স্বামী বিবেকানন্দ

১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারী, কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিশ্বনাথ দত্ত এবং ভুবনেশ্বরী দেবীর কোলে স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল নরেন্দ্রনাথ – ছোট করে ডাকা হত নরেন। বিশ্বনাথ দত্ত একজন সফল আইনজীবী ছিলেন। নরেন্দ্রনাথের বাবা ও মা দু’জনেই ছিলেন শক্তিশালী চরিত্রের অধিকারী এবং গভীর নীতিবোধসম্পন্ন। নরেনের সর্বমুখী প্রতিভা ছিল – গানবাজনা, খেলাধূলা এবং ডানপিটেমি – সবেতেই সে ছিল সেরা। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও তার অত্যাশ্চর্য মনীষা ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে ইতিহাস ও দর্শনের প্রতি বিশেষ আগ্রহ বোধ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতদিনে সে স্নাতক হয়ে বেরোচ্ছে, ততদিনে নরেন্দ্রনাথ একজন পুরোদস্তুর আধুনিক, প্রগতিশীল বাঙালি যুবক। নরেন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই যোগ-ধ্যানের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিল। ছোটবেলায় সে নিয়মিত পরম মগ্ন হয়ে ধ্যান করত। এর সঙ্গে তার ছিল নিঃস্বার্থভাবে দান করার স্বভাব। এই গুণগুলি তার ভবিষ্যৎ জীবনে মূল ভূমিকা পালন করবে।

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে
নরেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সত্যের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু তিনি অন্ধভাবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। ফলে, তিনি এমন এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন যেখানে তাঁকে সদুত্তর দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। এরকম সময়ে তাঁর কানে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা আসে: কলেজের এক অধ্যাপক তাঁর ক্লাসে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থকে নিয়ে আলোচনা করার সময় নাকি দিব্যানুভূতির জীবন্ত উদাহরণ হিসাবে দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণের নাম উল্লেখ করেছেন। নরেন্দ্রনাথ ঠিক করেন, একদিন এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলতে হবে। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের সালের নভেম্বর মাস, একদিন নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে গেলেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে সরাসরি প্রশ্ন করেন – যা তিনি এর আগে কয়েক ডজন লোকের কাছে করেছেন এবং সদুত্তর পাননি – “আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?” – এবং শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, “হ্যাঁ, দেখেছি। আমি এখন তোকে যেমন দেখছি, তার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দেখেছি। তুই চাইলে তোকেও দেখাতে পারি।” নরেন্দ্রনাথ শীঘ্রই শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ বৃত্তের অংশ হয়ে ওঠেন। দক্ষিণেশ্বরে তাঁর নিজের মতো আরো বেশ কয়েকজন যুবকের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব হয়। রামকৃষ্ণ আন্দোলনের নির্মাণকাজ এখানেই শুরু হয়েছিল, যদিও তখনো তা এই যুবকদের ধারণার অগোচর।

দুঃসময়
কয়েক বছরের মধ্যে পরপর দুটি ঘটনা নরেন্দ্রনাথের জীবনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বনাথ দত্ত মারা যান। এই ঘটনায় নরেনের পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে, কারণ বিশ্বনাথ তাঁর দানশীনতার জন্য আয়ের চেয়ে বেশী ব্যয় করতেন, এবং সেইজন্য তাঁর প্রচুর ঋণ জমেছিল। নরেন্দ্রনাথ এখন তাঁর মা এবং ভাইবোনদের সংসার চালাবার প্রধান সহায় হয়ে দাঁড়ালেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি হল গলার ক্যান্সারের কারণে শ্রীরামকৃষ্ণের অসুস্থতা। শ্রীরামকৃষ্ণকে এইসময় কাশীপুরের একটি প্রশস্ত বাগানবাড়ীতে স্থানান্তরিত করা হয়, এবং তাঁর শিষ্যরা দিনরাত তাঁর যত্ন নিতে থাকেন। নরেন্দ্রনাথকে একসঙ্গে দু’টি দিকে লড়াই করতে হচ্ছিল: বাড়িতে তাঁর পরিবারের ভরণপোষণ, এবং বন্ধুদের সাথে মিলে তাঁর গুরুর যত্ন নেওয়া। বন্ধুরা সবাই তাঁকেই নেতা হিসাবে দেখেছিল।

