ভাষার একটি সহজাত গুণ হল প্রবহমানতা। প্রবহমান ভাষার তাই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কালের প্রবহমান ধারায় এক ভাষা থেকে জন্ম হয়েছে অন্য ভাষা । তবে এই পরিবর্তনের রূপরেখা নির্মাণের ও সংস্কার সাধনের প্রয়োজনে রূপায়িত হয় ব্যাকরণ এবং অভিধান গ্রন্থমালা। পরিবর্তনশীল বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সময়ে যেভাবে শব্দ সম্ভার বেড়েছে তা ধরা রয়েছে নির্মিত অভিধান গ্রন্থসমূহে। বাংলা ভাষাচর্চার সেই মূলবান অভিধান চর্চার দিকটির সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নির্মিত হয়েছে  এই রচনায়।

অভিধানের কাজ নানাবিধ। ভাষা ক্রমাগত বদলে চলেছে তার রূপ। ভাষার এই বিবর্তন দু-পাঁচ বছরে ধরা না গেলেও দু-পাঁচ দশকে বেশ ভালভাবেই বোঝা যায়। ভাষার এই বিবর্তনের ছবিটা ধরা থাকে অভিধানে। তাই কেউ কেউ অভিধানকে বলেন ভাষার দর্পণ। এই অভিধানই আবার হয়ে ওঠে ভাষার নিয়ন্তা, তার নির্দেশক। অভিধানহীন কোনো আধুনিক উন্নত ভাষা কল্পনাই করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পসল্প’-এর ‘অদ্ভুত-রত্নাকর’ সভার প্রধান পণ্ডিত বাচস্পতি মশাই বোধহয় তাই বলেছিলেন : “ভাষার শব্দগুলো চলে অভিধানের আঁচল ধরে। এই গোলামি ঘটেছে ভাষার কলিযুগে। সত্যযুগে শব্দগুলো আপনি উঠে পড়ত মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই মানে আনত টেনে।”১ রবীন্দ্রনাথ নিজে যে এই অভিধানের গোলামির প্রয়োজনীয়তা বুঝতেন তার প্রমাণ রয়েছে ৩০ মার্চ ১৯০৫-এ ক্লাসিক থিয়েটারে আয়োজিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে।২ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে সেই সভায় ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণে রবীন্দ্রনাথ তাদের ‘দেশি ভাষার ব্যাকরণ চর্চা’ ও ‘অভিধান সংকলন’ করতে আহ্বান জানান।৩ কিন্তু অভিধান তো আর কেবল ভাষার হয় না, বিষয়-অভিধানও হতে পারে। তবে বর্তমান আলোচনাটিকে আমরা কেবল বাংলার ভাষাভিধানের মধ্যেই আবদ্ধ রাখব। বাংলা ভাষাভিধানের নানা অভিমুখকে বুঝে নেওয়াই বর্তমান নিবন্ধের মুখ্য অভিপ্রায়।

আস্‌-সুম্পসাঙ-এর ব্যাকরণ ও অভিধানের (১৭৪৩) আখ্যাপত্র

এক

রবীন্দ্রনাথের এই প্রস্তাবের একশো বাষট্টি বছর আগেই বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-চর্চা ও শব্দসংগ্রহের কাজটা শুরু করেছিলেন এক পর্তুগিজ মিশনারি—মানোয়েল দা আস্‌-সুম্পসাঙ। তাঁর Vocabulario Em Idioma Bengalla, E Portuguez প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৪৩ সালে লিসবন থেকে। তখনো বাংলা হরফের উদ্ভাবনে এগিয়ে আসেননি পঞ্চানন কর্মকার বা চার্লস উইলকিন্সের মতো প্রথম যুগের বাংলা হরফের নির্মাতারা। ফলে আস্‌-সুম্পসাঙের এই বাংলা শব্দসংগ্রহটি ছাপা হয়েছিল রোমান হরফেই; আর তাই রোমান বর্ণানুক্রমে, পর্তুগিজ উচ্চারণ মেনেই বাংলা শব্দগুলোকে সাজিয়েছিলেন তিনি। গ্রন্থের ‘মুখবন্ধ’ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কোন উদ্দেশ্য তাঁকে এই শব্দসংগ্রহে প্রাণিত করেছিল—“পাঠক বন্ধু ও নবীন প্রচারক মহাশয়, আশা করি ধর্মশক্তি লইয়া, খ্রীষ্টের অন্তরঙ্গজনোচিত প্রেম লইয়া, এবং যীশুখ্রীষ্ট ধর্মে সকল জগতকে দীক্ষিত করিবার, সঙ্ঘের বুকে পথভ্রষ্ট সম্তানগুলিকে ফিরাইয়া আনিবার মত উৎসাহ লইয়া বঙ্গদেশে আসিয়াছ এবং এই অভিপ্রায়ে মূল হইতে বঙ্গভাষা শিখিতে চাহিতেছ।” তাঁর মতে—“যে প্রচারক তাহার ধর্মগোষ্ঠীর ভাষা জানে না সে প্রচারক হইবার উপযুক্ত নহে।” কারণ “যাহার নিজ ধর্মাধিকার ভুক্ত জনগণের ভাষার জ্ঞান নাই—সেও স্বভাবতঃ তাহাদের পরিচালক হইবার অনুপযুক্ত।”৪ ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর মতো এমন অনেক খ্রিস্টীয় যাজকই এদেশে এসেছিলেন, যাঁরা ধর্মপ্রচারের তাগিদে স্থানীয় ‘জনগণের ভাষার জ্ঞান’ আয়ত্ত করতে বিশেষ আগ্রহী। আর সেই আগ্রহ থেকেই তাঁরা এই দেশীয় ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধান প্রণয়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই তালিকায় নির্দ্বিধায় উইলিয়াম কেরির নামটা যোগ করা যায়, যদিও তিনি এই অভিধান সংকলনের কাজটি করেছিলেন উনিশ শতকে।

