“মা, যদি হও রাজি,
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি।”১
ছোটবেলায় খুব হিংসে হতো—আমার মনের কথাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে ফেলেছেন বলে। যদিও খেয়াঘাটের মাঝি হওয়ার স্বপ্ন আমার এখনো ভেঙে খানখান হয়ে যায়নি।
কাকমারি পেরিয়ে চক্ষুজ্বলা খালের পাশ দিয়ে দেখা যেত মণ্ডলপাড়ার মাঠ, সেই মাঠে নাড়া-ভাটুঁইয়ের বাসা খুঁজতে গেছি কতবার। কুয়াশায় ঘেরা বনবাদাড়ের ভোর—নাড়াবনে মাকড়সার জালে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু জলের টোপ—সেই মাঠ পাড়ি দিয়ে গাঙভেড়িতে উঠলেই দেখা যেত টিপলীঘেরী খেয়াঘাট। সুশীল মাঝির দশ পয়সার খেয়া। বড় মাসির বাড়ি যেতে গেলে এই বৈতরণি পেরতেই হতো। দত্ত নদীতে ছোট্ট একটা ডিঙি নিয়ে নিজের মেজাজে খেয়া দিত সুশীল মাঝি। কী সকাল, কী সাঁঝে অথবা নিঝুম কোনো দুপুরে পৃথিবীর এক কোণে নদীর ওপর ডিঙি ভাসিয়ে কী নিশ্চিন্ত তার চলা! যেন কোথাও কোনো ব্যস্ততা নেই। নৌকায় উঠে দাঁড় টেনে দিলে তার পারানি লাগত না আর। আমরা ছোটরা হুড়মুড় করে নৌকায় উঠে তাই বসে পড়তাম দাঁড়ে। মাঝি দশ পয়সা মকুব করে দিত। শুক্রবার টিপলীঘেরীর হাট, সেদিন কত হাটুরে দোকানদার যে খেয়ানৌকায় পারাপার করত তার ইয়ত্তা নেই। বুদ্ধি করে মাঝি ঘাটে লাগাত পাছার দিকটা। নামার সময় যাত্রীরা ভাড়া দিয়ে নেমে যেত। কারো ছিল মাসকাবারি, মাঝি তার দিকে একবার তাকিয়ে চরে বৈঠাটা আরো একটু বেশি করে পুঁতে দিত, নৌকা যাতে ঘাট থেকে দূরে সরে না যায়। পান্তা খাওয়ার বেলা হলেই মাঝি এক থালা পান্তাভাত আর ভেলিগুড় নিয়ে বসে পড়ত খেয়াঘাটে। এসব দেখে কার না সাধ জাগে মাঝি হওয়ার! আমার খুড়তুতো ভাই জগোকে বলতাম—বড় হয়ে আমি মাঝি হব, আর তুই বসবি দাঁড়ে—সে আমার চেলা হতে রাজিও হয়েছিল। তারপর কোথা থেকে কখন যে কী হয়ে গেল—রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ কাব্যের নায়কের মতো ইচ্ছেটা কেবল মনের মধ্যে রয়ে গেছে। খেয়াঘাটের মাঝিও যেমন হতে পারিনি, তেমনি মধু মাঝির নৌকা নিয়ে আমার যাওয়া হয়নি—‘সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার’।
কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদার ভবানন্দ-ভবনে যাত্রা’য় সেই কবে পড়েছিলাম—“অন্নপূর্ণা উতরিলা গাঙ্গিনীর তীরে।/ পার কর বলিয়া ডাকিল পাটনীরে॥/ সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী।/ ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি॥”২ আমাদের বৃহত্তর বাংলাদেশে খেয়ার ইতিহাস কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি। সে-ইতিহাস ছড়িয়ে আছে মৌখিক পরম্পরায়, স্থানীয় মানুষদের স্মৃতিতে। ঈশ্বরী পাটনী সেই না লেখা ইতিহাসের কিংবদন্তি নায়ক।
দীর্ঘ সময় ধরে সুন্দরবনের দ্বীপভূমির মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল খেয়া। সুন্দরবনের দ্বীপভূমি আবাদ ও জনবসতি স্থাপনের সময় থেকে এই খেয়া-পারাপার শুরু হয়। দ্বীপভূমিতে জনবসতি স্থাপনের আঞ্চলিক ইতিহাসের সঙ্গে খেয়ার ইতিহাস সমানুপাতিক। প্রথমদিকে খেয়ানৌকা ছিল দাঁড়-বৈঠা-চালিত, পরে যন্ত্রচালিত ইঞ্জিনের মাধমে খেয়ানৌকা চালানো শুরু হয়। এই খেয়াকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য লোককথা ও লোকশ্রুতি। স্বাভাবিক কারণেই সুন্দরবনের মানুষের জীবনচর্যার সঙ্গে খেয়ার যোগ অঙ্গাঙ্গিক।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ১৯টি ব্লকের মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবনের বিস্তার। ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা খেয়ার ইতিহাস, খেয়া সম্পর্কিত লোককথা ও লোকশ্রুতি সংগ্রহ করেছি। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ইতিহাসের নানা খুঁটিনাটি তথ্য, স্থানীয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাক্ষাৎকার আমাদের কাজের অন্যতম সহায়ক উপাদান হয়ে উঠেছে। এবার নিবেদন করা যাক কয়েকটি খেয়ার কথা :
গোসাবা-সূর্যবেড়িয়া-গদখালি খেয়া
