কত স্মৃতি বিস্মরণের ঘূর্ণিতে তলিয়ে গেছে! কত স্মৃতি পুরানো বাড়ির মতো—ভঙ্গুর দশা, হাড়-পাঁজর বেরনো, ধূলিমলিন। আবার অনেক স্মৃতি তুতেনখামেনের মমির মতো আজও স্বর্ণোজ্জ্বল! সেগুলোর সবটুকু মনে আছে। মনে থাকে। আসলে নতুন স্মৃতিকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিস্মরণের প্রবাহ খুব স্বাভাবিক। তা না হলে মানুষ স্মৃতিকাতরতার আবর্তে পড়ে যাবে। তখন স্মৃতিই হয়ে উঠবে মানসিক সমস্যা৷

এই রচনাটি লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, স্মৃতিভ্রংশ হওয়া কোনো কাজের কাজ নয়। পরতে পরতে মনে থাকা উচিত ছিল। সেইসব মধুর, অপরূপ স্মৃতি কোন পথে হারিয়ে গেল! এক এক সময় ভিতরটা ভারি হয়ে আসে। সংসার-সমুদ্রে সংসারীদের জীবন মাছধরা নৌকার মতো ভাসছে দুলছে ঢেউয়ের আঘাতে কখনো কম্পিত কখনো শঙ্কিত। বয়সের মতো জীবনও মোহানার দিকে এগিয়ে চলেছে, আর পিছন পানে ফিরে এসে কূলে ভিড়বে না। সত্যি কথা বলতে, এই অনিশ্চিত যাত্রায় স্মৃতিটুকুই সম্বল। ভাগ্যিস মহামায়া, মহাদেবী ‘স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা’! ফলে মানুষ সব ভুলে যায় না। যাদের এই দুর্ভাগ্য তাড়া করে, তারা রোগগ্রস্ত হিসাবে চিহ্নিত।

স্মৃতি নিয়ে এত কথা লিখতে হলো এজন্য যে, যাঁদের সম্বন্ধে অমৃতনির্ঝর মুহূর্তগুলির কথা বলতে বসেছি, তার সূচনার লগ্নটিকে পঞ্চাশ বছর আগে ফেলে এসেছি। হয়তো অতিক্রান্ত হয়ে গেছে আরো কয়েকটা বছর। সময়ের বিচারে বাহান্ন কী পঞ্চাশ, খুব বেশি পুরানো নয়। তবু স্মৃতি বড় প্রতারক। প্রতারণাই তার প্রিয় খেলা। তাই এই লেখায় কিছু অনিচ্ছাকৃত অপলাপ ঘটে গেলে লেখক ক্ষমাপ্রার্থী।

তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। তেরো বছরের কিশোর। কোনো একটা জরুরি কাজে (এই যে! আর মনে নেই) রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের সহ-সচিব স্বামী নিত্যানন্দ আমাকে এবং আরো দু-তিনজন ছাত্রকে নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। “একটিবার মায়ের বাড়ি ঘুরে আসি, চল। এত কাছে এসে জগজ্জননীকে প্রণাম না করে ফিরে যাব? তা কী হয়!” গাড়ি দাঁড়াল চওড়া গলির ভিতরে একটা হলুদ রঙের বড়সড় বাড়ির সামনে। মহারাজ বললেন: “ওরে তোরা নাম। তোদের মধ্যে কেউ কি আগে কখনো মায়ের বাড়ি এসেছিস?” সমস্বরে উচ্চারিত হলো—“না মহারাজ।” আমি এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখলাম, একটা ছোট দোকানের সাইনবোর্ডে ঠিকানার পাশে লেখা—নয়নকৃষ্ণ সাহা লেন। রাস্তা পেরতেই সামনে একটা সরু গলি। মাপে নয়নকৃষ্ণ সাহা লেনের অর্ধেক। সম্ভবত, রাস্তায় পুঁতে দেওয়া একটা লোহার পাইপের মাথায় এক-টুকরো টিনের ওপরে আরো বিবর্ণ দুটি শব্দ চোখে পড়ল—উদ্বোধন লেন। মহারাজ দ্রুত পায়ে দু-তিন মিনিটের মধ্যে হেঁটে চলে এলেন একটি ছোট্ট দোতলা বাড়ির সামনে। দরজার ওপরে লেখা—‘শ্রীশ্রীমায়ের বাড়ী’। অর্ধচন্দ্রাকৃতি অক্ষরবিন্যাস। নামফলকটি পাথরের।

