আমাদের কথা
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন দু’টি সহযুক্ত আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান। সারা পৃথিবীতে বিবিধ জনসেবা ও সমাজসেবামূলক কাজে প্রতিষ্ঠান দু’টি নিয়োজিত আছে; কোনোরকম রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন সম্পূর্ণ মুক্ত। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী ও গৃহী মানুষেরা বিশ্বাস করেন – জীবের মধ্যেই শিবের অধিষ্ঠান। এই বিশ্বাসকেই মন্ত্র করে তাঁরা সারা বিশ্ব জুড়ে নানা কাজের মাধ্যমে জাত-পাত-ধর্ম নির্বিশেষে জীবের সেবা করে চলেছেন।
এই সংগঠনদু’টির প্রতিষ্ঠা শ্রীরামকৃষ্ণের (১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রীঃ) নামে। উনিশ শতকের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণ একটি বিপ্লববিশেষ – যার ঢেউ বাংলা ও ভারত ছাড়িয়ে ক্রমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয়তম শিষ্য, স্বামী বিবেকানন্দ, (১৮৬৩-১৯০২ খ্রীঃ) আধুনিক ভারতের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন, এবং সমাজের কাছে গুরুর কথা ও কাজ পৌঁছে দেওয়ার আশু প্রয়োজন অনুভব করে তিনি সেই কাজের জন্য রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আইনত এবং অর্থনৈতিকভাবে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন উভয়েই স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, কিন্তু আদর্শগত ও প্রশাসনিক দিক থেকে উভয়ে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। রামকৃষ্ণ মঠের অজস্র শাখা রয়েছে যেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের নানা কাজ হয়, যেমন স্কুল, হাসপাতাল, ঔষধালয়, গ্রামোন্নয়ন কেন্দ্র, ইত্যাদি পরিচালনার কাজ। এই দুই প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করে, এবং সেই কাজের মধ্যে দিয়ে রামকৃষ্ণ-নামাঙ্কিত এই অভিনব ও আধুনিক আধ্যাত্মিক আন্দোলনটিকে এই দু’য়ে মিলে সচল রাখে।
এই আন্দোলনের পেছনে যে ভাবাদর্শ রয়েছে, তার শিকড় ভারতের প্রাচীন ঔপনিষদিক আদর্শে, বৈদিক ঋষিদের উচ্চারণে আমরা যার প্রতিচ্ছবি পাই। ভারতীয় ইতিহাস এবং ভারতীয় দর্শন বহুমাত্রিক ও বহুবর্ণ, তবুও তার মধ্যে বেদান্ত দর্শনের স্থান সবার ওপরে – এমন বিশাল ব্যাপ্তি ও গভীরতা আর কোনো আদর্শবাদেই নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এই বেদান্তদর্শনেরই এক আধুনিক ভাষ্য, যা আমাদের আধুনিক জীবনের প্রয়োজন ও প্রতিবন্ধকতাগুলিকে জয় করতে সাহায্য করে। এই নব-বেদান্তকেই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার ব্রত নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বপথিক হয়েছিলেন, এবং অবশেষে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মধ্যে দিয়ে রামকৃষ্ণ বিপ্লবের পথ চলা শুরু হয়েছিল। আজকে শুধু গৈরিকধারী সন্ন্যাসীরাই নন, সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রের বিভিন্ন বয়সের অগণিত মানুষেরা রামকৃষ্ণ পরিবারের সদস্য।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন সর্বধর্মসমন্বয়ে বিশ্বাসী, জীব-সেবার মাধ্যমে শিব-সেবার সাধনায় রত; সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ মৌলবাদ, ধর্মান্তরবাদ, ধর্মগন্ধী গুপ্তবিদ্যা বা সিদ্ধাই, অথবা কুসংস্কারাচ্ছন্নতার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের কোনোরকম সম্পর্ক নেই। যে কোনো রকম গোঁড়ামি রামকৃষ্ণ-আদর্শের বিপ্রতীপ। বিশ্বজনীন অহৈতুকী প্রেম এবং নিরহঙ্কার সারল্যের প্রতিমূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত, তাঁর জীবনই আমাদের মন্ত্র। ঐহিক বা পারলৌকিক, সব ক্ষেত্রেই চিন্তাধারার ঔদার্য্য, উৎকর্ষ ও আলোময়তা বজায় রাখা আমাদের রীতি। স্বার্থশূন্য সেবাকাজের মধ্যে দিয়ে আপন আধ্যাত্মিক উন্নয়ন – এই লক্ষ্যে রামকৃষ্ণ পরিবার অবিচল রয়েছে। সেই সঙ্গে মনে আছে শ্রীরামকৃষ্ণের অক্ষয় উচ্চারণ: “যত মত, তত পথ।”
মূলমন্ত্র: রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মূলমন্ত্র – ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগৎ হিতায় চ’; যার অর্থ – ‘নিজের মুক্তি তথা জগতের হিতের জন্য।’ স্বামী বিবেকানন্দ এই মূলমন্ত্র নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।
আদর্শ: রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের চিন্তা ও কর্মধারার মূলে যে ক’টি ভাব রয়েছে, সেগুলি হল – কাজের মধ্য দিয়ে উপাসনা, সমস্ত মানুষের মধ্যে দেবত্বের সম্ভাবনায় বিশ্বাস, এবং বিশ্বের সব ধর্মের মৈত্রী ও সমন্বয়। কর্মযোগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মঠ ও মিশন সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ-জীবন উন্নয়ন – সব ক্ষেত্রেই আমরা ঈশ্বর উপাসনার ভাব নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে থাকি। একে আমরা সাধারণ অর্থে সমাজসেবা হিসেবে গণ্য করি না, পূজা হিসেবে দেখি।
সদর কেন্দ্র: রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সদর কেন্দ্রটি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়, গঙ্গাতীরবর্তী বেলুড় অঞ্চলে। মানুষের মুখে মুখে ‘বেলুড় মঠ’ নামেই এই কেন্দ্রের পরিচয়। গঙ্গার পশ্চিম তীরে প্রায় ৪০ একর জমির ওপর ছড়ানো এই আয়তনটি বিগত এক শতাব্দী জুড়ে আধুনিক বাংলা তথা ভারতের আধ্যাত্মিক, বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে এক বিশাল ভূমিকা পালন করে আসছে। কলকাতা থেকে গাড়িতে বেলুড় মঠ মাত্র এক ঘন্টার পথ।