বিপ্লবের আরম্ভ
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর তরুণ শিষ্যদের ভ্রাতৃত্ব ও ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন; একদিন তিনি তাঁদের কাছে ডেকে প্রত্যেককে গেরুয়া পোষাক দিলেন – যা একজন ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস দান করার প্রতীক। পোশাকগুলো তাঁদের দিয়ে তিনি তাঁদের ভিক্ষা করতে পাঠালেন: নতুন সাধুদের সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করার এবং সঙ্ঘবদ্ধ হবার এ এক নীরব ঘোষণা। শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথকে এই নতুন সঙ্ঘ গঠনের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন। অবশেষে, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ অগাস্ট শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর নশ্বর দেহ ছেড়ে গেলেন। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর এই তরুণ শিষ্যেরা একত্রিত হয়ে উত্তর কলকাতার বরানগরে একটি জরাজীর্ণ বাড়িকে মঠ করে সেখানে সন্ন্যাসী হিসেবে থাকতে শুরু করেন। জাগতিক কষ্টসহন ও আধ্যাত্মিক আনন্দে তাঁদের দিন কাটত। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁরা আনুষ্ঠানিক ব্রত করে নতুন সন্ন্যাস-নাম গ্রহণ করেন। নরেন্দ্রনাথ হলেন স্বামী বিবেকানন্দ – যদিও এর আগে অন্য দু’একটি নাম তিনি কিছুদিন ব্যবহার করেছিলেন।

পথের দিশা
সন্ন্যাসগ্রহণ হল। কিন্তু বিবেকানন্দ অনুভব করেছিলেন যে এতেই যথেষ্ট নয়, তাঁর আরও কিছু করার আছে; ভবিষ্যতের দিগন্তে এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞের অনুভূতি তার মনে উদিত হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কাছে এমন একজন, যিনি কেবলমাত্র ভক্তদের একটি ছোট গোষ্ঠীর জন্যই নয়, সমগ্র ভারতে, এমনকী সমগ্র বিশ্বের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এই মনোদর্শনকে কীভাবে বাস্তবায়িত করা যাবে তার পুরো উত্তর তাঁর কাছে ছিল না, তবে যা সামনে নেই তাকে খুঁজে বের করার জেদ বিবেকানন্দের বরাবরের। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের অন্তরাত্মাকে আবিষ্কার করার জন্য পরিব্রাজক সাধু হয়ে পথে বেরিয়ে পড়েন। এ এক ঐতিহাসিক যাত্রা – যা দীর্ঘ তিন বছর ধরে চলবে। বাকি গুরুভাইয়েরা বরানগর মঠে রইলেন, মা সারদার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে বিবেকানন্দ নামলেন পথে।

ভারতের খোঁজে
বিবেকানন্দের ভারতভ্রমণ তাঁকে নিম্নতম শ্রমজীবিদের কুটির থেকে বিলাসবহুল রাজাদের প্রাসাদ–সর্বত্র নিয়ে গিয়েছিল; সে সফরের বিবরণ দিতে গেলে তা এক রোমাঞ্চকর কাহিনি হয়ে দাঁড়ায়। এই যাত্রাপথে তিনি ধীরে ধীরে চিনলেন মাতৃভূমির আসল চেহারা। তিনি বুঝলেন যে প্রকৃত ভারত বাস করে পথের ধুলোয়, উপেক্ষিত অবহেলিত জনসাধারণের মধ্যে। তিনি বুঝলেন যে নতুন ভারতকে বেরোতে হবে লাঙ্গল ধরে, গরীব চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মালা, মুচি এবং মেথরদের মলিন ছিন্ন জীবনের সুতো দিয়েই বোনা হবে তার ভবিষ্যৎ। লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধা ও অজ্ঞতার মধ্যে বাস করছে–তিনি এ দৃশ্য দেখেছিলেন, এবং তাদের দুর্দশা তাঁর হৃদয়ে ছুরিকাঘাত করেছিল। তিনি বুঝলেন যে ভারতের উপস্থিত প্রয়োজন দ্বিমুখী– জনসাধারণের কাছে পাশ্চাত্য সভ্যতার সুফলগুলি নিয়ে আসার জন্য একটি সম্পূর্ণ আধুনিক ব্যবস্থা– তাদের উন্নত কৃষি পদ্ধতি শেখানো, শিল্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মেজাজ জাগ্রত করা; এবং এর পাশাপাশি, প্রতিটি মানুষই যে ঐশ্বরিক সম্ভাবনা রাখে, এই বৈদান্তিক প্রত্যয় মানুষের মনে পুনরুজ্জীবিত করা। এই আত্মবিশ্বাসের বোধ, নিজের অতীত এবং ভবিষ্যতের প্রতি এই বিশ্বাস—এটাই ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের মন থেকে বহু শতাব্দীর জমাট অন্ধকার দূর করতে পারে। বিবেকানন্দ দেখেছিলেন, ধর্মই ভারতের প্রাণভোমরা। নিদারুণ দারিদ্র্য সত্ত্বেও ভারতীয়দের মধ্যে সর্বত্র ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ বজায় থাকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বেদান্তের বার্তা দিয়ে এই মনগুলিকে প্রভাবিত করতে এবং সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক জীবনের বিশাল স্রোতে তাদের ফিরিয়ে আনতে একটি জিনিস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হল শিক্ষা। শিক্ষাই ভারতের সমস্ত সমস্যার সমাধান।

