শ্রীমা সারদা দেবী
জন্ম: ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর, বাংলার বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামের এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরী দেবীর কোলে সারদা দেবীর জন্ম হয়। বাবা রামচন্দ্র ও মা শ্যামাসুন্দরী তাঁদের পবিত্র ও দানশীল স্বভাবের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। গ্রামের স্নেহময় পরিবেশে আনন্দে সারদা বড় হয়ে উঠতে থাকে।
বিবাহ: সারদা বাবা-মায়ের থেকে সহজাতভাবে ঈশ্বরভক্তি পেয়েছিল। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ, ভারতের গ্রামগুলিতেও কৃষিকাজেরই প্রাধান্য। সারদার দিনগুলি এসবের মধ্যেই কাটত, সে তার বাবা-মাকে ও অন্যান্য মানুষদের ছোটোখাটো কাজে সাহায্য করত। সারদা পাঠশালা যায়নি, তবে বাংলা অক্ষরজ্ঞান তার হয়েছিল। যখন সারদার বয়স ছয়, তখন কামারপুকুরের গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার বিয়ে হল। এই গদাধরই পরে রামকৃষ্ণ নামে জগদ্বিখ্যাত হবেন, তবে সে সময় আসতে এখনো বেশ দেরী। বিয়ে হল, কিন্তু অত ছোটো বয়সে বধূকে স্বামীর বাড়ি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল না বলে সারদা নিজের বাড়িতেই বড় হতে লাগল। গদাধর ফিরে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে।
দক্ষিণেশ্বরে আসা: সারদামণির বয়স যখন আঠারো, তখন তিনি জয়রামবাটী থেকে প্রায় ৯৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণেশ্বর আসেন কারণ, তাঁর কানে খবর পৌঁছেছিল যে তাঁর স্বামীর মানসিক অপ্রকৃতিস্থতা দেখা দিয়েছে। সে খবর সত্যি হোক বা মিথ্যা, এরকম সময়ে স্বামীর পাশে থাকাই কর্তব্য মনে করে সারদামণির কলকাতা আসা। এসে যদিও তিনি সঙ্গে সঙ্গে আসল কথা বুঝলেন – তাঁর স্বামীর দিব্যোন্মাদ অবস্থাকেই অজ্ঞ লোকে পাগলামি বলে ঠাহর করেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরম প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে অভ্যর্থনা জানালেন, এবং নিজের আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গী করে নিলেন। সারদাদেবী সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি সাধ্বীর জীবন যাপন করতে লাগলেন, জপ-ধ্যানে নিজেকে নিমগ্ন রেখে শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠলেন সহজেই। শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাকে তাঁর সহকারী বা শিষ্যা হিসেবে দেখতেন না, তিনি সারদার মধ্যে সাক্ষাৎ মহাশক্তিকে দেখতে পেতেন। মন্দিরের মা কালীই রক্ত-মাংসের মানুষীর রূপ ধরে স্ত্রী হয়ে আছেন-শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাব ছিল। ১৮৭২ সালে এক ঐতিহাসিক ক্ষণে ফলহারিণী কালীপূজার রাতে, শ্রীরামকৃষ্ণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূজাপদ্ধতি অনুসরণ করে ষোড়শোপচারে সারদামণির পূজা করেছিলেন। সারদার মধ্যে যে বিশ্বমাতৃত্বের ভাব সুপ্ত হয়ে ছিল, তা যেন সেদিন জাগ্রত হল।
দক্ষিণেশ্বরের জীবন: সারদার মাতৃত্ব এখন পূর্ণমাত্রায় জাগ্রত। ভবিষ্যতে তিনি এই প্রসঙ্গে বলবেন– তাঁর মাতৃত্ব কথার কথা নয়, সত্যিই তিনি জননীর সমান। একথার প্রমাণ রোজই তাঁর জীবনে নানাভাবে দেখা যেত। শ্রীরামকৃষ্ণের চারপাশে যেসব ভক্তরা সমবেত হতেন, সবার প্রতি সারদাদেবীর মাতৃসম ভালোবাসা ছিল। ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। দক্ষিণেশ্বরের অতি ছোট একটি ঘরে তিনি থাকতেন। অধিকাংশ দিনেই শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর দেখা হতে পারত না। কিন্তু এই সব কষ্টকেই তিনি নিজেকে আদর্শভাবে তৈরী করার সাধনার অংশ হিসেবে দেখতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কলকাতার নাগরিকসমাজের সগোচরে ইতিহাস তৈরী করছিলেন, তখন সেই সঙ্গে সমান্তরালভাবে সবার অগোচরে শ্রীমা সারদার ইতিহাসও প্রস্তুত হচ্ছিল।
সঙ্ঘজননী: ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ শরীর রাখলেন। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াদি শেষ হবার পরে সারদাদেবী কয়েকমাস তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালেন, পরে কামারপুকুরে ফিরে এসে নিরালায় জীবনযাপন করতে লাগলেন। কিন্তু একান্তে জীবন কাটানো সারদাদেবীর জন্যে নয়। কলকাতার ভক্তেরা সবাই মিলে তাদের ‘শ্রীমা’-কে তাদের কাছে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগল। এখন থেকে শ্রীমা সারদাই সদ্যোজাত রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনকে দিশা দেখাবেন, হয়ে উঠবেন ‘সঙ্ঘজননী’। তাঁর কাছে সব মানুষেরই হবে অবাধ যাতায়াত। সন্তানদের ব্যাপারে মা সারদার যে কতদূর সমদৃষ্টি ছিল তা বলা বাহুল্য। তৎকালীন সমাজে ভারতীয় নারীর এক ব্যতিক্রমী নজির হয়ে তিনি উজ্জ্বল। নিবেদিতার ভাষায় তিনি একাধারে প্রাচীন আদর্শের শেষ প্রতিনিধি ও নবীন আদর্শের অগ্রদূত। গৈরিকধারী সন্ন্যাসী থেকে আরম্ভ করে পেশাদার ডাকাত – সবাইকে তিনি মায়ের মতো করে আপন করে নিতেন। এরকম অজস্র ঘটনা বহু মানুষের স্মৃতিকথায় সযত্নে রক্ষিত আছে। মা সারদার আশ্চর্য আধুনিক মানসিকতার আরেকটি প্রমাণ আমরা এই সময়ে পাই – যখন তিনি স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্তকে মনেপ্রাণে সমর্থন করে তাঁকে আশীর্বাদ পাঠান। তখনকার ভারতবর্ষের বহু কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মনেতা বিবেকানন্দের আমেরিকা যাওয়াকে ভালো চোখে দেখেননি, সাধারণ মানুষদেরও এক অংশ এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু মা সারদার আশ্বাস ও আশীর্বাদ পাবার পর স্বামীজী আর পেছন ফিরে তাকাননি। স্বামীজী ফিরে আসার পরেও, তাঁর বিদেশী ভক্তদের সবার আগে বরণ করে নিয়েছিলেন মা সারদাই। এই প্রসঙ্গে বহু মর্মস্পর্শী বিবরণ ভগিনী নিবেদিতার স্মৃতিকথায় রয়েছে। এই সময়ে মা সারদার জীবন কাটত কখনো কলকাতায়, কখনো জয়রামবাটীতে তাঁর গ্রামে। প্রথমদিকে স্বামী যোগানন্দ তাঁর সব প্রয়োজন ও দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, পরে স্বামী সারদানন্দ সেই ভার নেন। স্বামী সারদানন্দের তত্ত্বাবধানেই কলকাতায় মায়ের জন্য নতুন বাড়ি তৈরীর কাজ শুরু হয়।
সরলতা ও সহনশীলতা: সম্ভবত মা সারদার সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর সারল্য ও সহ্যক্ষমতা। তিনি এমনই সাদাসিধেভাবে থাকতেন যে তাঁর কাছে যেতে কারো কোনোদিন সঙ্কোচ বোধ হত না। এমনকী শ্রীরামকৃষ্ণের কাছেও সব শ্রেণীর মানুষ যেতে পারত না, সাধনার জন্য তাঁর মন এমনই উঁচু তারে বাঁধা থাকত যে বৈষয়িক মানুষের সান্নিধ্যে তাঁর বিশেষ অসুবিধা হত। মায়ের কাছে এরকম কোনো বাধা ছিল না, সবার জন্যেই তাঁর দরজা ছিল খোলা। জয়রামবাটীতে তাঁর যে ভাইয়ের সংসারে তিনি থাকতেন, সেই বাড়ীর পরিবেশ সয়ে থাকাও শক্ত ছিল, কিন্তু মায়ের তা নিয়েও অভিযোগ ছিল না। কোনোরকম ছায়া তাঁকে মলিন করতে পারত না, তিনি সবকিছুকেই উজ্জ্বল করে তুলতেন।