অষ্টাদশ শতকে আস্‌-সুম্পসাঙ ছাড়া আরো তিনটি অভিধানের সন্ধান দিয়েছেন যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য।৫ ১৭৮৮ সালে লন্ডন থেকে মুদ্রিত The Indian Vocabulary, ১৭৯৩ সালে ক্রনিক্যাল প্রেস থেকে মুদ্রিত ইংরেজি ও বাঙালি বোকেবিলরি এবং ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত হেনরি পিট্‌স ফরস্টারের ইংরেজি-বাংলা অভিধান। ফরস্টারের অভিধানটির দ্বিতীয় খণ্ড (বাংলা-ইংরেজি অভিধান) প্রকাশিত হয়েছিল ১৮০২ সালে।

আস্‌-সুম্পসাঙ তাঁর অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন ধর্মীয় উদ্দেশ্যে, আর ১৭৮৮ সালের The Indian Vocabulary-র অনামা সংকলকের উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক। স্পষ্ট জানিয়েছিলেন তিনি—পূর্বভারতীয় জনগোষ্ঠীর আচার-ব্যবহার বুঝতে এবং দেশ-শাসনের জন্যই (‘better understanding of East India affairs’) প্রয়োজনীয় শব্দ-সংকলন করা হয়েছে তাঁর অভিধানে।৬ প্রায় দেড়হাজার শব্দবিশিষ্ট এই অভিধানের অধিকাংশই গৃহীত হয়েছিল আরবি, ফারসি ও হিন্দুস্থানি শব্দভাণ্ডার থেকে। আস্‌-সুম্পসাঙের অভিধানের মতো এই বইটিও ছাপা হয়েছিল রোমান অক্ষরে, রোমান বর্ণানুক্রম মেনেই।

১৭৯৩ সালের ক্রনিক্যাল প্রেসের অভিধানটিরও উদ্দেশ্য প্রায় একই, তবে তার পরিসর খানিক বিস্তৃত। সংকলক জানিয়েছেন, তিনি কেবল শাসক ইংরেজের শাসিতের ভাষা আয়ত্ত করার সুবিধার্থে এই বই লেখেননি, বাঙালি লোকেও যাতে ‘ইংরেজি কথা’ শিখতে পারে সেদিকটিও এই অভিধান প্রণয়নকালে মাথায় রাখা হয়েছে।৭ মনে রাখা প্রয়োজন, এই উপনিবেশের বিপুল প্রশাসনিক কাজ খানিক সস্তায় চালানোর জন্য দেশীয় কলমচি বা ‘রাইটার’ নিয়োগের উদ্দেশ্য নিয়ে ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাইটার্স বিল্ডিং। ফলত কিঞ্চিৎ ইংরেজি-জানা দেশীয় লোকদের প্রয়োজন অনুভূত হতে শুরু করেছে এতদিনে। তারই স্পষ্ট প্রতিফলন এই অভিধান। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, অভিধানটিতে তৎসম ও তদ্ভব শব্দ যৎসামান্যই, দেশি শব্দই সংখ্যায় বেশি। যতীন্দ্রমোহন এই অভিধানের শব্দসজ্জাকে বর্ণানুক্রমিক বললেও আধুনিক অর্থ তাকে কোনোভাবেই বর্ণানুক্রমিক বলা চলে না।৮