সঙ্ঘের পরিকল্পনা
বিবেকানন্দে বুঝলেন, দেশের প্রয়োজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের একটি সুদক্ষ সংগঠন যা জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করবে এবং তাদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক দুর্বলতা থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনার কাজ করবে। তাঁর এই উদ্দেশ্য পূরণ হবে আরও কয়েক বছর পরে, যখন তিনি রামকৃষ্ণ মিশন গড়ার কাজে হাত দেবেন।

প্রচারের পরিকল্পনা
স্বামীজীর মনে যখন এই ধারণাগুলি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তখন বিশ্ব-ধর্ম-সম্মেলনের কথা তাঁর কানে পৌঁছয়। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে শিকাগোতে এর আয়োজন করা হয়, এবং সারা বিশ্বের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিবেকানন্দের বন্ধু ও ভক্তেরা, যারা তাঁর ভেতরের শক্তিকে চিনতে পেরেছিলেন, তারা প্রবলভাবে চেয়েছিলেন তিনি যেন এই মহাসম্মেলনে উপস্থিত হন। স্বামীজী নিজেও একই কথা অনুভব করেছিলেন– এই ধরনের একটি আন্তর্জাতিক ঘটনা শ্রীরামকৃষ্ণকে ভারত ও বিশ্বের সামনে নিয়ে আসার জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বামীজী প্রথমে দ্বিধান্বিত ছিলেন। অবশেষে, ভারতীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে কন্যাকুমারীতে একটি শিলা-দ্বীপে বসে ধ্যান করার মুহূর্তে তিনি নিজের ভেতরে ঐশী অনুপ্রেরণা খুঁজে পান, এবং তাঁর মন সুদৃঢ় হয়। মা সারদার দেওয়া আশ্বাস ও আশীর্বাণী তার আত্মবিশ্বাস এবং সংকল্পকে শক্তিশালী করেছিল। তাঁর চেন্নাইয়ের শিষ্যদের এবং খেতুড়ির মহারাজার সংগৃহীত এক তহবিলের সাহায্যে শেষপর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ মে মুম্বাই থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

বিশ্ব-ধর্ম-সম্মেলন এবং তার পরে
১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-ধর্ম-সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাত্ক্ষণিক খ্যাতি এনে দেয়। তার পরে তিনি পাশ্চাত্যে প্রায় সাড়ে তিন বছর কাটান, জনসমক্ষে বহু বক্তৃতা দেন এবং ব্যক্তিগত জমায়েতেও নানা প্রসঙ্গ আলোচনা করেন, বেদান্তের বাণী এবং শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবের প্রচার করেন। এই সময়ে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল এবং পরে লন্ডন তাঁর কর্মক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

