একদিন বিরজানন্দজী সেবককে বড়ই গালাগালি দিলেন—কারণে, বিনা কারণে। সেবক একটিও প্রতিবাদ না করিয়া দীর্ঘক্ষণ ধরিয়া নীরবে ঐ গালাগাল শুনিল। পরে তখনকার মতো কার্যান্তরে যাইবার সময় কেবল বলিল : “মহারাজ, আমি ঠিক ঠিক মতো সেবা করিবার চেষ্টা করিব।” সেবক চলিয়া গেলে অপর সেবকের নিকট তৎক্ষণাৎ একগাল হাসিয়া মহারাজ বলিলেন : “এত যে গালমন্দ করিলাম—এর উপর কোনো কাজই হইল না!”
যাহা হউক, মহারাজের সম্বন্ধে অন্য সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার মহারাজ মঠ হইতে কলিকাতায় যাইতেছেন। বড় কানাই মহারাজকে রাজা মহারাজ বলিয়া দিলেন : “কালীকৃষ্ণকে বল, অমুক লোকের সঙ্গে যেন অবশ্য দেখা করিয়া আসে।” কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিবামাত্র রাজা মহারাজ বলিলেন : “হ্যাঁরে, অমুকের সঙ্গে দেখা করিয়া আসিয়াছিস?” বিরজানন্দজী অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন : “না।” আর যাইবে কোথায়! রাজা মহারাজ এত ক্রুদ্ধ হইলেন, কত যে গালিবর্ষণ করিলেন তাহার অবধি নাই! মহারাজ নীরবে একটুও উচ্চবাচ্য না করিয়া সমস্ত শুনিলেন এবং রাজা মহারাজ নীরব হইলে ধীরে ধীরে আপনার ঘরে গিয়া তামাক সাজিবেন বলিয়া টিকা ধরাইলেন। এদিকে রাজা মহারাজের মনে হইল, ছেলেটা একটা কথাও বলিল না? তবে কি কানাই উহাকে কিছুই বলে নাই? তখনি কানাই মহারাজকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন : “উহাকে ঐ কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি।” রাজা মহারাজ অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া বলিলেন : “ডাক, ডাক, কালীকৃষ্ণকে ডাক।” তামাকু সেবনে উদ্যত বিরজানন্দজী রাজা মহারাজের নিকট আসিতেই, তিনি তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কত অনুনয়-বিনয়ের দ্বারা অযথা গালিগালাজ করিয়াছেন বলিয়া দুঃখ করিতে লাগিলেন। রাজা মহারাজের এই ভাবটি পূজনীয় কালীকৃষ্ণ মহারাজ খুব আয়ত্ত করিয়াছিলেন মনে হয়, অর্থাৎ যে-ব্যক্তি ক্রোধের সঙ্গে কথা কাটাকাটি না করিয়া অযথা অপমান সহ্য করিয়া নিঃশব্দ থাকে, তাহার বড় উচ্চস্থান।
কালীকৃষ্ণ মহারাজ নিখুঁত শিল্পী—গোছগাছ তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ। মাছ খাইয়া কাঁটাগুলি এমন সুন্দর করিয়া রাখিতেন যেন দেখিতে ইচ্ছা হইত! রাগিতেন—সেও কী অপূর্ব সুন্দর! কাহাকেও কটুকাটব্য করিতেছেন কিংবা কাহারও সহিত তর্কাতর্কি হইতেছে—মহারাজের মুখ, চোখ, শরীর এক অপূর্ব বিস্ময়জনক গম্ভীরভাবে পূর্ণ হইত। আলুথালু হইয়া সাজসজ্জাবিহীন অবস্থাতেও তাঁহাকে যেমন সুন্দর দেখাইত, রাজবেশে ভূষিত করিয়া ভক্তদের দর্শনের জন্য তাঁহাকে বসাইয়া দিলে সেও সমান সুন্দর।
