কলেজ জীবন থেকে পেশাদার থিয়েটার দেখার প্রচুর সুযোগ হয়েছে। বারবার একটা জিনিস খেয়াল করেছি যে, প্রতিটি পেশাদার মঞ্চে শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধিস্থ ছবিটির উজ্জ্বল উপস্থিতি। পরে জেনেছি, বাংলা পেশাদার থিয়েটারের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণের কী বিশাল অবদান আর গুরুত্ব। সেই উনিশ শতকের কলকাতায় ‘বঙ্গের শেক্সপীয়র’ গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাত ধরে সর্বসাধারণের জন্য বাংলা পেশাদার রঙ্গালয়ের প্রকৃতপক্ষে বেড়ে ওঠা—যার সূচনা হয়েছিল ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে।

সেসময় সামাজিকভাবে থিয়েটার করার বাধা ছিল প্রচুর। থিয়েটারে স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয় করত পুরুষেরা। গিরিশবাবু সেই ‘থ্যাটার’ করাতে রঙ্গালয়ে নারীচরিত্রের অভিনয়ের জন্য বারবনিতাদের নিয়ে এসেছিলেন। ফলত সেসময়ের রক্ষণশীল নীতিবাগীশ হিন্দু সমাজ, বিদ্বজ্জনেরা তার বিরুদ্ধে রে রে করে উঠেছিল। চারিদিকে নিন্দে-মন্দের শোরগোল উঠেছিল। বস্তুতপক্ষে, ব্রিটিশ-শাসিত বঙ্গসমাজ সেদিন রাজনৈতিক পরাধীনতার গ্লানি ভুলতে তমসাচ্ছন্ন সংস্কার, মানবিক ধর্মবিবর্জিত আচার-বিচারকেই আত্মগরিমার বিষয় ঠাউরে শ্লাঘা বোধ করত। সেসময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্ত-মিত্র সমভিব্যাহারে ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে ১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আসেন গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে। এসে সবার সঙ্গে বসে অভিনয় দেখে করতালি দিলেন, আনন্দাশ্রু বিসর্জন করলেন, অভিনয় শেষে শ্রীচৈতন্যরূপী বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে বললেন—‘চৈতন্য হোক’। সেইদিনই বঙ্গসমাজের নাট্যবিরোধিতার বিষদাঁতটির গোড়া নড়ে গিয়েছিল। সূচিত হয়েছিল থিয়েটারের কৌলিন্যের নতুন অধ্যায়। সেদিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ থিয়েটারের বুকে সত্য-শিব-সুন্দরের যে-সিলমোহরটি এঁকে দিয়েছিলেন, আজও তার গৌরব বাংলা নাট্যের অক্ষয় পুঁজি। বাংলা নাট্যের দৈনন্দিন চর্চায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঐদিন থেকে হলেন আমাদের সঙ্গী। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা থিয়েটারের সেদিন বিশেষ দরকার ছিল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের। আর আজ ঠাকুরের পদাশ্রিত সেই সাধারণ রঙ্গালয় বাংলায় নেই, তবুও বাঙালির অবলুপ্ত সাধারণ রঙ্গালয়ের সার্ধশতবর্ষে আমার দেখা সেই উজ্জ্বল অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির কথা কিছু বলব।

দুই

আমরা যখন কলেজে পড়ছি তখন কলকাতায় স্টার, রঙমহল, রঙ্গনা, নাট্যনিকেতন প্রভৃতি হল জমিয়ে চলছে। স্টার বলতে আমরা তখন জানতাম ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্যা বিনোদিনী দাসীর কথা—যিনি নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন এই থিয়েটার-গৃহটির জন্য। এর জন্য তাঁকে আশ্রিত হতে হয়েছিল গূর্মুখ রায়ের—যিনি ভেবেছিলেন থিয়েটারটির নাম হবে তাঁর নামে—‘বি থিয়েটার’। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা হয়নি। বাগবাজারের কীর্তিচন্দ্র মিত্রের ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটের খালি জমি ইজারা নিয়ে গূর্মুখ রায়ের অর্থে এবং গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র প্রমুখের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছিল ‘স্টার থিয়েটার’। বাড়িটির উদ্বোধন হয়েছিল ১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই মহাসমারোহে। তারপর থেকে নানান স্থান বদল করে একশো বছর অতিক্রম করে ‘স্টার থিয়েটার’ নামটি আজও বর্তমান রয়েছে। তবে আজকের স্টার থিয়েটারে পেশাদার থিয়েটার নেই, এখন কেবল চলচ্চিত্রের প্রদর্শন হয়।

