেই বোধ বিনষ্ট হয়, তখন আত্মা নির্বিশেষ দ্রব্যমাত্ররূপে থাকেন। যেমন, একটা ঘট—ঘটে গুণ আশ্রয় করে আছে, এখন সেই গুণকে সরিয়ে দেওয়া হলে কী থাকে? ঘট থাকে। ঘটটা এইরকম আকারবিশিষ্ট, ঐরকম রংবিশিষ্ট। রংটা সরিয়ে দিলাম, আকারটা সরিয়ে দিলাম, কী থাকবে? একটা নির্বিশেষ দ্রব্যমাত্র। দ্রব্যকে আমরা বিশেষিত করলে সেটা তখন জ্ঞানের বিষয় হয়। কিন্তু যখন দ্রব্যমাত্র হয়ে রইল তখন তার আর কোনো বিশেষ রইল না।

‘তত্রৈবং সতি, বিক্রিয়াত্মকঃ সাবয়বঃ অনিত্যঃ অশুদ্ধ ইত্যাদয়ো দোষা ন পরিহর্তুং শক্যন্তে’—পূর্বোক্তরূপ অর্থ গ্রহণ করলে অর্থাৎ আত্মা যদি এইরকম দ্রব্যমাত্র হন, তাহলে আত্মা কখনো জ্ঞানক্রিয়াবান সবিশেষ হন, আবার কখনো নির্বিশেষ জ্ঞানরহিত হন। তার ফলে আত্মা বিক্রিয়াত্মক হবেন, বিকারী হবেন। বিকারী হলেই তা সাবয়ব হবে। সাবয়ব হলেই তা অনিত্য হয়, আর বিকারবশত আত্মা অশুদ্ধ হয়ে যান। সুতরাং এইসমস্ত দোষ অর্থাৎ সাবয়বত্ব, অনিত্যত্ব, অশুদ্ধত্ব দোষ এইমতে ‘ন পরিহর্তুং শক্যন্তে’—পরিহার করতে পারবে না; আত্মা এইসব দোষে দুষ্ট হয়ে যান। নৈয়ায়িকের সিদ্ধান্তানুযায়ী দ্রব্যতে গুণ সমবায় সম্বন্ধে থাকে; সমবায় সম্বন্ধ নিত্যসম্বন্ধ। এখন দ্রব্যতে যখন ঘটটা প্রথম উৎপন্ন হলো, প্রথমক্ষণে সে নির্বিশেষমাত্র। তারপর তাতে গুণ উৎপন্ন হয়। এই গুণগুলি তাতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। সুতরাং সেই ঘটটি যেমন অনিত্য, তেমনি আত্মা অনিত্য হয়ে যাচ্ছেন, পরিবর্তনশীল হয়ে যাচ্ছেন। অতএব আত্মা সাবয়ব, অনিত্য, অশুদ্ধ—এইসব দোষ যে বলা হলো, তা এইমতে পরিহার করা যায় না। [অতএব এই মত শাস্ত্রসিদ্ধ ও যুক্তিসিদ্ধ হতে পারে না—এই হলো ভাষ্যকারের অভিপ্রায়।]

প্রশ্ন—‘তদা নষ্টবোধো দ্রব্যমাত্রং নির্বিশেষঃ’—এর মানে কী?

উত্তর—নির্বিশেষ মানে বিশেষরহিত। ঘট হলো একটা দ্রব্য; গুণ, রং, আকার ইত্যাদি হলো তার বিশেষতা। দ্রব্যমাত্র মানে তার আর কোনো বিশেষ নেই; বিশেষ গুণগুলি পরে তাতে উৎপন্ন হয়। নৈয়ায়িকদের মতে উৎপন্ন ঘট প্রথমক্ষণে নির্বিশেষ থাকে, তার পরক্ষণেই গুণাদি তাতে উৎপন্ন হয় এবং সেগুলি তাতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে।

কণাদ প্রভৃতির মত খণ্ডন

শাঙ্করভাষ্য—যদপি কাণাদানামাত্মমনঃসংযোগজো বোধ আত্মনি সমবৈতি, অত আত্মনি বোদ্ধৃত্বং ন তু বিক্রিয়াত্মক আত্মা; দ্রব্যমাত্রস্তু ভবতি, ঘট ইব রাগসমবায়ী।