ভারতীয় সুন্দরবন অঞ্চলে যতগুলো ব্যস্ততম খেয়া আছে, গোসাবা-সূর্যবেড়িয়া-গদখালি খেয়া তার মধ্যে অন্যতম। গোসাবা-গদখালি সুন্দরবনের অন্যতম প্রবেশদ্বার। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন (১৮৬০—১৯৩৯) ছিলেন গোসাবার রূপকার। ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে ১৯০৩ সালে স্কটল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত বংশজাত হ্যামিলটন সাহেব গোসাবা, রাঙাবেলিয়া ও সাতজেলিয়া—এই তিনটি দ্বীপ ইজারা নিয়ে তাঁর অভিনব জমিদারি পত্তন করে সমবায় পদ্ধতিতে গ্রাম-উন্নয়নের কাজ শুরু করেন। এবিষয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। হ্যামিলটনের আহ্বানে ১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ গোসাবাতে আসেন। গোসাবার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বালি দ্বীপ, উত্তরে চণ্ডীপুর আর পশ্চিমে গদখালি। বিদ্যা, দুর্গা-দোয়ানি আর হোগল—তিন নদীর সংযোগস্থলে গোসাবা। কলকাতা থেকে গদখালি পর্যন্ত সরাসরি গাড়ি আসে। গদখালির জেটিঘাটে দাঁড়ালে চারদিকে চারটি নদী ও চারটি বদ্বীপ স্পষ্ট দেখা যায়। নদীতে দেখা যায় এম. ভি. মা তারা, এম. ভি. মা সিন্ধু, এম. ভি. বনানীর মতো অসংখ্য লঞ্চ ও ভুটভুটি সুন্দরবনে আগত টুরিস্টদের জন্য অপেক্ষা করছে। সবচেয়ে প্রশস্ত বিদ্যা নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে টানা। পশ্চিমদিক থেকে মাতলার শাখা হোগল এসে বিদ্যায় মিশেছে। আর গোসাবা থেকে ছোট্ট খাঁড়ি দুর্গা-দোয়ানি বেরিয়ে গেছে আরো দক্ষিণে গভীর সুন্দরবনের দিকে।
হ্যামিলটন সাহেবের আমল থেকে এই খেয়া শুরু হয়েছিল। সেই সময়ের মাঝিদের মধ্যে ভূষণ মাঝি (গদখালি), রাম মণ্ডল (বিরাজমণি), ইসমাইল মাঝি ও ইলিয়াস মাঝি স্থানীয় মানুষদের স্মৃতিতে এখনো রয়ে গেছেন। এক বছরের চুক্তিতে খেয়ার বর্তমান মালিক রবিউল সর্দার। তিনিই বিগত তিরিশ বছর ধরে খেয়া চালাচ্ছেন। গোসাবার পাড় থেকে প্রথম খেয়া ছাড়ে ভোর ৫.৩০ মিনিটে। শেষ খেয়া রাত ৯টায়। খেয়ানৌকার সংখ্যা বর্তমানে তিনটি। স্পেশাল খেয়ানৌকার সংখ্যা দুটি। সবগুলি টু-সিলেন্ডার ইঞ্জিন-চালিত। সবুজসাথী প্রকল্পের একটি জীর্ণ ভেসেল এলেও সেটি অর্ধেক ডুবে বিদ্যা নদীর চড়ায় তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। খেয়া ছাড়ে ১০-১৫ মিনিট পরপর। দৈনিক পাঁচ হাজার-সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ এই খেয়ায় যাতায়াত করেন। খেয়া পারাপারের কাজে যুক্ত আছেন—সাহাদাদ মোল্লা (বয়স ৩৮), বিকাশ গাড়ু (বয়স ৩৫), জিয়ারুল সর্দার (বয়স ২৭), জাব্বার সর্দার (বয়স ৩৫), সঞ্জয় গাড়ু (বয়স ৩৫), জয়নাল মোল্লা (বয়স ৪৫) ও হারান সর্দারের (বয়স ৪৫) মতো ৩৫ জন কর্মচারী। এঁরা সকলেই চণ্ডীপুরের মানুষ। খেয়া-পারাপারের ভাড়া জনপ্রতি দু-টাকা। স্পেশালে উঠলে অতিরিক্ত দু-টাকা আবার দিতে হয়। সাইকেল পার করলে তিন টাকা আর মোটর সাইকেল পার করলে দশ টাকা দিতে হয়। পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান বলতে হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো, বেকন বাংলো, কাছারি বাড়ি, সাহেবের আমলের ফ্রি ডিস্পেন্সারি (১৯১০) উল্লেখযোগ্য।
খেয়ানৌকা জেটিঘাটে ভিড়তেই হুড়মুড় করে লোকজন নামে। আবার হুড়মুড় করে যাত্রীরা উঠে পড়ে। সুন্দরবনের শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে এই এক চলমান ছবি। কয়েক বান্ডিল কাতা দড়ি, গোটানো মনোফিল জাল কিনে বাড়ি ফিরছেন এক বৃদ্ধ। সদ্য কেনা তলতা বাঁশের কুলোটা তাঁর মাথায় ছাতার কাজ করে। দূর গ্রামের এক চাষি-বৌ ফিরছে তার বাপের বাড়ি থেকে, পোষানি নেওয়া তার ছাগলটা খেয়ায় ওঠার পর থেকে আনকা জায়গা, আনকা মানুষ দেখে ভয়ে ডেকে চলেছে অবিরাম। অসুস্থ এক ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য কষ্টে-সৃষ্টে খেয়ায় তুলেছে তাঁর দুই ছেলে। শত পায়ের মাঝে নৌকার পাটাতনে তাঁকে শোয়ানো, বৃদ্ধের চক্ষু কোটরে ঢুকে গেছে। সাতজেলিয়ায় যে-ডাক্তার দেখছিলেন তিনি হাতে নাড়ি পাচ্ছেন না। আশি-নব্বই জন যাত্রীর চাপে নৌকা টলমল। তার মধ্যে থার্মকলের ছোট একটা বাক্স নিয়ে কাঠি-বরফ, রঙিন পেপসি-বরফ বিক্রি করছে এক কিশোর। গ্রীষ্মের দাবদাহ তার মায়ামাখা মুখের লাবণ্য সবটুকু মুছে দিতে পারেনি এখনো। ওকে আজ প্রথম দেখছি। খেয়ানৌকায় নতুন ফেরিওয়ালা।