মনোভাব গোপনে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বাহ্য ব্যবহারের দ্বারা তাঁহার অন্তরের খবর সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ছিল। তবে তিনি অন্তরে বাহিরে স্বভাবতই হৃদয়বান ও অতীব কোমল ছিলেন। একদিন সংঘের কোনো উচ্চস্থানীয় মান্যগণ্য ব্যক্তির সহিত খুব তর্কাতর্কি হইতেছে—মুখচোখ লাল হইয়া গিয়াছে, তখন তাঁহার সহিত অন্য কথা বলা অসম্ভব। কিন্তু ঔষধ খাওয়ানোর সময় হইয়াছে। সেবক ধীরে ধীরে বলিল : “মহারাজ, ঔষধ খান।” মুহূর্তমধ্যে তাঁহার মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইল। সেই সুপ্রসন্ন শান্তভাব, কণ্ঠস্বরে চিরপরিচিত কোমলতা! ঔষধ খাইলেন। অত বড় উত্তেজনার অনন্তর নিমেষের মধ্যে শান্ত ও কোমল হইয়া যাওয়া সাধারণের পক্ষে অসম্ভব তো বটেই, না দেখিলে ইহা যে সম্ভব তাহা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য।
তিনি কত সহৃদয় ছিলেন, তাহা তাঁহার নিকট শ্যামলাতাল আশ্রমে যাঁহারা দুই-এক দিনের জন্যও বাস করিয়াছেন, তাঁহারা মুক্তকণ্ঠে বলিবেন। সকলের সহিত সমান হইয়া যাওয়া, কাহাকেও ক্ষুদ্র মনে না করা—এটি তাঁহার সহজাত দৈবীসম্পদ। একটি ছোকরা সাধু পরিশ্রান্ত হইয়া শ্যামলাতাল আশ্রমে আসিয়াছেন। পায়ের খানিকাংশ ফুলিয়া গিয়াছে। আশ্রমে চাকরবাকর ছিল, অন্য সাধু-সেবকও ছিল, কিন্তু ঐ ছোকরা সাধুটি দেখিলেন—মহারাজ একটিন গরমজল স্বয়ং আনিয়া বলিতেছেন : “ইহার মধ্যে পা ডুবাইয়া কিছুক্ষণ রাখ।” একদিন ছোকরা সাধুটি বলেন : “খুব ভোরে স্থানান্তরে যাইব।” মহারাজ বলিলেন : “কী খাইয়া যাইবে?” সে বলিল : “অত সকালে আর কি খাওয়ার দরকার?” মহারাজ কিছু বলিলেন না। অতি প্রত্যুষে আসিয়া মহারাজ বলিতেছেন : “দেখ কুকারে বসানো আছে, গরম গরম খাইয়া যাও।” সাধুটি তো অবাক! সব মহারাজ স্বয়ংই করিয়াছেন, ইহা বলা বাহুল্য।
আমি এবং আরেকটি সাধু আশ্রম হইতে অনেক দূরে এক তীর্থে যাইব। মহারাজ যাইবার সময় চাল, ডাল প্রভৃতি দিয়া বলিলেন : “এইসব রহিল, কষ্ট করিও না। রান্না করিয়া খাইও।” আমাদের মধ্যে একজন খুঁতখুঁত করিতে লাগিল, বলিল : “মহারাজ, ইহা বড় কম, ইহাতে পেট ভরিবে না” ইত্যাদি। মহারাজ বলিলেন : “আচ্ছা, ফিরিয়া আসিয়া আমাকে বলিবে কম হইল কিনা।” তীর্থে গিয়া যথাসময়ে রান্না করিয়া খাইলাম—একটুকুও কম হয় নাই, বেশিও হয় নাই! ফিরিয়া তাঁহাকে যখন বলা হইল, তিনি একটু হাসিলেন এবং বলিলেন : “দেখিলে তো!”