স্বদেশে
১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে বিবেকানন্দ ভারতে ফিরে এলেন। সর্বত্রই তাঁর জন্য বিপুল জনসমাগম, মানুষ ভিড় করে তাঁকে পরম উত্সাহে স্বাগত জানায়। দেশের মানুষ খবরের কাগজে তাঁর বিদেশের ক্রিয়াকলাপ আগাগোড়াই অনুসরণ করেছিল। তিনি শহর থেকে শহরে ভ্রমণ করতে লাগলেন – এই সফর যেন কয়েক বছর আগেকার সেই যাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন তিনি এক অচেনা অজানা সন্ন্যাসী মাত্র– বিবেকানন্দ নামটিও যখন স্থিরতা পায়নি। বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে তাঁর বক্তৃতায় স্বামীজি কয়েকটি মূল বিষয় তুলে ধরলেন:

• ভারতের উচিত তার নিজস্ব আধ্যাত্মিক শিকড় সনাক্ত করা এবং তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা।

• হিন্দুধর্মের উচিত সমস্ত সাম্প্রদায়িক জটিলতা দূর করা এবং এর অধীনে আসা সমস্ত বিশ্বাসের একতাকে স্বীকৃতি দেওয়া।

• সুবিধাভোগী শ্রেণী, যাদের শিক্ষা এবং আর্থিক সুবিধা রয়েছে, তাদের উচিত দরিদ্র জনসাধারণের উদ্ধারে আন্তরিকভাবে নিজেদের উৎসর্গ করা; সাধারণ মানুষ যে ঐতিহাসিক অবিচারের শিকার হয়েছে, ব্যবহারিক বেদান্তের মাধ্যমে তার প্রতিকার করতে হবে।

রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা
স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ প্রচারের জন্য যে সঙ্ঘের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এইবারে তা সত্যি হল। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ১ মে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হল – বৈদান্তিক ভাবধারার প্রচার এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গ্রামীণ উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সেবাকাজের লক্ষ্যে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের কাজের পরিসর বাড়তে বাড়তে সারা ভারতে, এবং তার পরে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মতো বড়ো কাজও রামকৃষ্ণ মিশনের কাজের অন্তর্ভুক্ত হয়।

বেলুড় মঠ
একটি প্রতিষ্ঠানকে যদি ভালোভাবে কাজ করতে হয়, তবে তার পায়ের তলায় শক্ত মাটি প্রয়োজন– রূপক ও আক্ষরিক, দুই অর্থেই। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ গঙ্গার পশ্চিম তীরে বেলুড়ে একটি বড় জমি কেনেন। বরানগর মঠে যে সঙ্ঘের শুরু হয়েছিল, তারই একটি স্থায়ী আবাস হবে এই নতুন মঠ; এটি মঠ ও মিশনের সদর দফতর হিসাবেও কাজ করবে। বেলুড় মঠ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন আদর্শকে আধুনিক জীবনে প্রয়োগের এক সার্থক উদাহরণ হয়ে মানুষের কাছে বরণীয় হয়ে উঠেছে; এ এমন এক সঙ্ঘ যা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণকে সমান গুরুত্ব দেয়; যা সমাজসেবাকে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অনুশীলন বলে বিবেচনা করে; এবং যা লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম বা বর্ণের বৈষম্যকে স্বীকার না করে সারা বিশ্বের জন্য নিজেকে উন্মুক্ত রাখে।

শিষ্যেরা
স্বামী বিবেকানন্দের কাজের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল বিদেশের বহু মানুষের জীবনে তাঁর প্রভাব। তাঁদের অনেকেই তাঁর শিষ্য বা একনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন। সেই সময়ে ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে একটি উপনিবেশ ছিল, বিশ্বের চোখে তার কোনো স্বাধীন অবস্থান ছিল না। স্বামীজীর বিদেশী শিষ্যেরা পাশ্চাত্যে ভারতকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মার্গারেট নোবেল (পরে যিনি ভগিনী নিবেদিতা নামে পরিচিত), সেভিয়ার দম্পতি, জোসেফিন ম্যাকলিওড, সারা ওলি বুল, এবং অন্যান্য। নিবেদিতা এক উজ্জ্বল উদাহরণ যাঁর জীবন ভারতের সেবায় উৎসর্গিকৃত হয়েছিল; তিনি কলকাতায় মেয়েদের শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে এক প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং ভারতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের অনেক ভারতীয় শিষ্যও ছিলেন, যাঁদের মধ্যে অনেকেই সন্ন্যাস নিয়ে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে যোগ দিয়েছিলেন।