কথা বলে জানতে পারি ওর নাম আজারুল। চণ্ডীপুরের ছেলে। ওর আব্বা তাহের আলী অসুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী। কাজে বেরতে পারেন না। চার ভাই বোনের মধ্যে আজারুল মেজ। লকডাউনে স্কুল ছাড়ার পরে ওর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বেলতলীর বরফ কারখানা থেকে কাঠি-বরফ, পেপসি-বরফ নিয়ে এসে রোজ খেয়ায় বিক্রি করে। দিনে ২৫০ টাকার মতো বিক্রি হয়। শনিবার হাটবার, ঐদিন বেশি লোক পারাপার করে, তাই ৩০০ টাকার মতো বিক্রি হয়। ওর কাছ থেকে দু-টাকায় একটা কাঠি-বরফ কিনি, জিভে ছেঁায়াতেই স্মৃতির স্বাদ ফিরে আসে। ভুটভুটির আওয়াজ, ছাগলের ডাক আর নৌকার যাত্রীদের কথাবার্তার মধ্যে আজারুলের কাছে শুধাই : “তোর সমবয়সি ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যায়, তোর যেতে ইচ্ছে করে না?” ওর চোখ-দুটো চিকচিক করে ওঠে, সম্মতিসূচক ঘাড় কাত করে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে : “আব্বা কাজ-কাম করতি পারে না, তাই আমি এই কাজ করি। আর ইসকুলি যাতি পারিনে। তবে দিদি পুড়তেছে। গোসাবা ইসকুলির তে এবার মাধ্যমিক দ্যাবে।” কিশোর বয়সে আজারুলের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নকে আমি হাতড়াতে থাকি—যদি এক জায়গায় জড়ো করা যায়। ভুটভুটির ইঞ্জিন থামতেই সম্বিত ফেরে—দেখি ঘাট এসে গেছে। যাত্রীদের কোলাহল, সাইকেল বাইক নামানোর ব্যস্ততায় জেটিঘাটের সিঁড়িতে আজারুলের ছোট্ট শরীরটা হারিয়ে যায়। ভাবছিলাম, যদি ওপরে আসে তাহলে আলাদা করে ওর সঙ্গে একটু কথা বলব। কিন্তু আজারুল কৈ? ফিরতি যাত্রীতে খেয়া যে আবার ভরে গেল। লগি ঠেলে খেয়ার মাথা ঘোরায় হেল্পার সঞ্জয়, হাল সোজা করতে করতে মাঝি জয়নাল চিৎকার করে কিছু যাত্রীকে নৌকার পাছার দিকে যেতে বলে কিন্তু কে শোনে কার কথা! জেটিঘাটের ওপর থেকে কেবল দেখতে পাই থার্মকলের ছোট একটা বাক্স ভিড়ের মধ্যে নড়াচড়া করছে। তার নিচে আজারুলের বিষণ্ণ মুখ অপুষ্ট শরীরের উপস্থিতি টের পাই। সংসারের দায়িত্ব যার কাঁধে, তাকে তো খেয়ানৌকা মিস করলে চলবে না। এই প্রখর রোদে ঘাটের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে যে একটু জিরবে, কারো সঙ্গে দু-দণ্ড কথা বলবে তার ফুরসত তো বিধাতা দেয়নি তাকে।
[এই পর্বে আমরা কথা বলেছি গোসাবার ইসমাইল মাঝির সঙ্গে। তিনি ছিলেন এই খেয়ার পুরানো মাঝি। এছাড়াও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন—নিমাই ভুঁইঞা (বয়স ৫০, গদখালি), দিলীপ মণ্ডল (বয়স ৫৫, মন্মথনগর), আব্দুর শাহীদ আলী মণ্ডল (বয়স ৭০, বাসন্তী), আজগর ঢালী (বয়স ৪২, সোনাখালি), সিরাজুল গাজী (বয়স ৩১, ডকঘাট), জিয়ারুল সর্দার (বয়স ২৫, চণ্ডীপুর)। তথ্যসংগ্রহ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ—১৬.০৩.২০১৯]
জগন্নাথ-হরিতলা খেয়া
হরিতলা খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে রায়মঙ্গলের ওপারটা ঝাপসা দেখায়। না, দু-পাড়ে কোনো জেটিঘাট নেই। যেমন নেই কোনো যাত্রী প্রতীক্ষালয়। আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই, ব্যতিক্রম কেবল জগন্নাথঘাটের উঁচু নারকেল গাছটা। সদ্য গেঁাফ-দাড়ি গজানো বাপন ঐ নারকেল গাছটাকে চিহ্ন করে নৌকার গলুইটাকে সোজা রাখে। উত্তাল রায়মঙ্গলে ঢেউয়ের পর ঢেউ কাটায়। যাত্রিসংখ্যা হাতে গোনা—নৌকার পাছার দিকে জড়সড় হয়ে বসে থাকা হাতে কাটা রাধা-তুলসীর মালা গলায় বুড়োটার তিলক ঘামে লেপটে গেছে—জপমালার গণনার হার গিয়েছে বেড়ে। ব্যাগ-ভর্তি কচুর মুখি, ছাড়ানো ঝুনো নারকেল, পরিমাণমতো ঝাঁটার কাঠি আগলে বসে থাকা বুড়িটা কাপড়ের খুঁট খুলে একটা আধুলি নিজের কপালে ছুঁইয়ে গঙ্গা দেবীর নামে ছুঁড়ে দেয় রায়মঙ্গলের জলে। গত একশো বছরে রায়মঙ্গলের বুকে এমন কত আধুলি, এক ভরি ওজনের কাঁচা টাকা রায়মঙ্গলের বুকে কত যে জমা হয়েছে কে জানে! ছোট্ট দুটো হলুদ তিতলি জড়াজড়ি করতে করতে উড়ে আসছে খেয়া বরাবর। কখনো কখনো ঢেউ সরাসরি নৌকার তলায় বাড়ি মেরে দেখে নিচ্ছে জলুই-পেরেক ঠিকমতো শক্ত আছে কি না!
ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যোগেশগঞ্জ, মাধবকাটি পারের জগন্নাথঘাট। নতুন রিংবাঁধ, জিও-জুটের কালো মখমলি আবরণ। যাত্রীদের প্রাণে জল আসে—অথৈ দরিয়ার পানিতে ভাসার সময় ভয়ে, আশঙ্কায় আত্মারাম জল শুকিয়ে কাঠ।
রায়মঙ্গলের পশ্চিমদিকে ছোটমোল্লাখালি কোস্টাল থানার অন্তর্গত পুঁইজালি, মৌখালি, চিমটা অঞ্চল। জেলা পরিচয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। আর পূর্বদিকে হেমনগর কোস্টাল থানার অন্তর্গত মাধবকাটি, যোগেশগঞ্জ, পাটঘরা, হেমনগর অঞ্চল—এগুলো উত্তর ২৪ পরগনার দক্ষিণতম সুন্দরবন-সন্নিহিত অঞ্চল।
এ অঞ্চলের কেউ সঠিক সাল বলতে পারলেন না, তবে স্মৃতি থেকে জানালেন—স্বাধীনতার পর থেকে এই খেয়া চলছে। জগন্নাথ-হরিতলা ঘাটে প্রথমদিকে খেয়া দিতেন প্রফুল্ল পাটনী। ঈশ্বরী পাটনীর উত্তরাধিকারী প্রফুল্লর পেশাগত ‘পাটনী’ পদবির আড়ালে হারিয়ে গেছে তাঁর আসল পদবি। অনেক খোঁজ-খবর করে জানা গেল, তাঁর প্রকৃত নাম প্রফুল্ল দাস। তারপর এখানে খেয়া দিতেন জীতেন মণ্ডল (বয়স ৮০, মাধবকাটি)।
খেয়ার বর্তমান মালিক দীনেশ মণ্ডল (বয়স ৪৫, মাধবকাটি) সরকারের সঙ্গে এক বছরের চুক্তির মাধ্যমে এই খেয়া পরিচালনা করেন। দীনেশবাবু নিজে এবং তার ছেলে বাপন এখানে খেয়া দেন। খেয়ানৌকার সংখ্যা দুটি—অবশ্যই সেগুলি যন্ত্রচালিত ভুটভুটি। প্রথম খেয়া ছাড়ে সকাল ৭টায়। শেষ খেয়া বিকাল ৫টায়। কালবৈশাখীর মরশুমে সময়ের হেরফের হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পরে অসুস্থতা বা জরুরি প্রয়োজনে এখানে স্পেশাল খেয়ার ব্যবস্থা আছে। আধঘণ্টা পরপর খেয়া চলে। খেয়া-পারাপারের ভাড়া আট টাকা। দৈনিক গড়ে ১০০—১২০ জন যাত্রী এখানে পারাপার করেন। চাঁড়ালখালির হরিপুজোর মেলা বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী। মেলার সময় এখানে প্রচুর লোক যাতায়াত করেন।
অশীতিপর মাঝি জীতেন মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। কথাপ্রসঙ্গে তিনি জানালেন : “জমিদার আমলে, যখন ছিল চার পয়সার খেয়া—সেই সময়ের তে আমি খেয়া দিচি।” জানালেন, কোটালের মুখে একবার রায়মঙ্গলে তাঁর নৌকা ডুবেছিল। যাঁর নামে ঘাটের নাম, আমরা জনৈক সেই জগন্নাথ মণ্ডলের তত্ত্ব-তালাশ করতেই বৃদ্ধ জীতেনবাবু তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন : “জগন্নাথের ছ্যেলো ৭০০ বিঘে জমি। মাধবকাটি, পাটঘরা ওপারে পুঁইজালি, কুমিরমারি—সবমিলে ৭০০ বিঘে। এখন তার নাতে-পোতারা পাটঘরার উত্তরে থাকে। তবে এখন তাগো অবস্তা খুব খারাপ—চেন্নাই-কেরালায় খাটতি-টাটতি যায়। ফকির, দুলাল ছাড়াও প্রথম পক্ষের ছিল তিন মাইয়ে। আর শেষের পক্ষের শরৎ, ভোলা, ঝন্টু ছাড়াও দুজন মাইয়ে। সেসময়ে জগন্নাথ মোড়লের দাপট ছ্যেলো। তার নামে এই ঘাট।” (সাক্ষাৎকার : ০৩.০৩.২০১৯)
বাবলা গাছের পাশে খোঁটায় বাঁধা গরুটা আমাকে শুঁকতে থাকে। যেন চিনে নিতে চায়! দুপুরের রোদ গাছের ফাঁক দিয়ে বৃদ্ধ মাঝির মুখে আলোছায়া খেলে যায়—স্মৃতি-শ্রুতি তাঁর শূন্যদৃষ্টির মধ্যে কেবলই তরঙ্গায়িত হতে থাকে। খেয়া সম্পর্কিত লোককথা বা কিংবদন্তির কথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধ মাঝি কেবলই স্মৃতির খেই হারিয়ে ফেলেন, তারপর এক বাঁও মেলে না, দু বাঁও মেলে না…
হেমনগর-কুমিরমারি খেয়া
হেমনগর-কুমিরমারি অঞ্চলের স্থানীয় মানুষেরা এই খেয়াকে ‘খুদের খেয়া’ নামে জানেন। এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠার সময় থেকে এই খেয়া-পারাপার শুরু হয়। রায়মঙ্গল নদীর পূর্বদিকে হেমনগর কোস্টাল থানার অন্তর্গত হেমনগর, যোগেশগঞ্জ, পারঘুমটে, কালীতলা আর পশ্চিমদিকে কুমিরমারি, পুঁইজালি আবাদ। তখন ইঞ্জিন-চালিত ভুটভুটি ছিল না, বৈঠা ও দাঁড়ে চলত ডিঙিনৌকা—সেই ডিঙিনৌকা নিয়ে ভয়ংকর রায়মঙ্গলে খেয়া দিতেন কুমিরমারির খুদে মাঝি। ‘মাঝি’ তাঁর পেশাগত পরিচয়—জনৈক ক্ষুদিরাম বা খুদে মাঝির আসল পদবি স্থানীয় মানুষদের স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। কুমিরমারিতে গিয়ে অনেক খোঁজ-খবর করে জানা গেল, খুদে মাঝির প্রকৃত নাম—ক্ষুদিরাম সর্দার। খুদে মাঝির পর গোপাল পাটনী অনেক দিন এই খেয়া-পারাপারের কাজে যুক্ত ছিলেন। ঈশ্বরী পাটনীর উত্তরাধিকারী কুমিরমারির গোপাল মণ্ডলকে সবাই ‘গোপাল পাটনী’ পরিচয়েই চিনতেন।
