রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শ

রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের আর্দশের উৎস প্রাচীন ভারতের উপনিষদের বাণী, যাকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজের জীবনে প্রতিফলিত করে আধুনিক যুগের উপযোগী করে তুলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ এই নতুন ‘ফলিত বেদান্ত’-কে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন সারা বিশ্বে। সূচিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ আন্দোলন। এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হল—এটি আধুনিক—অর্থাৎ বর্তমান কালের উপযোগী; এটি সর্বজনীন—অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির কাছে বরণীয়; এবং এটি ব্যবহারিক দিক থেকে নির্মেদ ও বাস্তবমুখী, যা প্রতিদিনের জীবনের অংশ করে নেওয়ার পক্ষে সহজ।

রামকৃষ্ণ-ভাবাদর্শের মূল কথাগুলি এই:

১. ঈশ্বরলাভ মানুষ-জীবনের চরম লক্ষ্য: মানুষের জীবনের শেষতম লক্ষ্য হল পরমকে পাওয়া – যে ‘পরম’-কে বহু মানুষ ‘ঈশ্বর’ নামে অভিহিত করেন। বৈদিক যুগের ঋষিরা আবিষ্কার করেছিলেন যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জড়জগতের আড়ালে এক গভীরতর চৈতন্যময় জগৎ রয়েছে, যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, কোনোরকম বিশেষণের গণ্ডীতে যাকে আবদ্ধ করা যায় না। এই অনাদি, অনন্ত ও অসীম চৈতন্যময়তাকে সেই ঋষিরা নাম দিয়েছিলেন ‘ব্রহ্ম’। গুণাগুণের গণ্ডীতে ‘ব্রহ্ম’ বাঁধা পড়ে না বলে মানুষের মনে বা মানুষের ভাষায় তাকে স্পষ্টভাবে ধরা যায় না বটে, কিন্তু গভীর অধ্যবসায়ে তাকে অন্তর্জগতে উপলব্ধি করা সম্ভব। এই উপলব্ধিতে পৌঁছনোই মানুষ-জীবনের চরম লক্ষ্য।

২. সব মানুষের মধ্যেই দেবত্ব আছে: এই সৃষ্টি যদি ব্রহ্মময় হয়ে থাকে, তাহলে সহজেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে প্রতিটি মানুষ – এমনকী প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি বস্তুর মধ্যে ‘ব্রহ্ম’ নিহিত আছে। যদিও প্রতিদিনের সাংসারিক জীবনে এই বোধ সর্বক্ষণ জাগরূক রাখা দুরূহ, তবুও এ কথা আমরা মেনে নিতে বাধ্য যে আমাদের চোখে মানুষে-মানুষে যে প্রভেদ ধরা পড়ে তা আমাদেরই ভেদবুদ্ধির প্রভাবে। যে মুহূর্তে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারব, তখুনি নিজের ও অপরের প্রকৃত পরিচয় আমাদের কাছে ধরা দেবে। আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন হিসেবে নিজেদের চিনতে পারব।

৩. বিভিন্ন যোগের সমন্বয়: আমাদের প্রকৃত ঐশ্বরিক সত্ত্বার সঙ্গে এই যে আমাদের অক্ষয় যোগ, সেই যুক্ত থাকার বোধকে জাগিয়ে তোলা যায় যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে। যোগের চারটি পথ আছে-জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ, এবং কর্মযোগ। এর যে কোনো একটি পথ ধরে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। বিভিন্ন মানুষ তাদের ব্যক্তিগত গুণাগুণ সাপেক্ষে নিজের পক্ষে উপযুক্ত পথটি বেছে নিয়ে সাধনা করে। রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শে এই চারটি যোগের সম্মিলন ঘটিয়ে তাকে দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়। চার যোগের সম্মিলনের এই আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দের মস্তিষ্কপ্রসূত, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সুপরিচিত প্রতীকচিহ্নটিও এই সম্মিলনের ইঙ্গিতবাহী।

৪. শক্তি থেকে নৈতিকতা: স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, যে কোনো রকম স্বার্থপরতা এবং অনৈতিকতা আসলে দুর্বলতার রূপভেদ। এই দুর্বলতা শারীরিক হতে পারে, মানসিক হতে পারে, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিকও হতে পারে—কিন্তু মূলত সীমাবদ্ধ ও দুর্বল হবার বোধ থেকেই ভীরুতা ও অনৈতিকতার জন্ম নেয়। সুতরাং, নিজেদের অসীমের সঙ্গে অভিন্ন বলে চিনতে পারলে মানুষের আর দুর্বলতা থাকবে না, এবং ফলে তার মধ্যে অনৈতিকতাও জন্ম নেবে না। অমৃতের সন্তান বলে নিজেদেরকে বিশ্বাস করতে পারলে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি আপনা থেকেই জেগে উঠে তাকে উন্নততর করে তোলে।