ব্যাখ্যা—‘যদপি কাণাদানাম্‌’—কাণাদ১ অর্থাৎ কণাদমতাবলম্বী-(বৈশেষিক)-গণদের মতে ‘আত্ম-মনঃ-সংযোগজঃ বোধঃ আত্মনি সমবৈতি’—আত্মা এবং মনের সংযোগ থেকে যে-বোধ (অর্থাৎ জ্ঞান) উৎপন্ন হয় সেই বোধ আত্মাতে সমবায় সম্বন্ধে২ থাকে। ‘অতঃ আত্মনি বোদ্ধৃত্বম্‌’—এইজন্য আত্মাতে বোদ্ধৃত্ব থাকে। ‘ন তু বিক্রিয়াত্মকঃ আত্মা’—আত্মা নিজে কিন্তু বিক্রিয়াত্মক নন। অর্থাৎ ঐ বোধ আত্মাতে সমবায় সম্বন্ধে থাকার জন্য অর্থাৎ সমবায় সম্বন্ধে আত্মাতে বোধ উৎপন্ন হচ্ছে বলে আত্মাকেও বিকারী বলে মনে হবে, স্বরূপত আত্মা বিক্রিয় নন। আত্ম-মনঃসংযোগ হলে আত্মাতে জ্ঞানগুণ উৎপন্ন হয়। এই মতে আত্মা জ্ঞানস্বরূপ নন। মনের সঙ্গে যখন আত্মার সংযোগ হয় তখনি তাতে গুণ উৎপন্ন হয়। মন সংযুক্ত না হলে আত্মাতে কোনো গুণ নেই, কোনো গুণ প্রত্যক্ষ হবে না। যখন মনের সঙ্গে যোগ হয় তখনি তার কর্তৃত্ব, বোধকর্তৃত্ব। তখনি বোধ উৎপন্ন হয়।

১ কাণাদ মানে—কণাদের অনুসারী যারা। কণাদ হলো বৈশেষিক দর্শনের কর্তা, তাঁর অনুগামী সম্প্রদায় হলো কাণাদ। যেমন বুদ্ধ থেকে বৌদ্ধ, তেমনি কণাদ থেকে কাণাদ।
২ বৈেশষিক মতে, আত্মা বোধের সমবায়ী কারণ। আত্মা ও মনের সংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং রূপাদি বিষয় প্রভৃতি নিমিত্ত কারণ।

আত্মা যে জ্ঞানস্বরূপ, তা আমরা কী করে জানছি?—অমুকের জ্ঞান, তমুকের জ্ঞান আছে বলে। অমুক জ্ঞান, তমুক জ্ঞানটা হয় কখন?—আত্মা আর মনের সংযোগ হলে। আত্মা আর ইন্দ্রিয়ের সংযোগে হয় না, আত্মা আর মনের সংযোগে হয়। এই যে ঘট রয়েছে, কিন্তু দেখছি না কেন?—মনোযোগ হয়নি বলে। মনের সঙ্গে আত্মার যোগ হয়নি। মনের সঙ্গে যোগ হলে তবে বোধকর্তৃত্ব আসে। সুতরাং আত্মার যে বিকার হবে বলছ, তা মনের সঙ্গে সংযোগবশত বিকার। আত্মাতে বিকার হলো না। আত্মাকে বিকারী বলা হচ্ছে না।