এখন (২০১৯) খেয়ার মালিক তিনজন—চিত্ত গায়েন, স্বপন মণ্ডল ও মন্টু মণ্ডল। প্রত্যেকে দশ দিন করে খেয়া দেন। এঁদের প্রত্যেকেরই বাড়ি কুমিরমারি। সরকারের কাছে এক বছরের চুক্তি করে এঁরা খেয়া চালান। মালিক তিনজনই মাঝিগিরি করেন। প্রত্যেকেরই আছে ইঞ্জিন-চালিত একটি করে ভুটভুটি। মাঝি ও মালিকদের মধ্যে চিত্ত গায়েন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ।
প্রথম খেয়া ছাড়ে সকাল ৬টায় এবং শেষ খেয়া— বিকাল ৫টায়। প্রতি আধঘণ্টা পরপর খেয়া চলাচল করে। সুন্দরবনের অন্যান্য খেয়ার তুলনায় এখানে প্রতিদিনের যাত্রিসংখ্যা খুবই কম—দৈনিক গড়ে ১০০—১২০ জন।
দু-পাড়ে কোনো জেটিঘাট নেই, যাত্রী প্রতীক্ষালয় নেই। ফলে যাত্রিসাধারণ প্রতিদিন প্রভূত সমস্যার সম্মুখীন হন। শুক্রবারে থাকে কুমিরমারির হাট। আর রবি ও বুধবারে থাকে হেমনগর চৌমাথার হাট। হাটের জন্য ঐ তিনদিন যাত্রিসংখ্যা সামান্য বাড়ে।
হেমনগরের পর থেকে কুমিরমারির চরে নামলে ভাড়া আট টাকা আর কুমিরমারির বাজারে নামলে ভাড়া লাগে দশ টাকা।
ঘাটে খেয়ামাঝিকে না দেখতে পেয়ে আমরা কথা বলছিলাম (০৩.৩.২০১৯) অঞ্জন হালদার (বয়স ৪৬ বছর, পিতা—প্রয়াত অনুকূলচন্দ্র হালদার, হেমনগর) মহাশয়ের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আগে পালতোলা নৌকা নিয়ে মাঝিরা খেয়া দিত। সঙ্গে থাকত দাঁড় ও হাল। বাগদার মীন ধরতে গিয়ে এ অঞ্চলের কাউকে কাউকে কুমিরে টেনে নিয়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে নদী পেরিয়ে বাঘ কখনো কখনো ঢুকে পড়ে গ্রামে। এই এক সমস্যা—খেয়ার তথ্যসংগ্রহের কাজে সুন্দরবনের বিভিন্ন জনপদে ঘুরতে ঘুরতে লোক-ইতিহাস, লোককথা, লোকশ্রুতির উপাদান কখন যে বাঘের গল্পে ঢুকে পড়বে কে জানে!
হেমনগরে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে সাগরমেলা বসে। সেই মেলাকে ঘিরে রায়মঙ্গলের দু-পাড়ের মানুষেরা উৎসবে মেতে ওঠেন। এখানকার বনবিবিপুজোও প্রচলিত আছে। সম্প্রতি কাস্টমস অফিস ও টুরিস্ট লজ গড়ে উঠেছে। হোম-স্টেও তৈরি হয়েছে কোথাও কোথাও। অন্যদিকে কুমিরমারির দিকে আছে বাগনা ফরেস্ট অফিস। এখানে সুন্দরবন দেখতে আসা টুরিস্টদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তাঁরা অবশ্য খেয়ায় বিশেষ পারাপার করেন না।
খেয়া থেকে দূরে দক্ষিণে দেখা যায় প্লাই-অ্যাশ নিয়ে বাংলাদেশের দিকে যাওয়া ছোট ছোট কার্গো জাহাজ। হেমনগর-কুমিরমারির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী এই খেয়াটি ভারতীয় সুন্দরবন অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের শেষতম খেয়া। (এই পর্বে আমরা কথা বলেছিলাম অঞ্জন হালদারের সঙ্গে, তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।)
বানু পালের খেয়া
খেয়াঘাটে পৌঁছে দেখি—হাতানিয়া-দোয়ানিয়া পেরিয়ে ছোট্ট ডিঙিনৌকাটা সবেমাত্র ভিড়ছে ওপারে। মদনগঞ্জে শিবনগরের পারে দু-চারজন যাত্রী হলে তবেই হয়তো মাঝি খেয়া নিয়ে নারায়ণপুরের দিকে আসবে। কোলাঘাটের ছাইপাঁশ নিয়ে এম. ভি. খোরশেদ (কার্গো) ডানদিকে নদীর মাঝে নোঙর ফেলেছে। বাঁদিকে নদী যতদূর দেখা যায়, ৪-৫টি জেলেডিঙি ঈশ্বরীপুরের দিকে ৮-৯টি বেঞ্চিজাল ফেলে মাছ ধরছে।
কাছে নদীর চড়ায় শাল-বল্লার পাইলিং করছিলেন কয়েকজন মানুষ—ঘাটের ইতিহাস তাঁরা জানেন না। বললেন : “আমরা তো ভিন গাঁয়ের মানুষ, এখানে এসেছি কাজে।” খেয়াঘাট-সংলগ্ন একটা পুরানো বাড়ি দেখিয়ে বললেন : “গণেশ মাইতির বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিন, উনি যদি কিছু বলতে পারেন।”
পুরানো ইঁটের ভাঙা পাঁচিল বরাবর আমরা হাঁটতে থাকি। বাগান পেরিয়ে পুরানো একটা রাইস মিলের দরজায় পৌঁছে দেখি, জনা তিনেক নির্মাণকর্মী বসে টিফিন করছেন। তাঁদেরকে ঘাটের কথা শুধাই—তাঁরাও বলতে পারলেন না। ডেকে দিলেন ঐ বাড়ির গৃহকর্ত্রীকে। তাঁর সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে আমরা জানতে পারি, বানু পালের নাতির ছেলে এখন খেয়া দেয়। নারায়ণপুর পাইকারি সবজির বাজারে সবজি বিক্রি করে ততক্ষণে চলে এসেছেন গণেশচন্দ্র মাইতি। আমাদের আগমনের কারণ স্পষ্ট করার পর তিনি গিন্নিকে অতিথিদের চা দিতে বলে বারান্দায় আমাদের সামনে বসলেন ইতিহাসের ঝাঁপি নিয়ে।
বরেন্দু : আপনারা তো স্থানীয় মানুষ। এই খেয়া কোন সময় শুরু হয়েছিল মনে আছে? সম্ভাব্য সাল বললেই হবে।
গণেশবাবু : ১৯৬০ সাল নাগাদ।
প্রশ্ন : খেয়া চালানোর ব্যাপারে কারা প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিল?