১৭৯৯ সালে প্রকাশিত হেনরি পিট্স ফরস্টারের অভিধানটির প্রথম খণ্ড নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮০২ সালে এই অভিধানের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ডটি ইংরেজি-বাংলা ও দ্বিতীয় খণ্ডটি বাংলা-ইংরেজি অভিধান। প্রথম খণ্ডটি রোমান বর্ণানুক্রমে রোমান অক্ষরে মুদ্রিত আর দ্বিতীয় খণ্ডে অ-কারাদি বর্ণানুক্রম মেনেই বাংলা শব্দগুলিকে সাজানো হয়েছে। ফরস্টারের মতে তাঁর অভিধানটি ‘temporary work’, অর্থাৎ এই অভিধান তার সমসময়ের বাংলা ভাষাকে ধরতে চেয়েছে। আর অভিধানকার তাঁর সমসময়ে প্রচলিত বাংলা ভাষায় স্পষ্ট দুটো ‘dialect’ লক্ষ্য করেছেন—‘polite’ এবং ‘vulgar’,৯ আমাদের আজকের পরিভাষায় যাকে বলে সাধু আর চলিত ভাষা। ফরস্টার এই দুই শ্রেণির শব্দকে সমান গুরুত্বে তাঁর অভিধানে স্থান দিয়েছেন। সেখানে ‘অগ্রে’-র পাশে ‘আগে’, ‘আচম্বিতে’-র পাশে ‘আচমকা’, ‘অযথা ব্যয়’-এর পাশে ‘উড়নচন্ড্যা’, বা ‘পরিশ্রম’-এর পাশে ‘খাটনী’-র স্থান পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

আস্‌-সুম্পসাঙ-এর ব্যাকরণ ও অভিধানের (১৭৪৩) প্রথম পাতা

আস্‌-সুম্পসাঙ-এর ব্যাকরণ ও অভিধানের (১৭৪৩) প্রথম পাতা

ঊনবিংশ শতকের পূর্বে আরো তিনটি অভিধানের সন্ধান দিয়েছেন অসিতাভ দাস এবং প্রদোষকুমার বাগচী।১০ পর্তুগিজ জেসুইট মিশনারি ফাদার মার্কস আন্তনিও সাঁতুচি ১৬৭৯ থেকে ১৬৮৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁর কয়েকজন সহযোগীর সাহায্যে একটি পর্তুগিজ বাংলা অভিধান সংকলন করেছিলেন, যদিও তার কোনো বিবরণ মেলে না। আর, লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের গ্রন্থাগারে আরো একটি পর্তুগিজ বাংলা অভিধানের পাণ্ডুলিপির সন্ধান দিয়েছেন তাঁরা। এই পাণ্ডুলিপিটি নিঃসন্দেহে ১৭৮৭ সালের পূর্ববর্তী সময়ের। শ্রীদাস ও শ্রীবাগচীর বিবরণ মোতাবেক, এই পাণ্ডুলিপিতে পর্তুগিজ শব্দের প্রতিশব্দরূপে তৎসম ও তদ্ভব শব্দের পাশে প্রচলিত আরবি, ফারসি শব্দও সংকলিত হয়েছে। সর্বোপরি ১৭৭৪-৭৫ সালে ন্যাথানিয়েল ব্রেসি হ্যালহেডের বাংলা ভাষার শিক্ষক জনৈক অনামা মুন্সি দুহাজার বাংলা শব্দবিশিষ্ট একটি একশো পাতার অভিধান সংকলন করেছিলেন। হ্যালহেড তখন কোম্পানির ফারসি অনুবাদকরূপে কর্মরত, ফলত তাঁর প্রয়োজনে এই অভিধানে বাংলা শব্দগুলির ফারসি প্রতিশব্দ দেওয়া হয়েছে। নিত্যব্যবহার্য প্রচলিত শব্দগুলির লৌকিক রূপটিকে নির্দ্বিধায় তাঁর অভিধানে স্থান দিয়েছিলেন এই মুন্সি। কাউয়া (কাক), কেঁথা (কাঁথা), কৈতার (কবুতর)-এর মতো শব্দ সেই অভিধানে বিরলদর্শন নয়।

উপরি-উক্ত বিবরণ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী বাংলা অভিধানসমূহের তিনটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, এই অভিধানগুলি চরিত্রগতভাবে দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক। দ্বিতীয়ত, এগুলি মূলত ইউরোপীয়দের প্রয়োজনে সংকলিত। তৃতীয়ত, এই অভিধানগুলিতে শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তথাকথিত সাধু শব্দ এবং চলিত শব্দের মধ্যে কোনো ভেদ করা হয়নি, বরং প্রচলিত দেশি-বিদেশি শব্দকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া
হয়েছে।