ছোট্ট বাড়ির মাঝখানে চতুষ্কোণ উঠান। ডানদিকে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম দোতলায়। সামান্য কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ ভক্ত বসে আছেন। অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে দোতলা জুড়ে। একটু এগতেই মায়ের ঘর। এখনকার মতো কাচের বাধা নেই। সম্পূর্ণ মুক্ত বাতাবরণ। মহারাজ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। তাঁর দেখাদেখি আমরাও। সেই মুহূর্তে মায়ের পূজারি মহারাজ মাকে সকালে-সন্ধ্যায় নিবেদিত ফুল-বেলপাতা ইত্যাদি পরিষ্কার করছেন। বাইরে থেকে দেখছি, ঘরের ডানদিকে মায়ের নিজস্ব পূজাস্থল। ছোট মন্দিরের মতো স্থাপত্য। শ্রীরামকৃষ্ণ মূল সিংহাসনে। ভাল করে দেখেছিলাম, ছবিটি খুব পুরানো। বাঁদিকে শয্যার ওপরে মায়ের ছবি এবং এই ছবিতেই পুজো হয়। মায়ের ঘরের বাঁপাশের ঘরটি সারদানন্দজীর। ঘরে ঢুকে তাঁর শয্যা স্পর্শ করে প্রণাম করলাম, আলমারিতে সাজানো মহারাজের ব্যবহৃত জিনিসসমূহ দেখলাম। সেসময় সমগ্র মায়ের আশ্রয়টি এক নিষেধহীন পরিসর। শুধুমাত্র মায়ের ঘরটির পবিত্রতা সযত্নে রক্ষা করা হতো প্রবেশ নিষেধের মাধ্যমে।

ওঠার সময় লক্ষ্য করিনি, নিচে নেমে দেখলাম ছোট্ট একটি ঘর। প্রায় ঘর জুড়ে একজন মানুষের শোয়ার মতো একটা খাট। খাটের ওপর অজস্র বই। এধারে ওধারে। খাটে উপবিষ্ট সদাহাস্য মহারাজের পদধূলি নিলাম আমরা সকলে। তিনি কৌটো থেকে আমাদের হাতে সাদা বাতাসা দিলেন। এর খানিক পরে আমাদের রসগোল্লা খাওয়ালেন। মহারাজ আমাদের প্রত্যেককে একটি করে সচিত্র বই (প্রস্থে লম্বা, পাতলা চেহারার) উপহারও দিলেন। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, তাঁর ছাপানো নামটি পড়তে দুবার ঠোক্কর খেয়েছিলাম—স্বামী বিশ্বাশ্রয়ানন্দ। পরের দিন স্কুল লাইব্রেরিতে রাখা উদ্বোধন খুলে দেখি, ইনি উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক। তাঁকে সেই প্রথম ও শেষ দেখেছিলাম। রহড়া আশ্রমের আশ্রমিক হিসাবে পাঠপর্ব সমাধা করে যখন বাড়ি ফিরে এলাম, ততদিনে উনি সম্পাদক-পদ থেকে অবসর নিয়েছেন (১৯৭৩)। স্বামী বিশ্বাশ্রয়ানন্দ অর্থাৎ নন্দী মহারাজের কার্যকালের মেয়াদ আট বছর। উদ্বোধন ১০০: শতাব্দীজয়ন্তী সঙ্কলন (স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ সম্পাদিত) গ্রন্থে একশো বছর পর্যন্ত যাঁরা এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নাম ও কার্যকালের সময়সীমা ছবির মতো দেওয়া আছে। যৌবনের প্রারম্ভে যখন পাঁচিল-ঘেরা আশ্রমের বাইরে এসে জগৎকে জানার অভিপ্রায় ঘনিয়ে উঠেছিল, সেইসময় নন্দী মহারাজের মতো সাধুর সংসর্গ আমার হাতের বাইরে চলে গেল। সেই আপশোস এখনো আছে।