উত্তর : আপনাদের তাহলে একটা গল্প বলি। আপনারা এই যেখানে বসে আছেন—এটা ছিল একটা রাইস মিল। মান্না-মণ্ডল-মল্লিক এন্ড কোম্পানি ১৯৬০ সাল নাগাদ এই লক্ষ্মী নারায়ণ রাইস মিল তৈরি করেন। আশপাশের পাঁচটি অঞ্চল (নামখানা, শিবরামপুর, হরিপুর, ফ্রেজারগঞ্জ, মৌসুনি) থেকে রাইস মিলের শ্রমিক, ধান-ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতারা তখন এখানে চলাচল করত। এখানে প্রায় ২০০ লোকের কর্মসংস্থান ছিল। তখন থেকে বানু পালের খেয়া শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে বন্যার সময় রাইস মিল ডুবে যায়। তখন থেকে ব্যবসায় লোকসান হতে থাকে।
প্রশ্ন : আসার সময় যে লক্ষ্মী নারায়ণ স্কুল দেখলাম, তার সঙ্গে কি রাইস মিলের কোনো সম্পর্ক আছে?
উত্তর : হ্যাঁ, নদীর পাড় ছেড়ে বাঁক ঘুরতেই লক্ষ্মী নারায়ণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। লক্ষ্মী নারায়ণ রাইস মিলের অন্যতম স্বত্বাধিকারী সুবোধচন্দ্র মণ্ডল ১৯৬০-৬১ সাল নাগাদ এলাকায় স্কুল গড়ার জন্য দু-বিঘা জমি দান করেন। সেই জমিতে মিলের নামে নাম মিলিয়ে গড়ে ওঠে লক্ষ্মী নারায়ণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
প্রশ্ন : বানু পালের পুরো নাম কি আপনার মনে পড়ে?
উত্তর : ভাল নাম বাণেশ্বর। বাণেশ্বর পাল।
প্রশ্ন : তাঁকে কি আপনি দেখেছিলেন?
উত্তর : দেখেছি। বানু পাল ১৯৯৮ নাগাদ মারা যায়।
প্রশ্ন : এখন যে খেয়া দেয় সে বানু পালের কে হয়?
উত্তর : বানু পালের পরে ওর ছেলে বলাই পাল খেয়া দিত। তারপর বলাই পালের ছেলে পূর্ণ পাল দিত। এখন পূর্ণ পালের ছেলে দিলীপ পাল খেয়া দেয়। (তারিখ : ০৯.০৩.২০১৯)
সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে চুক্তির ভিত্তিতে পালেরা এই খেয়া দেন না। নিজেদের উদ্যোগে কয়েক পুরুষ ধরে তাঁরা এই খেয়া চালিয়ে যাচ্ছেন। হাতানিয়া-দোয়ানিয়ার দু-পাড়ে এখানে জেটিঘাট নেই, যাত্রী প্রতীক্ষালয় নেই, একটা ছোট্ট ডিঙি আর দাঁড়-বৈঠা—দিলীপ পালের সম্বল বলতে এইটুকু। প্রথম খেয়া ছাড়ে সকাল ৬টায়, আর শেষ খেয়া রাত ৮টায়। নির্দিষ্ট সময় পরপর এই খেয়া চলে না—লোক এলে দিলীপ পাল খেয়া ছাড়েন। নদীর ওপারের ঘাটে অপেক্ষমাণ যাত্রী দেখলে নিজের খেয়ালে খেয়ানৌকাটা নিয়ে আসেন। যাত্রী পিছু ভাড়া পাঁচ টাকা। মঙ্গলবার বাদ দিয়ে সপ্তাহের অন্য দিনগুলো গড়ে ১০০—১২০ জন যাতায়াত করে। মদনগঞ্জ, শিবনগরের পাড়ের জমিতে প্রচুর পরিমাণে উচ্ছে, পান চাষ হয়। চাষিরা পান ও উচ্ছে নিয়ে আসে এপাড়ে নারায়ণপুর পাইকারি মার্কেটে।
গণেশবাবু এখন উনষাট বছরের প্রৌঢ়, সম্পন্ন কৃষক। ১৯৯০ সালে তিনি উনত্রিশ বিঘা জমি-সহ পুরানো রাইস মিল কিনে নেন। নারায়ণপুর নাদাভাঙা মৌজা থেকে তিনি এখানে এসেছিলেন। কঠোর পরিশ্রম করে একে একে সংলগ্ন অবতলের বেশ কিছু জমি কিনেছেন। বাড়িতে সাব-মার্শাল পাম্প বসিয়ে পানীয় জল সাপ্লাই করেন হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী দিয়ে যাওয়া ট্রলার ও বাংলাদেশি কার্গো জাহাজের কাছে। তাঁর দুই মেয়ে সকলেই শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। একমাত্র ছেলে কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গণেশবাবু ঘরের ভিতর থেকে কিছু কাগজপত্র নিয়ে এলেন—দুই পারের গ্রামবাসীদের সই-সম্বলিত সেইসব আবেদনপত্র তাঁর উদ্যোগেই একসময় দেওয়া হয়েছিল পঞ্চায়েত অফিস থেকে ব্লক উন্নয়ন আধিকারিককে। যদিও এখনো তাঁরা জেটিঘাট বা যাত্রী প্রতীক্ষালয় কিছুই পাননি।