দুই

এই ধরনের দ্বিভাষিক অভিধান উনিশ শতকের গোড়াতেও বেশ কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে। সেই তালিকার গোড়াতেই অবশ্য ফরস্টারের অভিধানের দ্বিতীয় খণ্ডটির উল্লেখ করতে হয়। ১৮০৯ সালে হিন্দুস্তানি প্রেস থেকে প্রকাশিত, লেখকের নামহীন সংস্কৃত-বাংলা অভিধান। তারপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সহকারী গ্রন্থাগারিক মোহনপ্রসাদ ঠাকুরের ইংরেজি-বাংলা অভিধান। যদিও জেমস লঙের তালিকা মোতাবেক এই বই বেরিয়েছিল ১৮০৫ সালে, কিন্তু বাস্তবে ১৮১০ সালের প্রথম সংস্করণই আজ পর্যন্ত গবেষকদের হাতে এসে পৌঁছেছে। এই সংস্করণটির আখ্যাপত্র থেকে বোঝা যায়, মোহনপ্রসাদ এই অভিধানটি বানিয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের ব্যবহারের জন্যই।১১ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছিল ১৮১৫ সালে এবং তৃতীয় সংস্করণ ১৮৫২-এ।

তবে এই পর্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অভিধানটি হলো শ্রীরামপুর মিশন প্রেস মুদ্রিত, উইলিয়াম কেরি প্রণীত বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক অভিধানটি। কেরির অভিধানটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮১৫ সালে। সেটি এখন দুর্লভ। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ। আর ১৮২৫-এ একযোগে ছাপা হয় প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ এবং দ্বিতীয় খণ্ড। এই অভিধানেই প্রথম বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তি দেওয়া হলো। এর পূর্বে কোনো অভিধানকার এই চেষ্টা করেননি। ১৮১৮ সালের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা থেকে স্পষ্ট, বাংলা ভাষা যে সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত—এ ছিল কেরির দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর মতে, বাংলা শব্দভাণ্ডারের তিন-চতুর্থাংশেরও অধিক শব্দ আদতে খাঁটি সংস্কৃত। অবশিষ্ট শব্দসমূহের অধিকাংশই এত স্বল্প বিবর্তিত হয়েছে যে, তার মূল নির্দেশ করা খুব একটা কঠিন নয় বলেই তিনি মনে করেন।১২ যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের মতে, কেরির অভিধানখানি নামে ‘বাংলা ভাষার অভিধান কিন্তু মূলত সংস্কৃত শব্দকোষ মাত্র।’১৩ লক্ষণীয়ভাবে, ফরস্টারকেও তাঁর অভিধানের ভূমিকায় অনুরূপ মত প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল। তাঁর মত ছিল—তৎকালীন অপূর্ণ অবস্থাতেও, বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাষাই সর্বাপেক্ষা সংস্কৃত-অনুসারী।১৪

তবে কেরির ১৮১৮-র দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশের পূর্বেই ১৮১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আরো একটি বাংলা অভিধান। অভিধানকার রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, অভিধানটির নাম বঙ্গভাষাভিধান। এই প্রথম বাংলা ভাষায় এমন একটি অভিধান সংকলন করা হলো, যেখানে বাংলা শব্দের বাংলা অর্থ প্রদত্ত হয়েছে। অভিধানকার তাঁর ‘ভূমিকা’য় জানিয়েছেন, তাঁর স্বদেশবাসীদের অনেকেই পত্র বা দলিলাদি লিখতে গিয়ে সাধু ভাষার অভাব অনুভব করেন। সেই অভাব দূর করতেই তিনি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত প্রচলিত সকল বাংলা শব্দ সংগ্রহ করে তাদের মূল ও প্রতিশব্দ-সহ এই অভিধান সংকলন করেছেন।১৫ বোঝাই যায়, এই অভিধান তৎসম শব্দবহুল। উইলিয়াম কেরি যে এই অভিধানটিকে সমজাতীয় অন্য অভিধানগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলবেন তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে!১৬

ফরস্টার বা কেরির এই সংস্কৃতমুখী বাংলার ধারণা সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে বাংলা ভাষার অভিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে এসেছে। ফরস্টার বাংলা ভাষাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন। তিনি তাঁর অভিধানের ভূমিকায় ফারসির বদলে বাংলা ভাষাকে বাংলার আইন-আদালতের ভাষা করে তোলার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।১৭ তাঁর আগে এই একই মত প্রকাশ করেছিলেন হ্যালহেড তাঁর ব্যাকরণ বইয়ে। আর আইনি দলিল-দস্তাবেজের ভাষাকে যাতে সংস্কৃতানুসারী করে তোলা যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ রচনা করেছিলেন তাঁর অভিধান। এই সংস্কৃতানুগ বাংলা সাধু ভাষা প্রণয়নে বাংলার অভিধানকাররা কতখানি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, এ থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এর প্রভাব কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, একটি ছোট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে।