শেষ দিন
১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে বিবেকানন্দ দ্বিতীয়বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। এইবারে তিনি আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বেশী মনোযোগ দেন, সেখানেই অধিক সময় কাটান। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি বেলুড় মঠে ফিরে আসেন। এর পর থেকে তার সময় এখানেই কাটত, মানুষের মধ্যে কাজ করে, তাদেরকে অনুপ্রাণিত ও আলোকিত করে তাঁর দিন যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, অবিরাম কাজের চাপে স্বামীজীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে থাকে। যদিও তাতে তাঁর ক্লান্তি ছিল না কখনো।

১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ জুলাই স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যানরত অবস্থায় দেহত্যাগ করেন। তাঁর মহাসমাধির আগে, তিনি এক বন্ধুকে লিখেছিলেন – “এমন হতে পারে যে আমি আমার দেহের বাইরে বেরিয়ে জীর্ণ পোশাকের মতো এটিকে ফেলে দেওয়াই ভাল মনে করব। আমি কাজ বন্ধ করব না। আমি সর্বত্র মানুষকে অনুপ্রাণিত করব, যতক্ষণ না সমগ্র বিশ্ব নিজেকে ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন বলে জানতে পারে।”

বিশ্ব সংস্কৃতিতে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এ এল ব্যাশাম স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে লিখেছেন: “…আগামী শতাব্দীতে, তিনি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রধান রূপকার হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন…।” এই মূল্যায়ন বিবেকানন্দের অসংখ্য অবদানের উপর ভিত্তি করে করা। তাদের মধ্যে কয়েকটি নীচে সংক্ষেপে বলা হল:

ধর্মের নতুন উপলব্ধি: স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মকে অতীন্দ্রিয় সত্যের সর্বজনীন অভিজ্ঞতা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা সমস্ত মানবজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি বিজ্ঞান এবং ধর্মের আপাত-বিরোধিতার সমস্যার সমাধান করেছিলেন, বলেছিলেন যে তারা একে অপরের বিপরীত নয়, তারা পরস্পরের পরিপূরক। তিনি ধর্মকে ‘চেতনার বিজ্ঞান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ধর্মের এই পুনঃসংজ্ঞায়ন তাকে সবরকম কুসংস্কার, গোঁড়ামি, রহস্যবাদ এবং সর্বোপরি আন্তঃধর্মীয় দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত করেছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে পরম স্বাধীনতা, শাশ্বত জ্ঞান এবং বাধাহীন আনন্দের সাধনা।

মানবতার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি: বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে প্রতিটি মানুষই প্রকৃত পরিচয়ে ঐশ্বরিক। আধুনিক যুগ মানবতাকে অগ্রগতির পথ ধরে এমন ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছে যে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা প্রকটতর হয়ে উঠেছে। বিবেকানন্দের ঐশ্বরিক মানবতাবাদ এই বিপদের থেকে আমাদের উদ্ধার করতে কার্যকরী হয়। স্বামীজীর দেহ রাখার ঠিক পরের দশকগুলি ইতিহাসের সবচেয়ে হতাশাজনক কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়েছে; আমরা দুটি রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি, অমানুষিক পর্যায়ের অমানবিক কাজ করেছি, ক্ষয়হীন লজ্জার বোঝা কাঁধে তুলেছি। এমন রক্ত-রাঙা ইতিহাসের পরেও মানুষের দেবত্বে বিশ্বাস ধরে রাখতে বিবেকানন্দের মতো অবিচল বিশ্বাস প্রয়োজন। বস্তুবাদের ব্যাধিকে রুখে দেবার কাজে আজ বিবেকানন্দের বার্তা স্বদেশে-বিদেশে প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল।

নৈতিকতার নতুন দৃষ্টান্ত: পাশ্চাত্য নৈতিকতা মূলত বাইবেল-কথিত শাস্তির ধারণার ওপর নির্ভরশীল; নরকের আগুন থেকে পালানোই অনৈতিকতা থেকে দূরে থাকার জন্য মানুষের সবচেয়ে বড় প্রণোদনা। বিবেকানন্দ এই জাতীয় ভয়-নির্ভর মতবাদকে গুরুত্ব দিতেন না। তিনি মানুষকে নৈতিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন কারণ নৈতিকতাই মানুষের আসল প্রকৃতি। মানুষের আত্মা পাপের দ্বারা কলঙ্কিত হয় না – আমরা সকলেই অমৃতের সন্তান। নৈতিকতার এই বৈদিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে স্খলিত অপরাধীর চেয়ে অনেক উচ্চতর স্তরে উন্নীত করেছে।

