রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন

রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণপুরুষ হলেন শ্রী রামকৃষ্ণদেব (১৮৩৬-১৮৮৬)।  উনিশ শতকের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণদ পরমহংস এমন একজন মানুষ যার উদার বাণী ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবী পরিব্যাপ্ত। তাঁর প্রিয়তম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২ খ্রীঃ) আধুনিক ভারতের অন্যতম প্রধান নায়ক যিনি গুরুর উদারবাণী সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন। আইনত ও অর্থনৈতিকভাবে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন উভয়েই স্বাধীন প্রতিষ্ঠান,  তবে আদর্শগত ও প্রশাসনিক দিক থেকে উভয়ে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। রামকৃষ্ণ মঠের অজস্র শাখা রয়েছে যেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের নানান কাজ হয়। যেমন-স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল-সেবাকার্য, পল্লী তথা গ্রামোন্নয়ন ইত্যাদি। এই দুই প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করে রামকৃষ্ণ-নামাঙ্কিত এই অভিনব আধুনিক আধ্যাত্মিক আন্দোলনটিকে সচল রাখে।

এই আন্দোলনের মূলে যে ভাবাদর্শ রয়েছে, তার শিকড় ভারতের প্রাচীন ঔপনিষদিক আদর্শে প্রোথিত। বৈদিক ঋষিদের উচ্চারণে আমরা তার প্রতিচ্ছবি পাই। ভারতীয় ইতিহাস এবং ভারতীয় দর্শন বহুমাত্রিক ও বহুবর্ণে বর্ণিল, তবুও তার মধ্যে বেদান্ত দর্শনের স্থান সবার ঊর্ধ্বে। এমন বিশাল ব্যাপ্তি ও গভীরতা আর কোথাও নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এই বেদান্তদর্শনেরই এক আধুনিক ভাষ্য, যা আমাদের আধুনিক জীবনের প্রয়োজন ও প্রতিবন্ধকতাগুলিকে জয় করতে সাহায্য করে। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনে প্রতিফলিত এই বেদান্তকেই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার ব্রত নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বপথিক হয়েছিলেন, এবং অবশেষে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মধ্যে দিয়ে রামকৃষ্ণ বিপ্লবের পথ চলা শুরু হয়েছিল। আজকে শুধু গৈরিকধারী সন্ন্যাসীরাই নন, সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রের বিভিন্ন বয়সের অগণিত মানুষেরা রামকৃষ্ণ পরিবারের সদস্য। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন সর্বধর্মসমন্বয়ে বিশ্বাসী, জীব-সেবার মাধ্যমে শিব-সেবার সাধনায় রত; সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ মৌলবাদ, ধর্মান্তরবাদ, ধর্মগন্ধী গুপ্তবিদ্যা বা সিদ্ধাই, অথবা কুসংস্কারাচ্ছন্নতার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের কোনোরকম সম্পর্ক নেই। যে কোনো রকম গোঁড়ামি রামকৃষ্ণ-আদর্শের বিপ্রতীপ। বিশ্বজনীন অহৈতুকী প্রেম এবং নিরহঙ্কার সারল্যের প্রতিমূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত, তাঁর জীবনই আমাদের মন্ত্র। ঐহিক বা পারলৌকিক, সব ক্ষেত্রেই চিন্তাধারার ঔদার্য্য, উৎকর্ষ ও আলোকময়তা বজায় রাখা আমাদের রীতি। স্বার্থশূন্য সেবাকাজের মধ্যে দিয়ে আপন আধ্যাত্মিক উন্নয়ন–এই লক্ষ্যে রামকৃষ্ণ পরিবার অবিচল রয়েছে।

মূলমন্ত্র: স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের মূলমন্ত্র হল – ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগৎ হিতায় চ’; যার অর্থ – ‘নিজের মুক্তি তথা জগতের হিতের জন্য।’

আদর্শ: রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের চিন্তা ও কর্মধারার মূলে যে ক’টি ভাব রয়েছে, সেগুলি হল–কর্মের মধ্য দিয়ে উপাসনা, সমস্ত মানুষের মধ্যে দেবত্বের সম্ভাবনায় বিশ্বাস, এবং বিশ্বের সব ধর্মের মৈত্রী ও সমন্বয়। কর্মযোগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ জীবন উন্নয়ন, সব ক্ষেত্রেই ঈশ্বর উপাসনার ভাব নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যায়। এ অবশ্যই সেবাকাজ নয়, এ হলা স্বামীজী প্রবর্তিত পূজার অনুষ্ঠান মাত্র।

মূলকেন্দ্র:  রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের মূলকেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়, গঙ্গাতীরবর্তী বেলুড়ে অবস্থিত। সকলে একে ‘বেলুড় মঠ’ বলে জানে। গঙ্গার পশ্চিম তীরে অবস্থিত বেলুড় মঠই বিগত এক শতাব্দী জুড়ে আধুনিক বাংলা তথা ভারতের আধ্যাত্মিক, বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে এক বিশাল ভূমিকা পালন করে আসছে।