কেরির অভিধানের প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণের (১৮১৮) আখ্যাপত্র

রাজা রামমোহন রায় বাংলা ভাষার দুটি ব্যাকরণ গ্রন্থের রচয়িতা। প্রথমটি তিনি লিখেছিলেন ইংরেজি ভাষায়, উদ্দিষ্ট পাঠক বাংলা শিখতে আগ্রহী ইউরোপীয়রা। বইটির শিরোনাম বেঙ্গলি গ্রামার ইন দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ (১৮২৬)। আর দ্বিতীয় বইটি তিনি লিখেছিলেন বাঙালি ছাত্রদের কথা মাথায় রেখে, বাংলা ভাষায়। নাম গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩)। প্রথম বইটিতে বৈয়াকরণ রামমোহন কোনো হুকুমনামা জারি করেননি। তাঁর ব্যাকরণের সূত্রগুলি নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া সাধারণ সূত্র। এ বইটি পড়লে মনে হয়, যে-ভাষাকে বুঝতে চাইছেন তিনি, যেন তার বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে সেই ভাষাকে নিরীক্ষণ করতে চাইছেন তদ্‌গতভাবে। ইংরেজি ব্যাকরণ বইটিতে ‘ইমম্পারেটিভ মুড’ বা অনুজ্ঞার ভবিষ্যৎ কালের মধ্যম পুরুষের উদাহরণস্বরূপ রামমোহন ‘তুমি বা তোমরা মারিও’—এই বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। মূল পাঠে ক্রিয়ার এই সাধু রূপটি দিলেও পাদটীকায় ‘মেরো’, ‘খেয়ো’ প্রভৃতি চলিত রূপও দেখাচ্ছেন তিনি।১৮ কিন্তু বাংলায় লেখা গৌড়ীয় ব্যাকরণ-এ এই কথ্যরূপকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিচ্ছেন রামমোহন। অর্থাৎ বাঙালি ছাত্রদের সামনে তিনি তুলে ধরছেন শুধুমাত্র সাধু রূপটি। মনে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গভাষাভিধান-এর প্রণেতা রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ছিলেন রামমোহন-প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের প্রথম আচার্য। এমন দাবি আমরা মোটেই করতে চাইছি না যে, উনিশ শতক জুড়ে বাংলা ভাষার অন্যান্য সমান্তরাল ধারাগুলি ছিল না। মুসলমানি বাংলার সমান্তরাল প্রকাশনা বা হুতোমের মতো দু-একজন দলছুটের কথা মাথায় রেখেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উনিশ শতকে বাংলা ভাষার প্রধান লিখিত রূপটি ছিল এই তৎসম শব্দবহুল সাধু রূপ। আর সেই রূপ প্রণয়নে আঠারো-উনিশ শতকের বাংলার অভিধানকারদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের দেওয়া উনিশ শতকের প্রথম পর্বের বাংলা অভিধানের বিবরণ বা সরস্বতী মিশ্রের পরবর্তী পর্বের বিবরণ১৯ একটু খুঁটিয়ে পড়লে একথা অস্বীকার করার আর উপায় থাকে না যে, উনিশ শতকের বাংলা ভাষার অভিধানগুলি বড় মাত্রায় এই তৎসম শব্দপ্রীতির দ্বারাই আক্রান্ত ছিল।