পরবর্তী সম্পাদক হলেন স্বামী ধ্যানানন্দ। রুগ্‌ণ চেহারার মানুষ। সবসময় তাঁর মুখের ভাব কঠিন ও বিরস। কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি। তাঁর সম্পাদনাকালে মায়ের বাড়ির অধ্যক্ষ হয়ে এলেন স্বামী হিরণ্ময়ানন্দ। এই রাশভারি মহারাজের গলার স্বর, চলাফেরা, আদেশ-উপদেশের সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ পরিচয় ছিল। স্বামী পুণ্যানন্দের জীবিতাবস্থায় উনি রহড়া আশ্রমে এসেছেন। সম্ভবত একাধিকবার। একবার তাঁর দেখাশোনা বা সেবা করার ভার পড়েছিল আমার ওপর। স্বামী হিরণ্ময়ানন্দ পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা-সেক্রেটারি ছিলেন। মায়ের বাড়িতে আসার পর ভক্তদের ভিড় দেখা যেত স্বামী হিরণ্ময়ানন্দকে ঘিরে। স্বামী ধ্যানানন্দের পাণ্ডিত্য ও সুবিস্তৃত পড়াশোনার চিহ্ন ছড়িয়ে আছে দশবছর ধরে তাঁর রচিত সম্পাদকীয়গুলিতে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক ডক্টর প্রণবরঞ্জন ঘোষ গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন রামকৃষ্ণ-ভাবান্দোলনের সঙ্গে। এই ধারায় আরো একজনকে পেয়েছিলাম। তিনি অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। অবিবাহিত ডঃ ঘোষ সংসার ত্যাগ করে পুরোপুরি সন্ন্যাসী হননি, তবে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে একটি ছোট ঘরে প্রায় আজীবন একলা থেকেছেন। তিনি স্বামী হিরণ্ময়ানন্দকে প্রস্তাব দিলেন, উদ্বোধনকে উপলক্ষ করে একদিনব্যাপী একটি সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করলে কেমন হয়? সকাল ১০টা থেকে মধ্যাহ্নভোজন পর্যন্ত, তারপর আবার বিকাল ৩টে থেকে সান্ধ্য আরাত্রিক শুরু হওয়ার আগে অধিবেশনের সমাপ্তি। সবদিক বিচার-বিবেচনা করে স্বামী হিরণ্ময়ানন্দ সেই সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনে সম্মতি দিয়েছিলেন। হাতের কাছে পেয়ে অধ্যাপক ঘোষ আমাকে সহযোগী করে নিলেন। প্রতি মাসে সুচারুরূপে উদ্বোধন প্রকাশের বাইরে এই বাৎসরিক সম্মেলন ভক্তদের মধ্যে সাড়া জাগিয়ে তুলেছিল। একাধিক বছর সম্মেলন হয়েছে। তবে ঠিক কত বছর, মনে নেই। বিষয় ও বক্তা নির্বাচন স্যারই করতেন। সারাদিনে অন্তত ছটি বক্তৃতা। প্রত্যেক বক্তার জন্য বরাদ্দ আধঘণ্টা৷ বাকি সময়টুকু সংগীত, সভামুখ্যের ভাষণ, ধন্যবাদ জ্ঞাপন ইত্যাদি। লিখিত বক্তৃতা উদ্বোধন-এ প্রকাশের জন্য নেওয়া হতো৷ বলতে দ্বিধা নেই, সম্মেলনটি প্রতিনিধিবর্গ ও সাধারণ শ্রোতৃমণ্ডলীর উপস্থিতিতে উৎসবে রূপান্তরিত হতো। স্বামী ধ্যানানন্দ সভায় থাকলেও পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতেন স্বামী হিরণ্ময়ানন্দ।