স্কটিশ চার্চ কলেজ পেরিয়ে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলাম, তখন আমার বন্ধু অতনু আমাকে একদিন তার মামা সলিল মিত্রের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন স্টার থিয়েটারের মালিক। তিনি আমাদের দুজনকে সব থিয়েটার দেখার অনুমতি দিয়ে পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে বহু থিয়েটার দেখেছি—একেবারে বক্সে বসে। সেদিন প্রথম আলাপ হয়েছিল দেবনারায়ণ গুপ্তের সঙ্গে। আমি পরে দেবনারায়ণবাবুর একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যা ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আশ্চর্যভাবে ১৯৯১ সালে আমি যেদিন ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম, তার আগের দিন স্টার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। আমায় দেখে দেবনারায়ণবাবু হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেদিন বুঝেছিলাম চোখের সামনে একটা স্বপ্ন শেষ হয়ে যাওয়ার কী কষ্ট!

স্টারের এই পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার পেশাদার রঙ্গালয়ের অভিনয়ের ধারা বন্ধই হয়ে গেছে। বিশ্বরূপা, রঙমহল, মিনার্ভা, প্রতাপ মেমোরিয়াল, সুজাতা সদন, কাশী বিশ্বনাথ সব তখন বন্ধ।

আমি দেবনারায়ণবাবুর থেকে শুনেছিলাম, সেসময় সবকটা থিয়েটার মিলে ওঁরা একটা কাগজ বের করতেন। কাগজটার নাম মনে নেই, বয়সের কারণে ইদানিং স্মৃতি ঠিক কাজ করে না। সে-কাগজ হাওড়া শিয়ালদায় বিক্রি হতো। আমি সেসব কাগজ দেখেছি। তাতে কী না আলোচনা থাকত! দেশি-বিদেশি থিয়েটারের সংবাদের পাশাপাশি বাংলার থিয়েটারের নানান হাল-হকিকত। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ঐ পত্রিকাটির সম্পাদনা করেছিলেন। ঐদিনের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল সেইসমস্ত কাগজের সংরক্ষিত কপি, তাঁর নিজের বহু নাটকের পাণ্ডুলিপির মতো মূল্যবান নানান সম্পদ। তবুও আমাদের ঐসময় স্টার থিয়েটার ছিল আর সবার থেকে আলাদা।

পুরানো স্টার থিয়েটার ৬৮ নং বিডন স্ট্রিট

স্টার থিয়েটারের সুনাম ছিল দৃশ্যপট রচনায়। ঐরকম নিখুঁতভাবে দৃশ্যপট রচনা আমি এদেশে কেন, বিদেশেও দেখিনি। অতখানি যত্ন নিয়ে রঙ্গনা, রঙমহল, বিশ্বরূপা বা অন্য মঞ্চগুলোও করত না। দেবনারায়ণবাবু মূলত শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাস নিয়ে নাটক করতেন, সেজন্য দৃশ্যপট হতো রিয়েলিস্টিক। মনে আছে, মনোজ বসুর লেখা ‘বৃষ্টি-বৃষ্টি’ কাহিনি অবলম্বনে নাট্যরূপ ‘ডাকবাংলো’ নাটক স্টারে দেখেছিলাম। ছবি বিশ্বাস অভিনয় করেছিলেন। স্টেজে ছবিবাবুর বাবার ছবি টাঙানো থাকত আর গভীর রাতে সেই প্রয়াত বাবা এসে ছবির মাধ্যমে কথা বলত। শুনেছি, ঐ দৃশ্যটি প্রতিপাদ্য করার জন্য ওঁরা পি. সি. সরকারের সাহায্য নিয়েছিলেন। সমস্ত দর্শক ঐ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেত।
স্টারের ‘শ্রীকান্ত’ নাটকেও দেখেছি কী অপূর্ব মঞ্চ পরিকল্পনা ও আলোক নিয়ন্ত্রণ। মঞ্চের মধ্যে দেখানো হয়েছিল ইন্দ্রনাথের নিশীথ অভিযানের সময় জলের ওপর নৌকা চালানো, নতুনদার জলে ঝাঁপিয়ে পড়া, শাহজীর সাপের ঝাঁপি, সাপ। মনে আছে, শরৎচন্দ্রের রচনায় ঠিক যেমন লেখা রয়েছে, দেবনারায়ণবাবু ঠিক সেইরকম করতেন।