তিন

অভিধানকার, প্রাবন্ধিক সুভাষ ভট্টাচার্যের মতে— উনিশ শতকে অভিধানের বিপুলতা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার অভিধান-সংকলন তার শৈশব দশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ১৯০৬ সালে সুবলচন্দ্র মিত্রের সরল বাঙ্গালা অভিধান প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নাকি বাংলা অভিধান সাবালকত্বের দাবিদার হয়ে ওঠে।২০ যদিও সেই সাবালকত্ব নিয়ে যে নানা প্রশ্ন তোলা যায়, সেকথা তিনি অস্বীকার করেননি। তাঁর অভিধানের প্রথম সংস্করণে সুবলচন্দ্র যে তৎসম শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ গ্রহণ করেননি—সেকথা মাথায় রেখেই বোধহয় এই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন তিনি। যদিও পরবর্তী সংস্করণে অতৎসম শব্দও এই অভিধানে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এই অভিধান প্রকাশের পর থেকেই বাংলা অভিধান সংকলনের চরিত্র যে অনেকটা বদলে গিয়েছিল—সেই ঐতিহাসিক সত্যটিকেই বিশেষভাবে জোর দিতে চেয়েছেন শ্রীভট্টাচার্য। সুবলচন্দ্র কিছু জীবনচরিত এবং বাংলা উপন্যাস ও নাটকের কিছু চরিত্রকে মুখশব্দ হিসাবে রেখেছিলেন। শব্দাভিধানে এটা আর কোনো অভিধানকারের কাছে প্রয়োজনীয় বলে বোধ হয়নি। কিন্তু অভিধানে যে এহেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা চলে—এব্যাপারটা বোধহয় এর পরেই আলাদা করে ভাবতে শুরু করেছিলেন বাংলা অভিধান-প্রণেতারা। সুবলচন্দ্র মিত্র থেকে সংসদ বাংলা অভিধান পর্যন্ত অভিধানগুলিতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেল।

১৯১৩ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বাংলা শব্দকোষ। যোগেশচন্দ্র অভিধানের ‘সূচনা’য় জানিয়েছিলেন, প্রচারিত অধিকাংশ বাংলা অভিধানকেই আদতে সংস্কৃত অভিধান বলা চলে। যেসব শব্দ স্পষ্ট সংস্কৃত, উচ্চারণে না হলেও বানানে সংস্কৃত, সেসব শব্দের জন্য সংস্কৃত শব্দকোষ আছে। কিন্তু বাংলা প্রয়োগে যেসব সংস্কৃত শব্দের অর্থান্তর ঘটেছে কেবল সেইসব শব্দই তাঁর গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন যোগেশচন্দ্র। যেসব শব্দ এই অভিধানে পাওয়া যাবে না, তার জন্য সংস্কৃত শব্দকোষ দেখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।২১ অধিকাংশ শব্দেরই ব্যুৎপত্তি দেখানোর চেষ্টা করেছেন তিনি এই অভিধানে।

১৯১৭ সালে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস প্রকাশ করেন তাঁর বৃহৎ বাঙ্গালা ভাষার অভিধান। সংস্কৃত ও অসংস্কৃত উভয়বিধ শব্দের প্রতি সমদৃষ্টি রেখেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন। সেইসঙ্গে তাঁর অভিধানে স্থান পেয়েছে নানা লোকোক্তি। শব্দ ব্যাখ্যার পাশাপাশি মুদ্রিত ও লিখিত সাহিত্য থেকে আহরণ করে তিনি দেখিয়েছেন শব্দের প্রয়োগ।

১৯৩০-এ প্রকাশিত হলো রাজশেখর বসুর চলন্তিকা। ১৯২০ সালে বাংলা বানানের প্রমিতিকরণের উদ্দেশ্যে যে-বানানবিধি তৈরি করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বিধি মেনে প্রমিত বাংলা বানান এই অভিধানে দিলেন রাজশেখর। বাংলা চলিত বানানে ক্রিয়া রূপের বিশৃঙ্খলার কথা তাঁর অভিধানের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন রাজশেখর। ভাষায় প্রমিত বানানবিধি বেঁধে দেওয়া যেন তাঁর অভিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য। যে-অভিধানে চলিত বাংলার প্রমিত বানান বেঁধে দিতে চাইলেন তিনি, সে-অভিধানের ভূমিকাটা কিন্তু সাধু ভাষাতেই লিখলেন রাজশেখর! যিনি নিজে চলিত ভাষার প্রবল পক্ষপাতী ছিলেন এবং চলিত ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কারিগরও—তিনি কেন যে চলন্তিকায় সাধু ভাষার ব্যবহার করলেন তা ভেবে সত্যিই বিস্ময় জাগে।

বাংলা অভিধানে ব্যাপকভাবে ব্যুৎপত্তি দেখানো শুরু করেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুবলচন্দ্র মিত্র, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বা রাজশেখর বসু কেউই প্রতিটি শব্দের ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি নির্দেশ করেননি। জ্ঞানেন্দ্রমোহন তো বহু ক্ষেত্রেই কেবল ‘সং’ বলে ছেড়ে দিয়েছেন, অর্থাৎ ঐ শব্দটি সংস্কৃত থেকে আগত। যোগেশচন্দ্র ও রাজশেখরের অভিধানের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, সবক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি নির্দেশ সেই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ততটা খাপ খায় না। হরিচরণ বহু ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি দেখাতে গিয়ে শব্দের বিবর্তনই প্রায় দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি শব্দের প্রয়োগ দেখিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রেই। অনেক শব্দের প্রয়োগ দর্শাতে গিয়ে তিনি সংস্কৃত বাক্য বা বাক্যাংশও উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর দেখানো প্রয়োগ সাধারণ পাঠকের চেয়ে গবেষকের কাজে লাগে অনেক বেশি। হরিচরণের এই অভিধানটি ১০৫ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল দীর্ঘ তেরো বছরে (১৯৩৩ থেকে ১৯৪৬)। পরে এটি পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। আর স্বাধীনতার পর ভারত সরকার এই অভিধানটি দু-খণ্ডে প্রকাশ করেন।