মধ্যাহ্ন পেরিয়ে সূর্য ততক্ষণে হেলেছে পশ্চিমে। দুপুরে খেতের সবজি, পুকুরের মাছ দিয়ে দুটো ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলেন গণেশবাবু। এবার আমরা যাব আরো দক্ষিণে ঈশ্বরীপুর খেয়ায়। গৃহকর্তা অবাধ্য অতিথিদের দুপুরে খাওয়াতে পারেননি বটে, তবে আমাদের ঝুলিতে গুঁজে দিতে পেরেছিলেন তাঁর বাগানের কচি শসা। ইতিহাস কিছুটা কুড়িয়ে-বাড়িয়ে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটি খেয়া ছেড়ে আরেকটি খেয়ার দিকে যেতে গিয়ে ইঁটের পাঁজা, রাইস মিলের পুরানো পাঁচিল পেরিয়ে রাস্তায় নামতেই ডানদিকে চোখে পড়ে গণেশবাবুর সবজির বিস্তৃত খেত—আমরা দেখতে থাকি অবিরত বাংলার মুখ। কানে বাজতে থাকে—“ঈশ্বরীপুর থেকে ফেরার পথে দুটো খেয়ে যাবেন স্যার।”
নামখানা-নারায়ণপুর খেয়া
হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর এই খেয়া ছিল কাকদ্বীপ-নামখানার মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। সম্প্রতি নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ব্রীজ। লোকসভা ভোটের আগে সবাই ব্যস্ত। আসার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত হতে পারেননি। ৭ মার্চ ২০১৯ নবান্ন থেকে বোতাম টিপে তিনি তা উদ্বোধন করে দিয়েছেন। ব্রীজের কাজ যেহেতু এখনো একটু বাকি, তাই খেয়া-নির্ভরতা এলাকার মানুষের যায়নি আজও। তবে গাড়ি চলাচলের জন্য ব্রীজ পুরোপুরি খুলে গেলে খেয়ার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট মাঝি ও শ্রমিকরা পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়বেন।
স্বাধীনতার আগে থেকেই এই খেয়া শুরু হয়েছিল। তখন ছিল এক পয়সার খেয়া। সেসময় এখানে মাঝি ছিলেন রাজেন্দ্রনাথ মাইতি (২০০১-২০০২ সাল নাগাদ তিনি গত হয়েছেন), আশুতোষ নন্দী, দেবু শেখ ও সুধীর সিংহ। এখন নামখানা পঞ্চায়েত সমিতি এই খেয়ার দায়িত্বে আছেন। দিনে গড়ে চোদ্দ থেকে পনেরো হাজার লোক এই খেয়া দিয়ে যাতায়াত করেন। নদীর দুই পাড়েই আছে পাকা জেটিঘাট ও যাত্রী প্রতীক্ষালয়। খেয়ানৌকার সংখ্যা ৩। ভাড়া দু-টাকা। স্পেশাল খেয়ানৌকার সংখ্যা ১৬—১৮টি। প্রতিটি নৌকাই যন্ত্রচালিত ভুটভুটি। যেসমস্ত যাত্রী স্পেশাল খেয়ায় উঠবেন তাঁদেরকে নৌকায় দু-টাকা, ওপরে ঘাটে দু-টাকা—মোট চারটাকা দিতে হবে। দু-চাকার মোটর সাইকেল পার করে অবশ্য মাঝিদের আয় বেশি হয়।
প্রথম খেয়া ছাড়ে সকাল ৬টায়। আর শেষ খেয়া ছাড়ে রাত ১০টায়। তবে স্পেশাল খেয়া ভোর ৪টে থেকে পাওয়া যায়, রাত ১২টা পর্যন্ত চলে। প্রতি ৫ মিনিট পরপর খেয়া চলে। সপ্তাহের প্রতিদিনই এখানে কম-বেশি লোক যাতায়াত করে। শনি ও রবিবার বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ, হেনরি আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য প্রচুর টুরিস্ট এই খেয়া ব্যবহার করেন।
আমরা কথা বলেছিলাম এই ঘাটের ২৩ বছরের অভিজ্ঞ মাঝি বরুণ মাইতির (বয়স ৪৮, নামখানা) সঙ্গে। তখন পাশে ছিলেন সহকারী মাঝি বরুণ মাইতির ছেলে সুমন মাইতি (বয়স ১৮, নামখানা)।
বরেন্দু মণ্ডল : হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর ওপর এই যে ব্রীজ হয়েছে, আপনারা কি ব্রীজের পক্ষে?
বরুণ মাইতি : সুন্দরবনের উন্নয়ন হোতি গেলি তো বিরিজ লাগবে।
প্রশ্ন : ব্রীজ হলে তো খেয়ায় আপনাদের যাত্রিসংখ্যা কমে যাবে?
উত্তর : তা যাবে। বিরিজ হোলি অন্য কাজ করতি হবে।
প্রশ্ন : আপনারা কতজন এই ঘাটে খেয়ানৌকা চালানোর কাজে যুক্ত আছেন?
উত্তর : ৫৫—৬০ জন এখানে আছে।
প্রশ্ন : সবাই কি খেয়ানৌকার শ্রমিক?
উত্তর : না না। প্রতি নৌকায় মালিক বা মালিকের ছেলে থাকে। আর আমরা দুজন করে শ্রমিক থাকি।
প্রশ্ন : আপনারা দৈনিক কত টাকা মজুরি পান?
উত্তর : আগে দুশো আশি টাকা মজুরি পেতাম। গত ফেব্রুয়ারি (২০১৯) থেকে বেতন চারশো টাকা হয়েছে।
প্রশ্ন : ব্রীজ হলে যাত্রিসংখ্যা যখন কমে যাবে, তখন কি মালিক একই হারে মজুরি দেবেন?
উত্তর : কোত্থেকে দেবে? দেবে না হয়তো।
প্রশ্ন : আপনারা কি বিকল্প কোনো কাজের কথা ভেবেছেন?