স্টার থিয়েটারে একবার ঠাকুরকে নিয়ে একটা থিয়েটার হয়েছিল, সেটা আমার একদমই ভাল লাগেনি। সেটা খুব রিয়েলিস্টিক হয়েছিল। তবে কালিকা থিয়েটারে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী নিয়ে তারক মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘যুগদেবতা’ নাটকটি শুনেছি খুব জনসমাদার পেয়েছিল। নাট্যের প্রয়োগকলায় সেটি অনন্য ছিল—কয়েকটি জায়গায় বৃষ্টি, কালীমূর্তির অঙ্গ থেকে জ্যোতি-বিকিরণ ইত্যাদি নানান অলৌকিক দৃশ্য দেখিয়েছিল।

সাধারণ রঙ্গালয় নিয়ে এরকম কত বর্ণময় স্মৃতি আছে! এর মধ্যে উত্তমকুমারের স্মৃতিটা খুব মনোগ্রাহী। স্টারে ১৯৫৩ সালের ১৫ অক্টোবর নিরুপমা দেবীর ‘শ্যামলী’ মঞ্চস্থ হয়েছিল দেবনারায়ণবাবুর নাট্যরূপে। অসামান্য প্রোডাকশন হয়েছিল ‘শ্যামলী’। স্টারে অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সরযূ দেবী, জহর গাঙ্গুলি, অনুপকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ দিকপালেরা। মনে আছে, মঞ্চে উত্তমকুমার এসেছেন নাটক শুরু হওয়ার দশ-পনেরো মিনিট পর—যখন তাঁকে দেখতে না পেয়ে লোকেরা বিরক্ত। উত্তমকুমার এসে জল খেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, জল নিয়ে আসেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়—যিনি টানা আড়াই ঘণ্টা বোবা মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। সে জল নিয়ে এসে দাঁড়ায়, উত্তমবাবু গ্লাসে চুমুক দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকান আর জল খেতে খেতে যেন বুঝতে চান মেয়েটি কী বলবে, আর মেয়েটি যেন কত কিছু বলতে চায় তার না বলা ভাষায়! উত্তমকুমার আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ঐ মুহূর্তটা কোনোদিনও ভুলব না। উত্তমকুমারের অচঞ্চল দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখা, অপরদিকে সাবিত্রীর দৃষ্টিতে মৌমাছির চঞ্চলতা—অভিনয়ের এত ডিটেলিং আর কোথাও আজ পর্যন্ত দেখলাম না।

স্টার থিয়েটারে খুব ভাল ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বলতে হয় তুলসী চক্রবর্তীর কথা, যার সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন—উনি যদি আমেরিকায় জন্মাতেন তাহলে অস্কার পেতেন গোটা কতক। মনে আছে, কোনো একটা নাটকে তুলসী চক্রবর্তী সৈনিকের চরিত্রে অভিনয় করছেন। মঞ্চে সেদিন কোনো কারণে জুতো পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি সেদিন নিজের খালি-পায়ে জুতো মোজা এঁকে এমনভাবে হেঁটেছিলেন যে, কেউ বুঝতেই পারেনি—ওঁর পায়ে জুতো ছিল না। আরেকটি নাটক ‘রাজলক্ষ্মী’তে বিরতির পরের দৃেশ্য অভিনেত্রী ঢোকার কথা ছিল। তিনি না ঢোকাতে দর্শকেরা অস্থির। তখন পরিচালক দেবনারায়ণবাবু তুলসীবাবুকে ঢুকতে অনুরোধ করেন। উনি ঢুকে হ্যারিকেন নিয়ে মঞ্চে টানা আট-দশ মিনিট বাজনার তালে তালে হ্যারিকেনের শিখা কমাতে-বাড়াতে থাকেন তাতেই দর্শকরা হেসে আকুল; তারা বুঝতেই পারছে না যে, তিনি সময়টা ম্যানেজ করছেন! এইরকম সব ক্ষমতা ছিল তুলসীবাবুর। প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয়ে তিনি ছিলেন অনন্য।