যদি মনের সঙ্গে সংযোগ না হতো, আত্মাতে ঘটজ্ঞান উৎপন্ন হতো না। ঘটজ্ঞান হচ্ছে কোথায়?—আত্মাতে হচ্ছে। সেই আত্মাতে ঘটজ্ঞান কখন হবে?—যখন মনের সঙ্গে যোগ হবে। ঘটের সঙ্গে চোখের যোগ হলো। সুতরাং চোখের সঙ্গে যোগ হলেই সেই বার্তা সে মনের কাছে পৌঁছে দেবে, মন আত্মার কাছে পৌঁছে দেবে। বিষয় সাক্ষাদ্‌ভাবে আত্মার কাছে পৌঁছাতে পারছে না, মাঝখানে মন থাকতে হবে। এইজন্য বিষয় রয়েছে অথচ আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমার জ্ঞান হচ্ছে না মানে আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। মন পরিবর্তনশীল, মনের সঙ্গে যোগ হলে তবে জ্ঞান হবে। যখনি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে, তখনি বিষয় অনুভূত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিষয় অনুভূত হচ্ছে না কেন? কারণ, মন ছিল না বলে। সুতরাং মনের সঙ্গে যোগ হতে হবে। আত্মাতে তখনি জ্ঞান উৎপন্ন হয় যখন বৃত্তি মনের সঙ্গে যুক্ত হয়। আত্মা ও মনের সংযোগবশত জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সুতরাং বোধক্রিয়ার কর্তারূপে আত্মা রয়েছেন বলে আত্মা বিক্রিয়াত্মক হবেন—তা নয়। মাঝখানে বুদ্ধি রয়েছে, মন রয়েছে; সেই মনই বিকারশীল। আত্মা নির্বিকার। যেমন ঘটটা নির্বিকার; কিন্তু ঘটের গুণগুলি তাকে বিকারী করছে।

নৈয়ায়িক মতে—যখন ঘট উৎপন্ন হলো, সেইক্ষণে অর্থাৎ উৎপত্তিক্ষণে তার ভিতরে গুণাদি নেই। পরক্ষণে গুণাদি সংযুক্ত হয়ে অমুক গুণবিশিষ্ট ঘট বলে জ্ঞান হচ্ছে। লাল রঙের ঘটের ক্ষেত্রে লালঘট বলে যখন জ্ঞান হচ্ছে তখন বিশিষ্টরূপে জ্ঞান হচ্ছে। লালঘট আর শুধু ঘট পৃথক। তাহলে যে-ঘটটিতে লাল গুণ উৎপন্ন হবে, সে লালঘট হবে। তাহলে শুধু ঘটটি অরূপ, তার রূপ নেই। কারণ, তার রূপ তো পরে উৎপন্ন হচ্ছে। ঘটে গুণ উৎপন্ন হয়; কিন্তু যখন গুণ উৎপন্ন হয়নি, তখন সে নির্গুণ। যে নির্গুণ সে তো অবিকারী হবে, তাহলে আত্মা অবিকারী, [কেবল দ্রব্যস্বরূপ]—এটা নৈয়ায়িকদের সিদ্ধান্ত।

বেদান্তী বললেন, যদি আত্মাতে এই গুণ হয় তাহলে আত্মা বিকারী হয়ে যাবেন, বোধক্রিয়ার কর্তারূপে তিনি বিকারী হয়ে যাবেন। আর বিকারী হলে আত্মা অনিত্য হবেন। কিন্তু আত্মাকে অনিত্য কেউ বলবে না—বেদান্তীও বলবে না, নৈয়ায়িকও বলবে না। তাহলে দোষ হয়ে যাবে। নৈয়ায়িকও বলবে—আত্মা অবিকারী, নিত্য। সেই দোষটাকে বৈশেষিক-নৈয়ায়িকেরা স্খালন করছে এইভাবে—আমাদের মতে আত্মা বিকারী নন। তুমি (সিদ্ধান্তী) বলছ, বোধক্রিয়ার কর্তারূপে সেই বোধের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মা পরিবর্তিত হচ্ছেন, বিকারী হয়ে যাচ্ছেন। আমরা ঐভাবে বলব না। আমরা বলব—মাঝখানে মন রয়েছে, সেই মন পরিবর্তিত হচ্ছে। আত্মা অপরিবর্তনশীল—উৎপত্তিক্ষণে ঘটের মতো।