মহারাজ আম প্রভৃতি ফল অনেকদিন রাখিতেন। কতকগুলি পচিয়াও যাইত। ভালগুলি সেবকদের দিতেন—এটি অমুকের জন্য, ওটি তমুকের জন্য ইত্যাদি নির্দেশ করিতেন। নিজের জন্য খারাপগুলি রাখিতেন।
একটি ছোকরা সাধু শ্যামলাতালে আসিবেন। তিনি তামাক খান। মহারাজ ভৃত্যকে বলিয়া দিলেন, উহার পৌঁছিবার পূর্বেই আরেকটি গড়গড়া, নল এবং পাইপ কলকে ঠিক করিয়া রাখিতে। ঐ সাধুটি আসিলে ভৃত্য মহারাজের নির্দেশানুযায়ী মহারাজের টেবিল-চেয়ারের পাশেই একখানা চেয়ার দিয়া নূতন গড়গড়া প্রভৃতি আনিয়া হাজির করিলে মহারাজ বলিলেন : “তুমি পরিশ্রান্ত হইয়া আসিয়াছ, একটু তামাক খাইয়া জিরাইয়া লও।” সাধু তো অবাক! মহারাজের সামনে সমানভাবে তামাক খাওয়া! তাঁহাকে কিছুতেই সম্মত না দেখিয়া মহারাজ ঐ গড়গড়াদি একটু তফাতে সরাইয়া লইয়া তামাকু সেবন করিতে বলিলেন এবং সেইরূপই হইল।
একবার একটি ব্রহ্মচারীর জন্য বিরজানন্দজী লুচি ও হালুয়া তৈয়ারি করিয়া দিতেছেন স্বয়ং। ঐ ব্রহ্মচারী ভোরেই কোথাও যাইবেন, অথচ পাচক উপস্থিত হয় নাই। যখন ব্রহ্মচারী জানিল তখন তাড়াতাড়ি গিয়া দেখেন—রসুইঘরে মহারাজ খাবার তৈয়ারি করিয়া কলাপাতায় মুড়িতেছেন। মহারাজ তাঁহাকে দেখিয়া বলিলেন : “এই লও, খাইয়া যাও।”
কোনো সাধু (ছোকরা) বিদায় লইয়া আসিবেন। মঠে মহারাজ তখন ড়াইয়া বগলে থার্মোমিটার দিতেছেন। নিকটেই তাঁহার জন্য খাবার রাখা হইয়াছে। সাধুটিকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিয়া, থার্মোমিটার দেওয়া শেষ হইলে তিনি ইঁহার প্রণাম গ্রহণ করিয়া যখন শুনিলেন নিকটে কেহ নাই, তখন নিজের জন্য রক্ষিত খাবার হইতে বেশ বড় বড় দুটি সন্দেশ উঠাইয়া সাধুটিকে দিতেছেন। সংকুচিত হইয়া সাধুটি বলিলেন : “মহারাজ, আপনার খাওয়া হইলে প্রসাদ পাইব; আমি অপেক্ষা করিতেছি।” কিন্তু মহারাজ তাহা না শুনিয়া বলিলেন : “আমি দিতেছি, তুমি লও না।” তখন সাধুকে লইতেই হইল।
অসুস্থ সাধু ধীরেন মহারাজ অন্য কোনো ত্রুটি না থাকিলেও অসুস্থাবস্থায় সন্ন্যাস না হইতেও পারে, অথচ সময় সমীপবর্তী আশঙ্কা করিয়া মহারাজকে লিখিলেন : “আমার ব্যাধি স্থায়ী, কোনোদিনই নির্মূল হইয়া হয়তো সারিবে না। এই অবস্থায় সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া সন্ন্যাস লওয়া সম্ভবত কখনোই হইবে না। এখন আপনি যাহা করেন।” মহারাজ সেবককে বলিলেন : “আমি উহাকে সন্ন্যাস দিব, যদি কেহ আপত্তি করে তবুও। তবে দেখা যাউক, উহারা কী করে।” যাহা হউক, স্থানীয় কর্তৃপক্ষরা কোনো বাধা উত্থাপন করেন নাই। ঐ সাধুকে তিনি একটি সোয়েটার ও একখানা কাপড় দিয়াছিলেন অযাচিত হইয়া।