সম্ভবত আশির দশকের শুরুতে স্বামী হিরণ্ময়ানন্দ মঠ-মিশনের সাধারণ সম্পাদকরূপে বেলুড় মঠে চলে যাওয়ার কিছু পরে শারীরিক কারণে স্বামী ধ্যানানন্দ অবসর নিলেন। উদ্বোধন-এর সম্পাদক হয়ে এলেন স্বামী অজজানন্দ। সময় ১৯৮২ সাল। তাঁর বাচনভঙ্গি মাধুর্যময়। উদ্বোধন পত্রিকা নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল অন্তহীন। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্র অফিসে চলে আসতেন। চাইতেন বাংলার গুণিজন, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক—সবাই এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকুন। এমনভাবে জনসংযোগ গড়ে তোলার কাজ তাঁর আগে কেউ করেছেন বলে জানা নেই। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মুখপত্র—এই পরিচয়ের বাইরে উদ্বোধনকে তিনি বিখ্যাত নানা সাময়িক পত্রের পঙ্‌ক্তিতে উত্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন। লেখক হিসাবেও তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি সম্পাদকের পদে ছিলেন মাত্র তিন বছর (১৯৮২–৮৫)।

এরপর সম্পাদক হয়ে বেলুড় মঠ থেকে এলেন স্বামী প্রমেয়ানন্দ। তিনি ‘রামগোপাল মহারাজ’ নামে অধিক পরিচিত। দশম সংঘগুরু স্বামী বীরেশ্বরানন্দের সচিব ও সেবক ছিলেন দীর্ঘদিন। বীরেশ্বরানন্দজীর শরীরত্যাগের পর মহারাজকে দেওয়া হলো এই নতুন দায়িত্ব। পূর্ব- পরিচয়ের সূত্রে একদিন দেখা করতে গেলাম। হাসতে হাসতে কথাপ্রসঙ্গে বললেন: “দেখ, মঠ আমাকে এত বড় দায়িত্ব দিয়েছে। অথচ আমি কি এর যোগ্য? একটি পত্রিকা প্রকাশ তো দেখছি বিরাট কর্মযজ্ঞ! বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না! এমন যজ্ঞ সম্পন্ন করার মতো জ্ঞানগম্যিও আমার নেই। একটু-আধটু উদ্বোধন-এ লিখেছি। এইটুকুই যা সম্বল।” তাঁকে একদিন বলেছিলাম: “চলুন, একদিন দেশ পত্রিকার অফিসে আপনাকে নিয়ে যাই। আমরা কীভাবে কাজ করি দেখে আসবেন।” আনন্দের কথা, মহারাজকে একদিন নিয়ে গেলাম। প্রবাদপ্রতীম সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে আলাপ করলেন। দেখলেন আমাদের কাজ করার পদ্ধতি ও তার বিভিন্ন স্তর। ফেরার পথে সবিস্ময়ে বললেন: “আমার কাজের জায়গা কত নিঃস্তব্ধ! কোনো ডিস্টার্বেন্স নেই। তাতেই আমি স্বচ্ছন্দ হতে হিমসিম খাচ্ছি! আর তোমাদের দপ্তরে কত লোক, তাঁদের কথাবার্তা, আলোচনা, যাতায়াত! আমি তো ভাবতেই পারছি না!”

স্বামী প্রমেয়ানন্দকে বললাম: “আমরা আপনার পাশে আছি। আপনার পত্রিকার ঠিকানা মায়ের বাড়ি, ১ নং উদ্বোধন লেন। শ্রীশ্রীমা নিজেই সব করিয়ে নেবেন।” মহারাজ উদাস স্বরে বললেন: “তাই যেন হয়।” মহারাজের সম্পাদনায় উদ্বোধন নির্দিষ্ট সময়ে ঠিকঠাকই প্রকাশিত হয়েছে, কোনো শোরগোলের সৃষ্টি হয়নি। মহারাজ ঐতিহ্যের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন। মাত্র দুবছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে ফিরে গেলেন বেলুড় মঠে। তখন উদ্বোধন-এর বয়স ৮৯ বছর।