তবে হরিচরণ পর্যন্ত বাংলা অভিধানের যে- পরিচয় পেশ করা হলো, তার সবকটিতেই অভিধানের ভূমিকা, নির্দেশিকা প্রভৃতি সাধু ভাষাতেই লিখেছেন আভিধানিকরা। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এমনকী চলিত শব্দের সমতাবিধান-প্রয়াসী রাজশেখর বসুও এর ব্যতিক্রম নন। সংসদ বাংলা অভিধান-এর পঞ্চম সংস্করণে প্রথম চলিত ভাষার ব্যবহার শুরু হলো। পরবর্তিকালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত আকাদেমী বিদ্যার্থী অভিধানও চলিত ভাষাই ব্যবহার করেছে।

চার

ক্রমে প্রমিত শব্দ থেকে আঞ্চলিক শব্দ বা অপশব্দের দিকেও নজর পড়তে শুরু করল। বাংলা ভাষায় প্রথম আঞ্চলিক অভিধান প্রণয়ন করলেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। পূর্ব-পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান।

পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রণয়নে ব্রতী হয়েছিলেন কামিনীকুমার রায়। ১৯৬৮ সালে (১৩৭৭ বঙ্গাব্দে) প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লৌকিক শব্দকোষ। এর তিন বছর পর ১৯৭১ সালে অভিধানটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন তিনি। দুই খণ্ড মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রচলিত প্রায় ২৫ হাজার লৌকিক শব্দ সংগ্রহ করেছিলেন কামিনীকুমার।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আরো একটি লৌকিক ভাষার অভিধান প্রণয়নে ব্রতী হয়েছিলেন। ছয়টি খণ্ডে অভিধানটির পরিকল্পনা করা হলেও মাত্র তিনটি খণ্ড প্রকাশের পর তা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় ভক্তিপ্রসাদ মল্লিকের অপরাধ জগতের ভাষা ও শব্দকোষ। এরপর ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় সত্রজিৎ গোস্বামীর বাংলা অকথ্যভাষা ও শব্দকোষ এবং ২০০৫-এ অভ্র বসুর বাংলা স্ল্যাং সমীক্ষা ও অভিধান। এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন—২০১৪ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত আব্দুল মান্নান স্বপন-এর গালি অভিধান।

ফরস্টার-এর অভিধানের প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণের (১৭৯৯) আখ্যাপত্র

পাঁচ

ওপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কোনো ভাষার অভিধান প্রণয়ন নানা উদ্দেশ্য বা নীতিকে সামনে রেখে করা সম্ভব। কেউ ভাষার প্রচলিত শব্দগুলিকে অভিধানভুক্ত করতে চাইতে পারেন, আবার কেউ শুধুমাত্র অপ্রচলিত শব্দগুলোকেই তাঁর অভিধানে স্থান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কেউ অভিধান প্রণয়নের জন্য বেছে নিতে পারেন শিষ্ট শব্দ, আবার কারো অভিপ্রায় হতে পারে ভাষার অশিষ্ট শব্দগুলিকে নিয়েই গড়ে তুলবেন একটি অভিধান। কেউ ভাষার মান্য শব্দের ভাণ্ডারটিকে তাঁর অভিধানের পুঁজি করতে চাইতে পারেন, আবার কেউ মান্য শব্দের এলাকা পেরিয়ে আঞ্চলিক শব্দে হয়ে উঠতে পারেন আগ্রহী। কিন্তু এমন কোনো সম্পাদকও থাকতে পারেন, যিনি প্রচলিত ও অপ্রচলিত, মান্য ও লৌকিক, শিষ্ট ও অশিষ্ট—সকল শব্দকেই তাঁর অভিধানে স্থান দিতে চান। হয়তো তাঁর অভিপ্রায় এমন কোনো অভিধান, যাতে ধরা থাকবে ভাষার সমস্ত শব্দ। জগন্নাথ চক্রবর্তী পরিকল্পিত জাতীয় অভিধানটি এই গোত্রের অভিধান।২২ বাংলা ভাষার সমস্ত শব্দকেই কেবল অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী ছিল না এই অভিধান, পরিকল্পনা ছিল—প্রতিটি শব্দের ব্যুৎপত্তি, পূর্ণ ব্যাকরণগত তথ্য এবং পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি কালানুক্রমে সাজানো থাকবে শব্দটির প্রাচীনতম থেকে আধুনিকতম প্রয়োগের দৃষ্টান্ত। সেইসঙ্গে থাকবে পরিভাষা, প্রয়োজনে থাকবে প্রধান ভারতীয় ও বেশ কিছু বিদেশি ভাষার শব্দের রূপ, থাকবে তুলনামূলক আলোচনা। কুড়ি খণ্ডে সমাপ্ত হবে এই অভিধান—এমনই ছিল পরিকল্পনা। প্রথম খণ্ডে আসতে পেরেছে ‘অ’ থেকে ‘অকস্মাৎ’ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি শব্দ। আদিস্বরকেও পুরোপুরি আনা যায়নি এই খণ্ডে।