অতএব কণাদমতাবলম্বীদের মত হচ্ছে—‘আত্মমনঃ-সংযোগজঃ বোধঃ আত্মনি সমবৈতি’—আত্মা ও মনের সংযোগবশত বোধ উৎপন্ন হয়ে আত্মাতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। ‘অতঃ আত্মনি বোদ্ধৃত্বম্‌’—অতএব আত্মার যে বোদ্ধৃত্ব—আত্মাকে বোদ্ধা বলা হচ্ছে, জ্ঞান-গুণবিশিষ্ট বলা হচ্ছে তা এই সমবায় সম্বন্ধের জন্য। ‘ন তু বিক্রিয়াত্মকঃ আত্মা’—কিন্তু আত্মা বিক্রিয়াত্মক হলেন না। ‘দ্রব্যমাত্রঃ তু ভবতি’—কারণ, আত্মা একটা দ্রব্যমাত্রই হলেন, যে- দ্রব্যতে জ্ঞানরূপ গুণ উৎপন্ন হয়, কিন্তু তা জ্ঞানস্বরূপ নয়। ‘ঘটঃ ইব রাগসমবায়ী’—যেমন ঘটের সঙ্গে তার রং সমবায় সম্বন্ধে থাকে, সেইরকম জ্ঞান আত্মাতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। এই হলো কণাদমতাবলম্বীদের সিদ্ধান্ত।

কণাদ মতের সমালোচনা—শ্রুতিবিরোধ

শাঙ্করভাষ্য—অস্মিন্‌ পক্ষেঽপ্যচেতনং দ্রব্যমাত্রং ব্রহ্মেতি “বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম” (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৩।৯।২৮), “প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম” (ঐতরেয়োপনিষদ, ৫।৩) ইত্যাদ্যাঃ শ্রুতয়ো বাধিতাঃ স্যুঃ।

ব্যাখ্যা—বেদান্তী বললেন, ‘অস্মিন্‌ পক্ষেঽপি অচেতনং দ্রব্যমাত্রং ব্রহ্ম’—সেই পক্ষ স্বীকার করলেও ব্রহ্ম একটি অচেতন, ঘটের মতো নির্গুণ নির্বিশেষ দ্রব্যমাত্র- রূপেই সিদ্ধ হয়। সুতরাং ‘“বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম”, “প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম” ইত্যাদ্যাঃ শ্রুতয়ো বাধিতাঃ স্যুঃ’—“ব্রহ্ম বিজ্ঞান এবং আনন্দস্বরূপ”, “প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম”—এসমস্ত শ্রুতিবাক্য বাধিত হয়ে যায়। অর্থাৎ বৈশেষিক মতানুযায়ী এই শ্রুতিবাক্যগুলি সিদ্ধ হয় না। তার উত্তরে বৈশেষিকগণ বলছেন, আমাকে শ্রুতিবাক্য দিয়ে তুমি পরাস্ত করার চেষ্টা করছ কেন? আমি তো যুক্তির কথা বলছি। বেদান্তী বলছেন, যুক্তি দিয়েও তোমাদের মতের বিরোধ দেখানো যাবে।

কণাদ মতের সমালোচনা—যুক্তিবিরোধ

শাঙ্করভাষ্য—আত্মনো নিরবয়বত্বেন প্রদেশাভাবা- ন্নিত্যসংযুক্তত্বাচ্চ মনসঃ স্মৃত্যুৎপত্তিনিয়মানুপপত্তির- পরিহার্যা স্যাৎ।

ব্যাখ্যা—অগ্নিসংযোগে যেমন ঘটে লাল রং উৎপন্ন হয়, সেইরূপ আত্মা ও মনের সংযোগরূপ অসমবায়ী কারণ থেকে অচেতন আত্মায় চৈতন্য উৎপন্ন হয়—এই কথাটি কেবল শ্রুতিবিরুদ্ধই নয়, যুক্তিবিরুদ্ধও। তাই বলছেন, ‘আত্মনো নিরবয়বত্বেন প্রদেশাভাবাৎ’—আত্মা নিরবয়ব বলে তাঁর কোনো প্রদেশ অর্থাৎ অংশ না থাকায় আত্মার একাংশে মন যুক্ত হবে—একথা বলা যায় না। সাধারণভাবে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সংযোগ হয়; অবয়বের সঙ্গে অবয়বের সংযোগ হয়। যেমন বইয়ের পাতাগুলির সঙ্গে বইয়ের সংযোগ হয়। সাবয়ব বস্তুর মধ্যে একটা সংযোগ হয়, কিন্তু নিরবয়ব হলে তার সংযোগ হতে পারে না। ‘নিত্যসংযুক্তত্বাৎ চ মনসঃ স্মৃত্যুৎপত্তিনিয়মানুপপত্তিঃ অপরিহার্যা স্যাৎ’—আর আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ (সম্বন্ধ) নিত্য বলে অনুভব কাল থেকে ভিন্ন কালে স্মৃতির উৎপত্তির যে-নিয়ম আছে, তা কিছুতেই উপপন্ন হয় না অর্থাৎ রক্ষা পেতে পারে না। অর্থাৎ মন যেহেতু আত্মার সঙ্গে নিত্য সংযুক্ত, সুতরাং তার দ্বারা সর্বদা সকল জ্ঞানই উৎপন্ন হবে। স্মৃতিও একপ্রকার জ্ঞান—তাও সর্বদা উৎপন্ন হবে।

আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ হলে তবে জ্ঞান হয়, অনুভব হয়—এ হলো বৈশেষিকদের মত। আত্মা নিরবয়ব আর মন সাবয়ব। মন নিরবয়ব নয়, কারণ মন সীমিত। আত্মা অসীম এবং সর্বব্যাপী; সুতরাং মনের সঙ্গে আত্মার সংযোগ নিত্য অর্থাৎ মনের সঙ্গে সর্বদাই তাঁর যোগ থাকবে। কারণ, সর্বব্যাপী বস্তুর সঙ্গে সকল বস্তুরই সর্বদা যোগ থাকবে, সম্বন্ধ থাকবে। আর আত্মার এক দেশে সম্বন্ধ হলে অন্য দেশে জ্ঞান হবে না—এই যদি বলা হয়, তাহলেও তা সিদ্ধ হয় না। কারণ আত্মা নিরবয়ব, তাঁর কোনো প্রদেশ নেই। সুতরাং ‘নিত্যসংযুক্তত্বাৎ চ মনসঃ’—মন আত্মার সঙ্গে নিত্যসংযুক্ত বলে ‘স্মৃত্যুৎপত্তিনিয়মানু-পপত্তিঃ অপরিহার্যা স্যাৎ’—স্মৃতির উৎপত্তির যে-নিয়ম আছে তা কিছুতেই উপপন্ন হয় না অর্থাৎ রক্ষা পেতে পারে না। নিয়ম অর্থে শৃঙ্খলা; অর্থাৎ কখনো স্মৃতি হবে, কখনো স্মৃতি হবে না—এইরূপ। বৈশেষিক মত গ্রহণ করলে স্মৃতি সর্বদা থাকবে। কিন্তু সবসময় তো স্মৃতি হচ্ছে না—তা অনুভববিরুদ্ধ। স্মৃতির উৎপত্তি আছে, লয় আছে। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ হলো; সংযোগ হওয়ার পর ইন্দ্রিয় সেই বার্তা মনের কাছে পৌঁছে দিল। এখন মন যদি আত্মার সাথে সংযুক্ত থাকে, তাহলে আত্মাতে জ্ঞান হলো, জ্ঞানের উৎপত্তি হলো। এখন যদি আত্মা সর্বব্যাপী হয় তাহলে আত্ম-মনঃসংযোগ তো নিত্য রয়েছে। সুতরাং সেইক্ষেত্রে স্মৃতির উৎপত্তি কখন হবে আর কখন হবে না—এর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম থাকতে পারে না। অতএব ব্যবহার অসম্ভব হয়। এই হলো অনুপপত্তি বা অযৌক্তিকতা। বৈশেষিক মত স্বীকার করলে এই দোষ অপরিহার্য অর্থাৎ পরিহারের উপায় নেই।

কণাদ-মতে আত্মার সংসর্গধর্মিত্ব—অশাস্ত্রীয় কল্পনাপ্রসঙ্গ

শাঙ্করভাষ্য—সংসর্গধর্মিত্বং চাত্মনঃ শ্রুতিস্মৃতি- ন্যায়বিরুদ্ধং কল্পিতং স্যাৎ। “অসঙ্গ ন হি সজ্জতে” (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৩।৯।২৬; ৪।৪।২২), “অসক্তং সর্বভৃৎ” (গীতা, ১৩।১৫) ইতি হি শ্রুতিস্মৃতী।