সকলের মা: ইতিহাসে আমরা দেখি, যুগে যুগে মহৎ মানুষেরা সমগ্র মানবজাতিকে আত্মীয় জ্ঞান করার কথা বলেছেন ও নিজেদের জীবনে তার উদাহরণ রেখেছেন। কিন্তু সম্ভবত মা সারদাই প্রথম নজির, যেখানে শুধুমাত্র মানবজাতিই নয়, সমস্ত প্রাণীজগৎকে আত্মীয়বন্ধনে বাঁধবার ধারণা প্রকাশিত। সারদাদেবী নিজেকে আক্ষরিক অর্থেই জগজ্জননীর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন – যে জগতে মানুষ ছাড়াও রয়েছে আরো অনেকে। তাঁর এই অসীম সাহস ও ঔদার্য্যের বলেই বলীয়ান হয়ে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের তরুণ সন্ন্যাসীরা সেই প্রথম দিনগুলিতে পথের দিশা পেতেন।

আদর্শ নারী: নারীত্বের কোনো একটিমাত্র আদর্শ থাকা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু মা সারদা একমাত্রিক চরিত্র ছিলেন না। তাঁর জীবনের শুভ্রতা সাত রঙের মিলনের শুভ্রতা, তা থেকে আমরা সবাই নিজেদের জীবনকে গভীরতর রঙে রঞ্জিত করতে পারি। ভারতবর্ষে নারীত্ব যে পবিত্রতা, স্নেহ, প্রজ্ঞা ও ভালোবাসার প্রতীক, মা সারদা সেই নারীত্বের আদর্শ উদাহরণ ছিলেন।

শেষের দিনগুলি: কথায় বলে, আয়ুর মাপে জীবনের মূল্য নয়, জীবনের মাপেই আয়ুর মূল্য। মা সারদার আয়ুর সবটুকুই এমন জীবনময় ছিল যে তার প্রভাবে আমরা রামকৃষ্ণ আন্দোলন পেলাম, পৃথিবীর কাছে যার মূল্য অপরিসীম। তবে প্রকৃতির নিয়মে আয়ু ফুরায়। নিরন্তর পরিশ্রম ও সন্তানদের দেখাশোনার করার চাপে মায়ের শরীর ক্রমে ভেঙে পড়তে লাগল। অবশেষে, ১৯২০ সালের ২১শে জুলাই, এই মাটির পৃথিবী থেকে মা বিদায় নিলেন। তিনি বেঁচে রইলেন পৃথিবী-ভরা তাঁর সন্তানদের স্মৃতিতে, তাদের হৃদয়ে।