তিন

আজ আমাদের কাছে যেসব গল্প বলে মনে হচ্ছে, সেটাই এই কিছু দিন আগেও ছিল জীবন্ত! স্বাধীনতার পর কলকাতার রঙ্গালয়গুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। একদিকে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা আর অন্যদিকে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার ধাক্কা সামলে কোনোভাবে টিকেছিল। ঐ দুঃসময়ের কথা দেবনারায়ণবাবু বলেছিলেন মনে আছে। তবে সেই সময়েও রঙমহলে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট মঞ্চস্থ হয়েছিল শচীন সেনগুপ্তের ‘বাংলার প্রতাপ’ আর ২০ ডিসেম্বর মিনার্ভায় হয়েছিল শচীন সেনগুপ্তের ‘কালো টাকা’ নাটক—যেখানে স্বাধীনতা-উত্তর কালোবাজারির ছবি কিংবা দেশাত্মবোধ আসলে কী সেই সচেতন দিকগুলোকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছিল এই নাটকগুলি।

সেসময় প্রতি সন্ধ্যায় বিভিন্ন জেলার মফস্‌সল ও গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ আসত পেশাদার থিয়েটার দেখতে। আগে থেকে এসে হলের বাইরে শুয়ে থাকত। টিকিট ব্ল্যাক হতো—দশ আনার টিকিট এক টাকা দামেও বিক্রি হয়েছে। পার্টিশনের পরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়। মনে আছে, গ্রুপ থিয়েটারের নানান দল যখন গ্রামে গ্রামে গিয়ে অভিনয় করতে শুরু করল, তখন দেবনারায়ণবাবুরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাঁদের বক্তব্য ছিল—যদি গ্রামে গ্রামে গিয়ে থিয়েটার করা হয় তাহলে শহরের থিয়েটারটা বাঁচবে কী করে? কিন্তু সে-কথায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি।

দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর পাশাপাশি এই দুটো থিয়েটার চলেছে। অনেক শিল্পী এসেছেন দুই থিয়েটার থেকে। দুটো থিয়েটারে টিকিট বিক্রির কোনো কমতি ছিল না। বিশ্বরূপা, একাডেমি, মিনার্ভায় বা সেসময়ের ছোটদের থিয়েটারের টিকিটের কোনো কম বিক্রি ছিল না! সমারোহে চলেছে এইসব থিয়েটার। তবে দুটি থিয়েটার জনপ্রিয় ছিল একইসঙ্গে। হৈ হৈ করে থিয়েটার দেখেছে মানুষ। সেসময় মানুষের থিয়েটার দেখার একটা আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিল বাণিজ্যিক থিয়েটার। নব্বইয়ের দশকে আমিও রঙ্গনায় করেছিলাম ‘দম্পতি’ নাটক। ভাল চলেছিল।

পেশাদার থিয়েটারের অবক্ষয়ে অনেকে গ্রুপ থিয়েটারকে দায়ী করেন বটে কিন্তু এটাও ঠিক যে, গ্রুপ থিয়েটার যারা করত বা দেখত, তারা কিন্তু পেশাদার থিয়েটারও দেখত—যেমন আমরা দেখেছি। দেখেছি এই কারণে যে, এখানে যাঁরা কাজ করতেন তাঁরা তো কেউ অজ্ঞ বা মূর্খ ছিলেন না, তাঁরা প্রত্যেকে কাজটা মন দিয়ে করতেন। এমন অনেক বিষয় ছিল, যেগুলো লোককে টানত। যেমন, কোনো একটা নাটকে উত্তমকুমার যদি অভিনয় করেন, তাহলে সেটা কী বিষয়ে তা না দেখেই মানুষ আসত। স্টার থিয়েটারে কী সাংঘাতিক ভিড় হতো!

আমরা বারবার দেখেছি পেশাদার থিয়েটার ও গ্রুপ থিয়েটারের মধ্যে একটা সংযোগ। গ্রুপ থিয়েটারের অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী পেশাদার থিয়েটারে কাজ করেছেন; যেমন—তৃপ্তি মিত্র একইসঙ্গে বহুরূপী থেকে ‘রক্তকরবী’ আর বিশ্বরূপায় করছেন ‘সেতু’ নাটক।

তবে তার পরেও একশ্রেণির গ্রুপ থিয়েটারের কর্মী পেশাদার থিয়েটারকে হেয় করেছে, ছোট করেছে। পেশাদার থিয়েটারকে সাধারণ দর্শকের মনোরঞ্জনের উপযোগী নানান উপাদান আনতে হয়েছে। একটা কথা কী, আমাদের দেশ এমন এমন সময়ের ভিতর দিয়ে গেছে যেখানে, মানুষের প‌ক্ষে শি‌ক্ষা-গ্রহণ সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পার্টিশনের পরে সত্যিই মানুষ এত সহ্য করেছে যে, লেখাপড়া করছে কী করছে না তার ওপর সবসময় তাদের রুচি নির্ভর করত না। বিপর্যস্ত একটা অর্থনৈতিক অবস্থা ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে মানুষ কী করবে?