স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে মূল অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির কথা, সপ্তম থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত যাবতীয় ইংরেজি শব্দ ধরা আছে যে-শব্দকোষে। কিন্তু বাংলা ভাষায় শেষপর্যন্ত তৈরি হয়ে উঠতে পারল না এমন অভিধান। ১৯৯৬-এ এর প্রথম খণ্ড বেরিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। প্রধান সম্পাদকের নেতৃত্বে একদল দিগ্‌গজ যে প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ করেছিলেন তা রীতিমতো সম্ভ্রম জাগায়। কিন্তু তারপর এর আর কোনো দ্বিতীয় খণ্ড বেরল না গত সাতাশ বছরে। সত্যিই কি বাংলা ভাষায় এমন কোনো অভিধান কখনো হবে—যেখানে ধরা থাকবে চর্যাপদের আমল থেকে আজ পর্যন্ত ব্যবহৃত বাংলা ভাষার সমস্ত শব্দ? দেওয়া থাকবে তাদের প্রতিটির উৎস আর স্থির করা থাকবে তাদের প্রয়োগের সীমা? এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র অনাগত কালই দিতে পারে।   

তথ্যসূত্র

১ ‘গল্পসল্প’, রবীন্দ্র রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, ১৩৬৮, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ১০৪২—১০৪৫
২ ‘গ্রন্থপরিচয়’, রবীন্দ্র রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০১, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ১১৯৪
৩ ‘আত্মশক্তি ও সমূহ’, রবীন্দ্র রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৩৬৮, ১২শ খণ্ড, পৃঃ ৭৩৩
৪ চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার ও সেন, প্রিয়রঞ্জন (সম্পাদক ও অনুবাদক), পাদ্রী মানোএল-দা-আস্-সুম্পসাঙ-রচিত বাংলা ব্যাকরণ, কলিকাতা ইউনিভার্সিটি প্রেস, কলিকাতা, ১৯৩১, মুখবন্ধ
৫ ভট্টাচার্য, যতীন্দ্রমোহন, বাঙলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয় : ১৭৮৩ হইতে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা, ১৯৭০, পৃঃ ১—১৫ (এরপর বাঙলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয়)
৬ Anon., The Indian Vocabulary: To Which Is Prefixed the Forms of Impeachments, London : John Stockdale, 1788, p.vi, http://archive.org/details/theindianvocabulary.
৭ বাঙলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয়, পৃঃ ৮-৯
৮ ঐ, পৃঃ ১০
৯ Forster, H. P. A Vocabulary, In Two Parts, English And Bongalee, And Vice Versa, Vol. 1, The Mission Press, Serampore, 1799. P. I, http://archive.org/details/
http://archive.org/details/
১০ দাস, অসিতাভ ও বাগচী, প্রদোষকুমার, বাংলা অভিধানের দুশো বছর ও তথ্যপঞ্জি : ১৮১৭—২০১৭, পত্রলেখা, কলকাতা, ২০২২, পৃঃ ৭১—৭৩
১১ Takoor, Mohunpersaud, A vocabulary Bengalee and English for the use of students, Hindoostanee Press, Calcutta, 1810, http://archive.org/details/dli.ministry.27435.
১২ Carey, W., Dictionary Of The Bengalee Language, Vol.1, The Mission Press, Serampore, 1818, P. iv http://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.547564.
১৩ বাঙলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয়, পৃঃ ২৯
১৪ ঐ, পৃঃ ১২
১৫ ঐ, পৃঃ ৩০
১৬ ঐ, পৃঃ ৩১-৩২
১৭ ঐ, পৃঃ ১২
১৮ Roy, Rammohun, Bengalee Grammar in the English Language, University Press, Calcutta, 1826