উত্তর : ভাবতিছি। কেউ হয়তো ট্রলারে যাবে। কেউ মাটি কাটবে। কেউ রাজমিস্ত্রির হেল্পারের কাজ করবে। কেউ হয়তো কাজের জন্য চেন্নাই, কেরালায় যাবে। কিছু একটা কাজ দেখে নিতি হবে। (সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : ০৯.০৩.২০১৯)
বরুণ মাইতি রাজেন্দ্র মাইতির উত্তরপুরুষ। চার পুরুষ ধরে তাঁরা এই ঘাটে খেয়া পারাপার করেন। ভীম দাসের (মালিক) নৌকায় কাজ করেন তাঁর ছেলে (সঞ্জয় দাস) ও দুজন শ্রমিক—বরুণ মাইতি ও ভোলা পাল। নদীর দুধারে দুটি স্তম্ভ ব্রীজের স্পর্ধিত আকাশসীমাকে ঘোষিত করছে। নদীর জলে খেয়ানৌকার আনাগোনা এখনো বিরামহীন। জোয়ান ছেলে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে, তবু বরুণ মাইতির চোখে-মুখে রোদপোড়া কালচে শরীরে বারবার একটা আতঙ্ক ফুটে ওঠে।
আমরা কথা বলেছিলাম রণজিৎ সিংহের (বয়স ৪২, নামখানা) সঙ্গে। তাঁর বাবা সুধীর সিংহ ছিলেন এই ঘাটের পুরানো মাঝি।
বরেন্দু মণ্ডল : আপনি কোন সাল থেকে এখানে খেয়া দিচ্ছেন?
রণজিৎ সিংহ : সাল মনেনি। তবে পাঁচ পয়সার সময় থেকে খেয়া দেই।
প্রশ্ন : ব্রীজ তো প্রায় শেষ পর্বে, আর কতদিন খেয়া চালাতে পারবেন মনে হয়?
উত্তর : যতদিন খেয়া চলে, ততদিন খেয়া চালাতি হবে।
রণজিৎ সিংহের সঙ্গে কথা বলার মাঝে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন বিপন্ন আরো কয়েকজন মাঝি—বনকুমার শীট (বয়স ৬২, পয়সার আমল থেকে কাজ করছেন, নামখানা), রামহরি মণ্ডল (বয়স ৪০, নারায়ণগঞ্জ), গোপাল বারিক (বয়স ২৫, নামখানা), শেখ সাবির (বয়স ২২, নামখানা), অনুপ মাইতি (বয়স ২৫, দেবনগর)।
প্রশ্ন : এখন খেয়ামাঝিদের অবস্থা কেমন?
উত্তর : দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অনেকে, তবে যতদিন খেয়া চুলতেছে, ততদিন চালাতি হবে।
প্রশ্ন : আর বন্ধ হয়ে গেলে?
উত্তর : একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে অন্য কিছু করতি হবে।
একদিকে উন্নয়ন অন্যদিকে কাজ হারানোর আশঙ্কার মাঝে বনকুমার শীটের রোদপোড়া মুখের ভাঁজগুলো আরো খয়াটে, আরো পাণ্ডুর হয়ে যেতে থাকে। মা দুর্গা সবে এসে থেমেছে। নারায়ণপুর ঘাট ছেড়ে জ্বলজ্বলে চোখদুটো সামনে রেখে এম. ভি. মা লক্ষ্মী ট্রলারটা তখন যাচ্ছে আরো দক্ষিণে, নদী-খাঁড়ি যেখানে অতল নীলের সঙ্গে মেশে। (এই পর্বে আমরা কথা বলেছিলাম বরুণ মাইতি, সুমন মাইতি, বনকুমার শীট, রণজিৎ সিংহ, রামহরি মণ্ডল, গোপাল বারিক, শেখ সাবির, অনুপ মাইতির সঙ্গে। তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।)
খেয়ার এই উদাহরণ আরো দীর্ঘায়িত করা যায়। আমাদের মূল কাজটি বস্তুত সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে চলেছে। পাঠকের জন্য কয়েকটি খেয়ার কথা এখানে কেবল তুলে ধরলাম।
দুর্গা-দোয়ানি নদীর এক পারে আরামপুর, অন্য পারে বালি-বিরাজনগর। সেদিন (১৬.০৩.২০১৯) খেয়াঘাটে বসে আমরা কথা বলছিলাম খেয়ার বর্তমান মালিক জন্মেঞ্জয় বৈরাগী, টমাস দাস ও শঙ্কর বায়েনের সঙ্গে। তাঁদের কাছ থেকেই জানতে পারি—বিরাজনগর-আরামপুর ফেরিঘাটের আদি মাঝি মহেন্দ্র পাত্র এখন জীবিত আছেন। শেষ গোধূলির আলোয় প্রথম দেখেছিলাম তাঁকে। খেয়াঘাট থেকে দক্ষিণে ঢিলছেঁাড়া দূরত্বে খড়ের দুটো চালাঘর, চার-সন বৃষ্টি খেয়ে চালে গজিয়ে উঠেছে খোদি গাছের চারা। মাটির দাওয়ায় বসে আমাদের দেখে ১০৪ বছরের বৃদ্ধ তখন হাসছিলেন মিটিমিটি। ভাল করে তাকিয়ে দেখি—সত্যিই তো, ফোকলা গালে মাড়িতে গজিয়েছে ছোট্ট ছোট্ট নতুন দুটো দাঁত। এক পয়সার আমল থেকে তিনি খেয়া দিতেন। সাহেবের স্টেটে পানসি চালানোই ছিল তাঁর কাজ। গোসাবায় রবীন্দ্রনাথ যখন এসেছিলেন (১৯৩২), তখন তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন। ওড়িশার কটক থেকে গোসাবায় এসে প্রথমে জঙ্গল করতেন, পিঠে বাঘের থাবার দাগ লুকায়নি এখনো। আশপাশের পাড়ার কৌতূহলী মানুষজনের জটলায় তখন সামনের ছোট্ট উঠানটা ভরে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় না-লেখা এক ইতিহাসের কথা ধীরে ধীরে বুড়ো মানুষটা বলে চলেন। এরকম অজানা কত লোক-ইতিহাস, লোককথা, লোকশ্রুতি সুন্দরবনের পথে-ঘাটে ছড়িয়ে আছে কে জানে! এটুকু বুঝতে পারি—খেয়া শুধু নদীর দু-পারের যোগাযোগের মাধ্যম নয়, খেয়া আসলে নিজেই একটি সংস্কৃতি।
তথ্যসূত্র
১. ‘মাঝি’, রবীন্দ্র-রচনাবলী, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলিকাতা, ১৩৯৩, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ৪০
২. ‘অন্নদামঙ্গল’, ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলিকাতা, পৃঃ ১৩৬
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়