ব্যাখ্যা—[আত্মার সর্বগতত্বের অর্থ সর্ববস্তু ও আত্মার মধ্যে ব্যবধানরাহিত্য মাত্র; সর্বগতত্বের এরূপ অর্থ নয় যে, আত্মা সর্ববস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত—এই কথাই বলছেন—] ‘সংসর্গধর্মিত্বং চ আত্মনঃ শ্রুতিস্মৃতিন্যায়বিরুদ্ধং কল্পিতং স্যাৎ’—অধিকন্তু মনের সঙ্গে আত্মার সংযোগ হয় বললে শ্রুতি-স্মৃতি-ন্যায়বিরুদ্ধ আত্মার এই যে সংসর্গধর্মিতা, তা কল্পিত হয়ে পড়বে। সংসর্গধর্মী মানে—সংসর্গ যার ধর্ম হয়েছে। আত্মার সঙ্গে মনের সংসর্গ হয়, সুতরাং আত্মা হলো সংসর্গধর্মী। আত্মার এই যে সংসর্গধর্মিতা, তা শ্রুতি-স্মৃতি-ন্যায়বিরুদ্ধ। কারণ শ্রুতি বলছেন—“অসঙ্গ ন হি সজ্জতে”—আত্মা অসঙ্গ যেহেতু তিনি কোথাও সম্বদ্ধ হন না। স্মৃতিতে রয়েছে—“অসক্ত সর্বভৃৎ”—আত্মা অসম্বদ্ধ অথচ সকল বস্তুকে ধারণ করে আছেন। এইভাবে শ্রুতি-স্মৃতির বিরোধ দেখাচ্ছেন।

কণাদ-মতের সমালোচনা—ন্যায়বিরোধ

শাঙ্করভাষ্য—ন্যায়শ্চ—গুণবদ্‌ গুণবতা সংসৃজ্যতে, নাতুল্যজাতীয়ম্‌। অতো নির্গুণং নির্বিশেষং সর্ববিলক্ষণং কেনচিদপি অতুল্যজাতীয়েন সংসৃজ্যতে ইত্যেতৎ ন্যায়বিরুদ্ধং ভবেৎ।

ব্যাখ্যা—‘ন্যায়ঃ চ গুণবৎ গুণবতা সংসৃজ্যতে ন অতুল্য জাতীয়ম্‌’—ন্যায়বিরোধ কোথায় হচ্ছে তা দেখাতে গিয়ে বলছেন, গুণবান বা গুণবিশিষ্ট বস্তুর সঙ্গে গুণবান বা গুণবিশিষ্ট বস্তুরই সংযোগ হয় অর্থাৎ তুল্যজাতীয় বস্তুরই সংযোগ হয়, অতুল্যজাতীয় বস্তুর সংযোগ হয় না। দুটি কপাল সংযোগে ঘট হয়। কপাল মানে ঘটের অর্ধেক। কপাল দুটি সাবয়ব বস্তু। ‘অতঃ নির্গুণং নির্বিশেষং সর্ববিলক্ষণম্‌’—অতএব এই যে নির্গুণ নির্বিশেষ, সকল বস্তু থেকে বিলক্ষণ অর্থাৎ ভিন্ন যে-বস্তুটি, সেটি ‘কেনচিৎ অপি অতুল্যজাতীয়েন সংসৃজ্যতে’—সেজাতীয় নয় এমন কোনো বস্তুর সংযোগ হবে, সংসর্গ হবে ‘ইতি এতৎ ন্যায়বিরুদ্ধং ভবেৎ’—তা যুক্তিবিরুদ্ধ কথা। অর্থাৎ নির্গুণ নির্বিশেষ আত্মার সগুণ বস্তুর সঙ্গে যুক্ত হওয়া স্বীকার করলে তা যুক্তিবিরুদ্ধ হয়। [সমাপ্ত] 

পূজ্যপাদ মহারাজের এই আলোচনাটি সম্প্রতি উদ্বোধন কার্যালয় থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। মহারাজের পরবর্তী পর্ব-সহ পুরো আলোচনাটি ঐ গ্রন্থেই পাবেন। তাই এখানেই এটি সমাপ্ত হলো।