প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন: স্বামী বিবেকানন্দ প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন করার জন্য সারা জীবন কাজ করেছিলেন। তাঁর লেখা ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ বইটি এই দুই সংস্কৃতির সবচেয়ে উজ্জ্বল তুলনামূলক বিশ্লেষণগুলির মধ্যে একটি। ভারত সম্বন্ধে পাশ্চাত্য জনগণের মনে যে ভুল ধারণা ছিল তা দূর করার জন্য তিনি বিদেশে কাজ করেছেন; অন্যদিকে তিনি ভারতে কাজ করেছেন সাধারণ মানুষের কাছে তাদের হারানো আত্মসম্মান ফিরিয়ে দিতে, এবং পশ্চিম থেকে কোন গুণগুলি গ্রহণ করতে হবে এবং কোনগুলি বর্জন করতে হবে তা শেখাতে। বিগত শতাব্দীতে ভারত নিজের চারপাশে যে বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর তৈরি করেছিল তা ভেঙে দিতে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে যুক্তিসম্মত চিন্তাভাবনা এবং মানবতাবাদী মূল্যবোধের জোয়ার এনেছিলেন। বিদেশে অনেক উল্লেখযোগ্য পণ্ডিত সহ অগণিত মানুষ তাঁর মধ্যে যা দেখেছিলেন, তার উপর ভিত্তি করেই ভারত সম্পর্কে তাঁদের ধারণা তৈরি করেছিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা এই প্রসঙ্গে আমাদের স্মরণ হয়, যিনি একবার বলেছিলেন: “যদি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে অধ্যয়ন কর।”

ভারতে স্বামীজীর অবদান
ভারতের ইতিহাসে স্বামী বিবেকানন্দই একমাত্র সংস্কারক যিনি সারা ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেছিলেন, এবং এই দেশের বৈচিত্র্য এবং ঐক্য দুইয়েরই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তার অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি আমাদেরকে ভারতবর্ষের পরিচয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের ভূমিকা সম্পর্কে এক নতুন ধারণা দিয়েছে। তিনি আমাদের ভারতের গৌরবময় অতীতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, এবং তার পাশাপাশি, তিনি ভারতীয়দের পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলির মধ্যে তফাৎ করে সঠিক জিনিসগুলিকে বেছে নিয়ে আত্মস্থ করতে শিখিয়েছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনুপ্রেরণার মূল উৎস হয়ে ওঠেন। তাঁর অগ্নিগর্ভ বার্তা তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায় এবং তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ তাদের নিঃস্বার্থ এবং সাহসিকতায় উদ্বুদ্ধ করে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, যিনি নিজেকে বিবেকানন্দের একজন ভাবশিষ্য বলে মনে করতেন, লিখেছেন: “স্বামীজী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, ধর্ম ও বিজ্ঞান, অতীত ও বর্তমানকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছেন। আর সে কারণেই তিনি মহান। তাঁর শিক্ষা থেকে আমাদের দেশবাসী অভূতপূর্ব আত্মমর্যাদা, আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে।”
এটা মনে রাখা জরুরী যে স্বামী বিবেকানন্দ সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন। নিঃস্বার্থপরতা ছিল তার স্বভাব। ভারতে কার্ল মার্কস পরিচিত ও পঠিত হওয়ার অনেক আগে বিবেকানন্দই নিজেকে প্রকাশ্যে সমাজতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করেছিলেন, এবং নিপীড়িত মানুষদের উন্নীত করার এবং তাদের মানবাধিকার দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