৫. সর্বধর্ম সমন্বয়: ভারতবর্ষের বৈদিক ঋষিরা বহু যুগ আগে বলেছিলেন, “নদীরা যেমন আলাদা আলাদা আঁকাবাঁকা পথে বয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একই সাগরে মিলিত হয়, আলাদা আলাদা মত ও বিশ্বাস অবলম্বনকারীরাও তেমন নিজস্ব স্বতন্ত্র পথে এগিয়ে গিয়ে শেষপর্যন্ত একই সত্যে মিলিত হন।” শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে আমরা এই উপলব্ধিরই এক পুনরাভিনয় দেখতে পাই। তিনি বিজ্ঞানীর অধ্যবসায় নিয়ে একের পর এক ধর্মমত পরীক্ষা করে দেখেন, প্রতিটিতে সফলভাবে ঈশ্বরলাভ করেন, এবং সিদ্ধান্তে আসেন যে সব ধর্মই মূলত একই লক্ষ্যে মানুষকে নিয়ে যায়, ধর্মে-ধর্মে প্রভেদ সবটুকুই বাহ্যিক। সমগ্র পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, তাদের সবাইকে পারস্পরিক প্রেম ও শ্রদ্ধায় মেলানো যে সম্ভব, শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ হয়ে আছে।

ক) হিন্দুধর্মের অন্তর্নিহিত ঐক্য: হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুধর্মের ভেতর বহু সম্প্রদায় জন্ম নিয়েছে, যাদের রীতিনীতি ও সাধনপ্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন, এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে এই সম্প্রদায়গুলি পরস্পরবিরোধী। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবনে দেখালেন যে এই ভিন্নধর্মী সম্প্রদায়গুলি আসলে একই সত্যের উপাসক, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ভারতীয় দর্শন ও হিন্দুধর্ম, দেশ ও কাল এই দুই নিরিখেই বহুবিস্তৃত। সেই কারণে বহু রকমের মতবাদ ও বিশ্বাস তার আওতায় পড়ে। কিন্তু তাই বলে এই মতবাদগুলির মূল বক্তব্য আলাদা নয়, তাদের লক্ষ্যও আলাদা নয়। সমস্ত উপাস্য দেবতা ও সমস্ত উপাসনা পদ্ধতির সার একই।

খ) বিশ্বের ধর্মগুলির ঐক্য: বিশ্বায়নের ধারণার সঙ্গে মানুষের পরিচিত হবার যখন এক শতাব্দী বাকি, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মের জগতে বিশ্বায়নের সূচনা করেছিলেন। পারস্পরিক সহিষ্ণুতাই শুধু নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে যাতে সব ধর্মের মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলতে পারে, সেই দিশা তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনের মাধ্যমে এই বার্তা পৃথিবীবাসীর কাছে পৌঁছে দেন, এবং মানুষের বৌদ্ধিক ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। বর্তমান পৃথিবীতে ধর্মের উদার বাতাবরণের পেছনে এই বার্তার অবদান অপরিসীম।

৬: শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্ব: হিন্দুধর্মে অবতারবাদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। ঈশ্বর যখন মানুষের কাছাকাছি এসে তাকে অধর্ম থেকে ধর্মের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষ রূপেই অবতীর্ণ হন, তখন সেই মানুষ-রূপী ঈশ্বরকে অবতার বলা হয়। ধর্মগ্রন্থের উপদেশগুলিকে তাঁরা শুকনো তত্ত্বের খোলস থেকে মুক্তি দিয়ে বাস্তব জীবনে রূপায়িত করে দেখান। শ্রীরামকৃষ্ণ আধুনিক যুগের প্রয়োজনের জন্য অবতার হয়ে এসেছিলেন। এই বিশ্বায়িত-অথচ-বিচ্ছিন্নতাবাদী সময়ের উপযোগী করে ধর্মকে ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁর এই অভূতপূর্ব আত্মপ্রকাশ। শ্রীরামকৃষ্ণের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিবেকানন্দ “ভব-বৈদ্য” শব্দের প্রয়োগ করেছিলেন। আদর্শ বৈদ্য অসুখের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিক করেন। হৃদয়ে হৃদয়ে এমন দূরত্ব মানুষের ইতিহাসে আগে কখনো আসেনি; ইতিপূর্বে কোনো ধর্মপ্রচারক বা অবতারও নিজেকে সমগ্র বিশ্বের জন্য এমন উদারভাবে খুলে দেননি।

৭: কর্মের নতুন ব্যাখ্যাকরণ: স্বামী বিবেকানন্দ আধুনিক জগতের উপযোগী করে কর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যাতে যে কোনো কাজই পূজার সমান হয়ে ওঠে। শিব জ্ঞানে জীবের সেবাই এযুগের শ্রেষ্ঠ আরাধনা – এই শিক্ষাকে মাথায় রেখে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন পূজার ভাব নিয়ে সমাজসেবায় নিয়োজিত।