মানুষের এই ভাল লাগা, মন্দ লাগা—সব তো পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। একটা ঠাণ্ডাঘরে শান্ত অবস্থায় কিছু দেখা আর রোদ্দুরের মধ্যে বা বর্ষার মধ্যে দেখার তো ফারাক থাকবেই। এটা তো আছেই। পার্টিশনের পরে দেশটা একেবারে তছনছ আর ছারখার হয়েছে সবরকমভাবে। মানুষ ছোটাছুটি করেছে প্রতিনিয়ত। চেষ্টা করেছে ভাল জায়গায় পৌঁছানোর—সেটা তার জীবনযাত্রায় হোক বা লেখাপড়ায় বা বিনোদনের জন্য—সবরকমভাবেই তারা ভাল একটা কিছু করার বা ভাবার চেষ্টা করেছে। কোথায় গেলে সে একটা ভাল জায়গা পাবে সেই নিয়ে সে বেশি চিন্তিত হয়েছে প্রতিনিয়ত। তখনকার ইতিহাস আর সংকট আজকের মানুষকে বলে বোঝানো যাবে না। তাই সেসময় দেখেছি, জনরুচির কথা ভেবে পেশাদার থিয়েটারে এসেছে সস্তার নানান উপকরণ।

এই সংকটের পরিস্থিতিতে পেশাদার থিয়েটারের সচেতন দর্শক গ্রুপ থিয়েটারের দিকে গেছে—এটা সত্য, কিন্তু সেটা যে কেবল রুচির তফাতে তা নয়। এটা ঠিক যে, পেশাদার থিয়েটার জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল, আমোদন আর বিনোদনের মধ্যে থিয়েটার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিল; কিন্তু কেবলমাত্র সেই কারণেই পেশাদার থিয়েটার দর্শকশূন্য হয়েছে তা নয়। আবার এটাও সত্য, পেশাদার থিয়েটারের দর্শক যখন তাদের থিয়েটার থেকে বেরিয়ে গ্রুপ থিয়েটার দেখেছে, তখন তাদের আরো ভাল লেগেছে। ভাল লেগেছে এই কারণে যে, একটা নাটক যদি শিক্ষণীয় হয় সেখানে লেখাপড়া-জানা দর্শক যাবে—এটাই স্বাভাবিক। রুচিবোধ তৈরি হলে কখনো কখনো মনে হবে—গ্রুপ থিয়েটারটাই হোক, আবার কখনো কখনো মনে হবে—পেশাদার থিয়েটারটাই হোক।

চার

পেশাদার থিয়েটার আমাদের এখানে একসময় খুব হেয় হয়েছে—এটা ঠিক, কিন্তু দেখা যায় বাইরের দেশে পেশাদার থিয়েটারটাই হয়, গ্রুপ থিয়েটারকে হেয় করে। যারা গ্রুপ থিয়েটার করে, তাদের সম্পর্কে অন্য দেশের পেশাদার থিয়েটারের লোকেরা বলে—ওদের টাকা-পয়সা নেই, শুধু ইচ্ছেটা আছে; তাই যা খুশি করে। পেশাদার থিয়েটার চাইলে অনেককিছু করতে পারে। হয়তো একজন ভাল অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে অন্য দেশ থেকে নিয়ে এল বা দরকারে একটা বড় প্রাসাদের সেট তৈরি করে ফেলল। জীবনকে একটা বড় পরিসরে দেখানোর ক্ষমতা পেশাদার থিয়েটারের রয়েছে।

২০০১ সাল থেকে পরপর তিন বছর আমি কানাডায় গেছি মূলত নাটক করতে, নাটক শেখাতে এবং নাটক শিখতে। সঙ্গে থেকেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর বিভাস চক্রবর্তী। সেখানে আমরা প্রতিবারই দেখেছি, দেশবাসীর কী অপরিসীম ভালবাসা থিয়েটারের প্রতি! সারা বছরের মধ্যে গরমের কয়েকটা মাস স্ট্যাটফোর্ড গ্রামে সারাদেশের থিয়েটার-প্রেমী মানুষ এসে মিলিত হয়। সেখানে একটি গ্রামের মধ্যে সাতটি মঞ্চ আছে। দর্শকপূর্ণ প্রত্যেকটি মঞ্চে নাট্যাভিনয় হয়। সার্বিকভাবে মানুষের মধ্যে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি।