হিন্দু ধর্মে স্বামীজির অবদান
• পরিচয়: স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মকে আধুনিক যুগের উপযোগী একটি পরিচয় দিয়েছেন। একই শিকড় থেকে উদ্ভূত হলেও, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে বহু শতাব্দীর বৈষম্যের কারণে ধীরে ধীরে তাদের আসল চরিত্র হারিয়েছিল। স্বামীজী এই অবহেলিত অতীতের কাছে ফিরে যান এবং বনের বেদান্তকে ঘরের বেদান্ত করে জাতীয় সাধারণ জীবনে এটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি জনগণের কাছে একমাত্র যা চেয়েছিলেন তা হল পারস্পরিক গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্প্রীতি। হিন্দুধর্মকে তিনি তার আধুনিক কাঠামো দিয়েছেন।
• একীকরণ: হিন্দুধর্মের মতো প্রাচীন এক আধ্যাত্মিক ব্যবস্থাকে অপরিবর্তনশীলভাবে একটিমাত্র রূপে ধারণ করা যায় না, সাম্প্রদায়িক পার্থক্য কিছু না কিছু থাকবেই। সুদৃঢ় সম্প্রীতির অনুভূতি না থাকলে এই ধর্মের বিভিন্ন দলের সহাবস্থান সম্ভব নয়। বিবেকানন্দ এই সম্প্রীতির পাঠ শিখেছিলেন এর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা শ্রীরামকৃষ্ণের থেকে। তিনি তাঁর কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই শিক্ষাটি প্রয়োগ করেছিলেন। ঐতিহাসিক কে এম পানিকর লিখেছেন, “এই নতুন শঙ্করাচার্যকে হিন্দু মতাদর্শের একীভূতকারী বলে দাবি করা যেতে পারে।” বিবেকানন্দ তাঁর নবীন সঙ্ঘে কেবলমাত্র হিন্দুধর্মের সমস্ত সম্প্রদায়কে একীভূত করেননি, তিনি এতে অন্যান্য ধর্মের ধারাগুলিকেও একত্রিত করেছিলেন। এর একটি সুন্দর উদাহরণ বেলুড় মঠের মূল মন্দিরের স্থাপত্যে দেখা যায়, যা বিভিন্ন শিল্পরীতি এবং বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে তৈরী।
• দেশজ সংস্কৃতির রক্ষা: স্বামী বিবেকানন্দ পশ্চিমে অত্যন্ত সাহসীভাবে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতকে ক্রমাগত বর্ণবাদী পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্যের মাধ্যমে চিত্রিত করা হত। স্বামীজী ঘৃণাকে ঘৃণা দিয়ে প্রতিহত করেননি, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতের সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গীর মূল কারণ হল অজ্ঞতা, এবং অজ্ঞতাকে প্রতিহিংসা দিয়ে নয়, শিক্ষা দিয়ে নিবারণ করতে হবে। তিনি বিদেশে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলিকে সংশোধন করার জন্য বহু পরিশ্রম করেছিলেন এবং বিদেশীদের মনোভাবে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে ব্যাপকভাবে সফল হন। এই পদক্ষেপগুলি ভারতীয় যুবকদের পশ্চিমের অলস অনুকরণের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতেও যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। একই সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যের গুরুত্বপূর্ণ মানবতাবাদী মূল্যবোধগুলিকে হিন্দু সমাজে একীভূত করেছিলেন, যা এই নতুন যুগের পক্ষে অত্যন্ত কার্যকরী হয়।

• সন্ন্যাসের নতুন আদর্শ: শ্রীরামকৃষ্ণের শিবজ্ঞানে জীবসেবার যে বৈপ্লবিক ধারণা, স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনকে রূপ দেওয়ার সাথে সাথে তাকে সুনির্দিষ্ট আকার দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ত্যাগের শৃঙ্খলা এবং পরম উপলব্ধির সাধনা সমাজসেবার সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল – যা সঙ্ঘের দৃষ্টিতে ঈশ্বরসেবারই রূপান্তর।

• হিন্দু দর্শন এবং মতবাদের পুনর্নবীকরণ: হিন্দুধর্ম এবং দর্শনের আধুনিক ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি বিবেকানন্দ তাঁর নিজস্ব উপলব্ধিগুলিও তার সঙ্গে যোগ করেছেন, হিন্দুধর্মকে তিনি এক নতুন জীবন দিয়েছেন। তবে এর যথাযথ মূল্যায়নের জন্য ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের বিশদ আলোচনার প্রয়োজন, যার জন্য এই স্থান নিতান্ত অপরিসর।