ক) সকল কাজই পবিত্র: বেদান্ত বলে, পার্থিব ও ঐশ্বরিকের মধ্যে আসলে কোনো বিভেদ নেই –উভয়েই একই ‘ব্রহ্মে’র প্রকাশ। সুতরাং ছোটো বড়ো সবরকম কাজই প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরেরই কাজ। ঐশ্বরিকতা কোনো প্রতিমা, প্রতীক বা দেবালয়ে আবদ্ধ হয়ে নেই – আপাতদৃষ্টিতে যা তুচ্ছাতিতুচ্ছ, তেমন জিনিসও সমানভাবে ঐশ্বরিক হতে পারে, যদি আমাদের দেখার চোখ তৈরী থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণের সেই চোখ ছিল বলেই তিনি সর্বভূতে ঈশ্বর দেখতেন। রামকৃষ্ণ পরিবারও সেই ভাব নিয়ে কাজ করে চলেছে।

খ) কর্মের মাধ্যমে উপাসনা: বস্তুমাত্রই যদি ব্রহ্মময় হয়, তাহলে কর্মমাত্রই ব্রহ্মের উপাসনা হতে বাধ্য—বেদান্তবাদী এমনটাই মনে করেন। তাই পবিত্র ও নিষ্কাম ভাব নিয়ে কাজ করে যাওয়া এবং কাজের ফল ঈশ্বরে অর্পণ করা রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মীদের এটাই আদর্শ। এই ভাব নিয়ে কাজ করতে করতেই ধীরে ধীরে ব্রহ্মের সঙ্গে ঐকাত্ম্যবোধ জেগে ওঠে।

গ) জীবের সেবাই শিবের সেবা: শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসিদ্ধতম উক্তিগুলির মধ্যে একটি হল জীবের প্রতি সাধকের মনোভাব প্রসঙ্গে তাঁর উপদেশ। তিনি বলেছিলেন, জীবে দয়া নয়, শিব-জ্ঞানে জীবের সেবাই আমাদের কর্তব্য। এই কথাটি সরল কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; বেদান্তে যে জগৎ ও ব্রহ্মের অভিন্নতার তত্ত্ব আছে, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ আমরা এর মধ্যে দেখতে পাই। রামকৃষ্ণ মিশনের মানবসেবামূলক সমস্ত ক্রিয়াকলাপের মূলে এই চিন্তাধারা রয়েছে।

ঘ) দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ: স্বামী বিবেকানন্দই প্রথম মানুষ যিনি ধর্মাচরণ ও সমাজসেবাকে আবশ্যিকভাবে সংযুক্ত করেছিলেন। বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কোনোরকম পলায়নবাদ জড়িয়ে নেই, জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে বিবেকানন্দ আমাদের বলেন না। বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও মানুষের হিতার্থে অবিরাম কাজ করে যেতে তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছেন সর্বক্ষণ। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারার একটি মূল কথা হল এই যে সংসারে যারা সর্বহারা, তাদেরকে মানুষের গৌরবে উন্নিত করে মানুষ-জাতির মূলস্রোতে বরণ করে নিতে হবে। এই কাজের জন্য অবশ্যই তাদের দৈহিক, মানসিক, বৌদ্ধিক, অর্থনৈতিক—সবধরনের উন্নয়ন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। রামকৃষ্ণ পরিবার চেষ্টা করে এই সেবাটুকু দরিদ্ররূপী নারায়ণের দোরে দোরে পৌঁছে দিতে।

ঙ) আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা হিসেবে কর্মের উপযোগিতা: যদি আমরা কর্মযোগীর দৃষ্টিতে জীবনকে দেখি, তাহলে অনুভব করব, আমাদের সব কাজের মধ্যেই একটি পূজার ভাব নিহিত থাকছে। কর্ম হয়ে উঠছে পূজা, এবং কর্মী হয়ে উঠছে এক বিশেষ ধরনের পূজক – যার উপাসনাগৃহ সমগ্র জগৎ, উপাস্য সারা বিশ্ব। এই পূজার অনন্যতা এই যে এতে শুধুমাত্র পূজকের আধ্যাত্মিক কল্যাণ হয় না, পার্থিব জগতেরও বাস্তবিক উপকার হয়। আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক –দুই অর্থেই এই পূজা সার্থক। স্বামী বিবেকানন্দের মতে বর্তমান পৃথিবীর পক্ষে এই পূজাই শ্রেষ্ঠ।

মূলমন্ত্র: এই বিশেষ ধরনের পূজার মূলমন্ত্রটি স্বামী বিবেকানন্দ ধরেছিলেন একটি পংক্তিতে – “আত্মনো মোক্ষার্থং জগৎ হিতায় চ”; যার অর্থ – “নিজের মুক্তি এবং জগতের হিতের জন্য।” রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শের সার কথাটুকু এই পংক্তিটির মধ্যে প্রকাশ পায়।