অন্যদিকে আমাদের এখানে পেশাদার থিয়েটারের প্রতি সেই ভালবাসাটার অভাব বারবার অনুভব করেছি। আমি এমনও দেখেছি, একটা কুশলী লোক যেই মুহূর্তে ঐ থিয়েটারে গেছে, সে কীরকম যেন হয়ে গেছে! তারা মনে করত না যে, তার কোনো দায়িত্ব আছে। এবং এরা কেউই এই থিয়েটারকে কোনোদিন ভালবাসেনি।

এবিষয়ে ব্যতিক্রমী মানুষ উৎপল দত্ত। তাঁর ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে এই কথাগুলো উঠে এসেছে। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে খুব ভালবাসতেন। শুটিং বা অন্য যেকোনো জায়গায় দেখা হলেই বলতেন—লিখুন লিখুন। আমি একসময় ভোরবেলায় স্টুডিওতে গিয়ে লিখতাম। মাঝে মাঝে শট দিয়ে এসে দেখতাম—ব্যাগ খোলা। অন্যের থেকে জেনেছি, উৎপলদা আমার নতুন লেখা পড়ে ফেলেছেন। যে-কদিন আমি রঙ্গনায় থিয়েটার করছিলাম, সেসময় পাঁচটা যদি বেজে যেত আর আমার শট থাকত, তাহলে উনি নিজে আমাকে বলতেন—যাও। অন্যরা বাধা দিলে বলতেন : “ওকে তো যেতে হবে, ওর থিয়েটার আছে!” সত্যি, আমি সারাজীবনে দেখেছি, ওরকম ভালবাসার মানুষ বিশেষ নেই—যাকে ভালবাসা যায়। পেশাদার থিয়েটারের আদর্শ মানুষ ছিলেন উৎপল দত্ত, যিনি প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায়িকভাবে সাধারণ রঙ্গালয়কে সাধারণের করতে পেরেছিলেন।

কিন্তু আজ সার্ধশতবর্ষে এসে সেই ঠাকুরের পদস্পর্শে ধন্য থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল! দেবনারায়ণবাবু শেষের দিকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগে পুরানো দিনের থিয়েটার নিয়ে ক্লাস নিতে আসতেন। দুঃখ করতেন এই এক এক করে বন্ধ হয়ে যাওয়া থিয়েটারগুলো নিয়ে।

বলতে দ্বিধা নেই, আজকের গ্রুপ থিয়েটারেও আমি এই ভালবাসার অভাব খুব লক্ষ্য করি। অনেকেই জানে না কীভাবে থিয়েটারকে ভালবাসতে হয়, অনেকেই জানে না থিয়েটারের দায়িত্ব-কর্তব্য কী! যেকোনো থিয়েটারে ভালবাসাটাই একমাত্র ফ্যাক্টার হতে পারে। তা নাহলে একদিন এই থিয়েটারও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। ঠাকুরের নির্দেশিত ‘লোকশিক্ষা’ দেওয়ার আরো একটা পাঠশালা বন্ধ হয়ে যাবে!

এটা খুবই দুঃখের, আমরা থিয়েটারের সমবয়সি লোকেরা যখন একসাথে বসি, তখন সবারই মনে হয়—আমাদের প্রত্যেকের বিমাতৃসুলভ ব্যবহারে বা পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের গৌরব হারিয়ে বসেছি! কাউকে ব্যক্তিগতভাবে দোষ দিচ্ছি না, কিন্তু আমরা প্রত্যেকে আমাদের গৌরব হারিয়েছি এবং এর জন্য আমাদের বিবেক কোথাও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আমাদের শুধুমাত্র ভালবেসে কাজ করার ইচ্ছেটা ধ্বংস হয়েছে।

আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সেটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে—অন্তত চেষ্টা করতে হবে। সেটা ফিরিয়ে আনা মানে লেখাপড়ার কথা বলছি না, বলতে চাইছি—আমাদের এই বিমাতৃসুলভ ব্যবহার পালটাতে হবে, এটিকে মূল্যবান বলে ভাবতে হবে। থিয়েটারের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমাদের চেষ্টা করতে হবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শধন্য ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার। তাই হবে প্রকৃতপ‌ক্ষে সকলের চেতনার উন্মেষের প্রমাণ।

‘স্বামী গম্ভীরানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।

নাট্যকার, প্রাক্তন অধ্যাপক,
নাটক বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়