নব্বই বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র একবছর বাকি। ৮৯ বছরের (১৯৮৭) কার্তিক মাসের (১৩৯৪) সংখ্যাটিতে সম্পাদকরূপে প্রকাশিত হলো এক তরুণ সন্ন্যাসীর নাম—স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ। বলতে গেলে, এই লগ্ন থেকেই শুরু হলো পত্রিকার নবতম যাত্রা। এক নিষ্ঠাবান, স্বপ্নসন্ধানী, সাহিত্যপ্রেমী, সুবক্তা, সুলেখকের হাতে পত্রিকার ভার তুলে দিয়ে রামকৃষ্ণ সংঘ সেদিন বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। উদ্বোধন-এর বিষয়বস্তু সম্প্রসারিত হলো, অপরিবর্তিত প্রচ্ছদ পরিবর্তনের স্পর্শে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠল প্রতিটি সংখ্যা। লেখক-লেখিকাদের সঙ্গে সংযোগ ব্যাপকতর করার ক্ষেত্রে স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ বা শঙ্কর মহারাজ তাঁর পূর্বসূরি স্বামী অজজানন্দের পথ গ্রহণ করলেন, পরিসীমার লক্ষ্মণগণ্ডি ভেঙে পত্রিকাকে আরো জনমুখী করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করলেন নিজেকে। সঙ্গে পেলেন এমন কয়েকজন উৎসর্গীকৃত-প্রাণ মানুষ, যাঁরা তাঁর কর্মপন্থার একান্ত সহায়ক। তাঁদের মধ্যে একজন চাকরি ছেড়ে দিয়ে উদ্বোধনকে ধ্যান-জ্ঞানপ্রেমে পরিণত করলেন। গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দাম অপরিবর্তিত রেখে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। শুধু সম্পাদকের নাম নয়, মায়ের বাড়ির অধ্যক্ষের নাম ‘ব্যবস্থাপক সম্পাদক’ অভিধায় ছাপা শুরু হলো (সেই নিয়ম এখনো বজায় আছে)।

দেখতে দেখতে এগিয়ে এল একশো বছরের সন্ধিলগ্ন। ১৪০৬ বঙ্গাব্দ, ১৯৯৯ সালে উদ্বোধন একশো বছর পূর্ণ করল। শতবর্ষে পদার্পণ ১৪০৫ বঙ্গাব্দে, ১৯৯৮ সালে। সদ্য অতিক্রান্ত শততম বর্ষের সূচনায় প্রকাশিত হলো প্রায় সাড়ে নয়শো পাতার একটি বৃহৎ গ্রন্থ উদ্বোধন ১০০: শতাব্দীজয়ন্তী নির্বাচিত সঙ্কলন। গ্রন্থের সম্পাদক স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ ‘নিষ্ঠাবান স্বেচ্ছাসেবী’দের সহায়তায় এমন দুরূহ এবং অপ্রত্যাশিত কর্ম সম্পাদন করে পাঠকদের করকমলে তুলে দিয়েছেন এক মহারত্ন। তিনি স্বীকার করেছেন, একশো বছরের ব্যাপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে বইটি ‘বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন’। তা সত্ত্বেও এই সংকলন উদ্বোধন-এর মতোই ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মহান ভাবাদর্শকে প্রতিটি পাঠকের অন্তর্লোকে পৌঁছে দিতে’ পারবে। কেননা, স্বামী পূর্ণাত্মানন্দের ভাষায়—এই অমর পত্রিকা ‘একটি নাম-মাত্র নয়; একটি প্রেরণা, একটি ঐতিহ্য, একটি ঘনীভূত অঙ্গীকারের উচ্চারণ।’ উদ্বোধন পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা জানুয়ারি (মাঘ) ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাটি নিয়মিত সংখ্যারই বর্ধিত সংস্করণ।