প্রকাশানন্দজী ও বিরজানন্দজী একবার ঢাকায় প্রচারে গিয়া নাগমহাশয়ের বাড়ি যান। সেখান হইতে ঢাকায় ফিরিবার পথে স্টেশনে আসিয়া টিকিট করিবার পর দেখা যাইল, সব গাড়ি ভর্তি। একটি কামরায় জোর করিয়া উঠিতে গিয়া ভিতরের লোকদের ধাক্কা খাইতে হইল, তাহারা কিছুতেই ঢুকিতে দিবে না। নাগমহাশয় তাঁহাদের ধাক্কা খাইতে দেখিয়া অস্থির হইয়া “হায়, হায়, কী হইল, মহাপুরুষদের অপমান হইল, মহা অপরাধ হইল! হে প্রভু, অজ্ঞানের অপরাধ লইও না, ইহাদের ক্ষমা কর।” ইত্যাদি বলিয়া ছটফট করিতে লাগিলেন। গাড়ির লোকেরা সে-দৃশ্য দেখিয়া ভয়ে নিজেদের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাহিয়া তাঁহাদের সাদরে গাড়িতে আহ্বান করিল এবং নিজেরা ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া বসিয়া তাঁহাদের জন্য আধখানা কামরা খালি করিয়া দিল! যাহারা সাধুদের দেখিয়াও ধাক্কা দিয়া গাড়ির বাহির করিয়া দিতে গিয়াছিল, তাহারা ছিন্ন-মলিন কাপড় পরিহিত, ভিখারির ন্যায় দেখিতে নাগ মহাশয়ের অপূর্ব ভাব দেখিয়া অনুতপ্ত হইল এবং সাধুদের সকলকে খাতির করিয়া ডাকিল! যথার্থ চরিত্রবলের কী অমোঘ প্রভাব!
এক ব্রহ্মচারীর ভগিনী মারা গিয়াছে। মা, বোন এবং ব্রহ্মচারী সকলেই মহারাজের কাছে মন্ত্রদীক্ষিত। মহারাজের শেষ অসুখের সময় এই ঘটনা। ব্রহ্মচারী মহারাজের সেবক। সেবার ত্রুটি হইবে—এজন্য মহারাজ বারবার বলা সত্ত্বেও সে বাড়িতে দু-এক দিনের জন্যও যাইতে স্বীকৃত হইল না। তখন মহারাজ তাহাকে অতীব করুণ কণ্ঠে বলিলেন : “দ্যাখ, তোর মার এই দারুণ শোকে আমি যে কষ্ট পাইতেছি, তোকে দু-এক দিনের জন্য তাহার নিকট পাঠাইতে পারিলেই সে-কষ্টের উৎকৃষ্টতম পরিচায়ক হইত এবং ইহার চেয়ে উৎকৃষ্টতম সহানুভূতিজ্ঞাপন (better expression) আর তো খুঁজিয়া পাইতেছি না!” ব্রহ্মচারীটি তখন গেল। মহারাজ পাঠাইয়াছেন জানিয়া মা এবং অন্যরা যেন অন্য রাজ্যে চলিয়া গেলেন। সারারাত্রি ঠাকুরের কথা, মহারাজের কথা হইল। শোক যেন অন্তর্হিত হইল! পরদিন ভোরে মা-ই উদ্যোগ করিয়া ছেলেকে মঠে পাঠাইয়া দিলেন।
দেহান্তের তিন-চার দিন পূর্বে বিরজানন্দজী মঠের একজন প্রধানকে ডাকিয়া বলিলেন : “দেখ, পর পর দুইদিন আমি মহারাজের (রাখাল মহারাজ) দর্শন পাই। প্রথম দিন মাথার খেয়াল বলিয়া বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু দ্বিতীয় দিন আর অবিশ্বাস করা গেল না। মহারাজ বলিলেন, ‘তুই তো আর থাকবি না, সময় হইয়াছে; যাইবার পূর্বে এই ব্যবস্থাটি [ঠাকুরপূজা সংক্রান্ত] করিয়া যা।’ তিনি বিশেষ অনুরোধ করায় তোমাকে কথাটি বলিলাম। তুমি অন্যদের সহিত কথাবার্তা কহিয়া এই কাজটি করিও।” [সমাপ্ত]
‘স্বামী বিরজানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।