দীর্ঘ চোদ্দ বছর সম্পাদকের পদে যোগ্যতার সঙ্গে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার পর স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ ২০০১ সালের মে মাসে অন্য পদে স্থানান্তরিত হলেন। তিনি বিদায় নেওয়ার পর পত্রিকার সম্পাদক হয়েছেন স্বামী সর্বগানন্দ (২০০১–০৫), স্বামী শিবপ্রদানন্দ (২০০৫–০৮), স্বামী ঋতানন্দ (২০০৯–১৩), স্বামী চৈতন্যানন্দ (২০১৩–১৮), স্বামী শিবার্চনানন্দ (২০১৯–২০) এবং বর্তমানে স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দ (২০২১–)৷ স্বামী শিবার্চনানন্দের সঙ্গে আলাপ হয়নি করোনা পরিস্থিতির জন্য। তাঁর অগ্রবর্তী চারজন সম্পাদকের সঙ্গে কর্মসূত্রে পরিচয় ছিল। এঁরা প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো বিষয়ে অত্যন্ত পারঙ্গম ও দক্ষ ছিলেন। কেউ সংগীতে, কেউ শিক্ষকতায়, কেউ সৃষ্টিশীল সাহিত্যরচনায়, কেউ নিপুণ ও নিখুঁত প্রকাশনাকর্মে। কিন্তু কেউই দীর্ঘদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। মঠ তাঁদের অন্য কর্মে নিযুক্ত করেছে। স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দের সঙ্গে আলাপ হয় গত বছর বইমেলায়। তারপর এসেছি তাঁর দপ্তরে। উদ্বোধন সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছি।

স্বপ্নদ্রষ্টা স্বামী বিবেকানন্দের অজস্র স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম স্বপ্ন ছিল—রামকৃষ্ণ মিশন তার ব্রত উদযাপনের কথা একটি পত্রিকা প্রকাশ করে জগদ্বাসীকে জানাক। স্বামীজীর এই মানসেচ্ছাকে রূপদানের জন্য আত্মবিনিয়োগ করলেন তাঁরই গুরুভাই ত্রিগুণাতীতানন্দজী। জানুয়ারি ১৮৯৬, তাঁকে একটি চিঠিতে স্বামীজী লিখেছিলেন: “তোর কাগজের idea অতি উত্তম বটে এবং উঠে-পড়ে লেগে যা, পরোয়া নেই। ৫০০ টাকা পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেবো, ভাবনা নাই টাকার জন্য। আপাতত এই চিঠি দেখিয়ে কারুর কাছে ধার করে নে।… লেখক অনেক চাই। তার পর গ্রাহক যোগাড়ই মুশকিল। উপায়—তোরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াস, বাঙলা ভাষা যেখানে যেখানে আছে, লোক ধরে কাগজ গতিয়ে দিবি।… চালাও কাগজ, কুছ পরোয়া নাই।… তুই খুব বাহাদুরি করেছিস। বাহবা, সাবাস!”

এই বিশাল প্রেরণা এবং আশীর্বাণী সম্বল করে ত্রিগুণাতীতানন্দজী পত্রিকা প্রকাশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নিয়ম-শৃঙ্খলানিষ্ঠ মানুষটি সত্যিই কোনো কিছুর পরোয়া করেননি। দিন-রাত্রি পরিশ্রম, অর্থাভাব, অর্ধাহার, অনাহার, প্রেসের কারিগরি জটিলতা—কোনো কিছুই তাঁকে একাগ্র লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি এক মুহূর্তের জন্য। স্বামীজীর চিঠি প্রাপ্তির ঠিক তিনবছর পরে প্রকাশিত হলো রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মুখপত্র উদ্বোধন৷ শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারার বার্তাবাহক, ত্যাগৱত উদ্যাপনের সংবাদবাহক পত্রিকাটির আবির্ভাবকাল ১ মাঘ ১৩০৫ (১৪ জানুয়ারি ১৮৯৯)। সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ। শুরু হলো এক নিরবচ্ছিন্ন অন্তহীন ইতিহাসের অভিযাত্রা। প্রথম সংখ্যায় ‘উদ্বোধনের প্রস্তাবনা’ লিখে দিলেন স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং। আশ্চর্যের বিষয়, স্বামীজীর এই রচনায় উদ্বোধন পত্রিকা কী এবং কেন—সে-সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা নেই, রচনাটিতে ‘উদ্বোধন’ শব্দটি মাত্র একবার প্রয়োগ করেছেন। বহু ক্ষেত্রে, বহু বার উদ্ধৃত এই প্রস্তাবনার বিষয়বস্তু—ভারতের ঐশ্বর্যময় সুদূর অতীত থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের সংহত ইতিহাস। আবার ইতিহাসকে বিবৃত করার পরতে পরতে ভারতবাসীর প্রতি স্বামীজীর উদাত্ত আহ্বান। হে দেশবাসী, তুমি কী ছিলে, কী হয়েছ এবং তোমার কী হওয়া উচিত—তারই মর্মবাণী এই ক্ষুদ্র রচনায় বিধৃত। কেবল একটিমাত্র পরিচ্ছেদে স্বামীজী উদ্বোধন প্রকাশের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে প্রত্যক্ষভাবে বলেছেন: “‘…বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’। নিঃস্বার্থভাবে ভক্তিপূর্ণহৃদয়ে এইসকল প্রশ্নের মীমাংসার জন্য ‘উদ্বোধন’ সহৃদয় প্রেমিক বুধমণ্ডলীকে আহ্বান করিতেছে এবং দ্বেষবুদ্ধিবিরহিত ও ব্যক্তিগত বা সমাজগত বা সম্প্রদায়গত কুবাক্যপ্রয়োগে বিমুখ হইয়া সকল সম্প্রদায়ের সেবার জন্যই আপনার শরীর অর্পণ করিতেছে।”

উদ্বোধন-এর অনুরাগীরা বিশ্বাস করেন, এটি শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয়, এটি শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীশরীর। এই উপলব্ধি বা চিন্তার মধ্যে কোনো অতিশয়োক্তি নেই। আমরা শুধু আরেকটি অনুভব যোগ করতে চাই—উদ্বোধন যদি শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীশরীর হয়, তবে সম্পাদক হলেন তাঁর প্রধান সেবক। প্রথম সেবক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের হাত ধরে এই সেবার সূচনা করেছিলেন উত্তর কলকাতার কম্বুলিটোলায় অবস্থিত ১৪ নং রামচন্দ্র মৈত্র লেনের একটি একতলা বাড়ির অঙ্গনে। ১ম বর্ষ থেকে ৮ম বর্ষ পর্যন্ত প্রকাশিত হলো উদ্বোধন এখানে থেকে। পরবর্তী ঠিকানা ৩০ নং বোসপাড়া লেন। এখানে অবস্থান দুবছর। তারপর দশম বর্ষের শেষ লগ্ন থেকে আজ অবধি এই দীর্ঘজীবী পত্রিকার আশ্রয়স্থল ‘শ্রীশ্রীমায়ের বাড়ী’। পত্রিকাটি শ্রীশ্রীমায়ের স্নেহ-ভালবাসা ও আশীর্বাদে পুষ্ট ও প্রাণিত।

একশো চব্বিশ বছর ধরে অবিচ্ছিন্নভাবে পথচলা কম কথা নয়! পথের চরিত্রই হলো সে কোথাও কুসুমাস্তীর্ণ, কোথাও কণ্টকাকীর্ণ। আবার উচ্চাবচ। অতএব অপরিসীম নিষ্ঠার সঙ্গে, ঠাকুর-মা-স্বামীজীর শরণাগত হয়ে, কখনো অধিষ্ঠিত সম্পাদক, কখনো সম্পাদকদ্বয়, কখনো বা সম্পাদকত্রয়ী উদ্বোধন নির্মাণের লক্ষ্যে, সতর্ক হয়ে সেই পথ ধরে এগিয়ে গেছেন। সেই প্রথানুগ পদক্ষেপের কোনো ব্যত্যয় আজ পর্যন্ত ঘটেনি।

স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নকে সম্ভব করেছেন স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দজী। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন তাঁর পার্থিব শরীরে আর নেই। কিন্তু তাঁর সন্তানদের পাশে শ্রীশ্রীমা ছিলেন। স্বামীজীর বজ্রতেজকে প্রকাশ করে উদ্বোধন-এর বাণীশরীর ধন্য হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে মায়ের নিরন্তর আশিস ও শুভ অনুধ্যানে। তাই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে রামকৃষ্ণ-সংসারের নিবিষ্ট গবেষক, প্রয়াত শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছিলেন: “‘উদ্বোধন’-এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী সারদা-সরস্বতীর প্রসাদপুষ্ট মহাপুঁথির নাম ‘উদ্বোধন’।”

‘হেমচন্দ্র ঘোষ স্মারক রচনা’রূপে প্রকাশিত হলো।