শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস
শ্রীরামকৃষ্ণ : ১৮৩৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে ৯৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কামারপুকুর গ্রামে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম হয়। বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ও মা চন্দ্রমণি দেবী তাঁদের ভক্তিনিষ্ঠা ও সত্যপরায়ণতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। যদিও আর্থিক সচ্ছলতা তাঁদের ছিল না। শ্রীহরির আশীর্বাদে জন্ম বলে তাঁরা এই শিশুটির নাম রাখেন গদাধর। গ্রামের সবার প্রিয় ছিল গদাধর। আর পাঁচজন ছেলের সঙ্গে তাঁর তফাৎও ছিল নজরে পড়ার মতো। সাংসারিক কাজকর্ম বা রোজগেরে লেখাপড়ায় তাঁর মন ছিল না। বাকি ছেলেদের মতো গতানুগতিক লেখাপড়া না করে সে নিজের মতো করে বিদ্যার্জন করত। গদাধর খুব সুন্দর গাইতে পারত, ছবি আঁকা আর মূর্তি গড়াতেও সে পটু ছিল। এসব ছাড়া গদাধরের প্রিয় কাজ ছিল সাধুসঙ্গ করা। গ্রামে যখনই কোনো সাধু-সন্ত আসতেন, গদাধর তাঁদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলত, গল্প করত। গদাধর প্রায়ই আপন ভাবে বিভোর হয়ে যেত। এই ভাব যে ঐশ্বরিক চেতনারই লক্ষণ, সে কথা তখনও মানুষের কাছে ধরা পড়েনি। গদাইয়ের যখন দশ বছর বয়স, তখন একদিন কালো মেঘের বুকে সাদা বকের পাঁতি উড়ে যেতে দেখে তার আকস্মিক ভাবসমাধি হয়। এর পরে আরো বহুবার সমাধির অভিজ্ঞতা তার জীবনে আসবে। সাত বছর বয়সে গদাধর তার বাবাকে হারায়; এর পর থেকে তার সংসারবিমুখতা আরও বেড়ে যায়।
দক্ষিণেশ্বরে : গদাধরের যখন বয়স ষোলো, তখন দাদা রামকুমারের সঙ্গে সে কলকাতা চলে আসে; বাবা মারা যাবার পর থেকে সংসারে যে আর্থিক টানাটানি চলছিল, তার সুরাহার চেষ্টাতেই বড় শহরে আসার এই সিদ্ধান্ত। এক ঐতিহাসিক সমাপতনে ঠিক এই সময়েই রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে একটি কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু নানা সমস্যায় বাধা পেয়ে তা হয়ে উঠছিল না। রামকুমার এসে সেই সমস্যার সমাধান করলেন, এবং ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হল। রামকুমার হলেন মন্দিরের প্রধান পূজারী। কিন্তু কালের বিধানে রামকুমার কিছুদিনের মধ্যেই দেহ রাখলেন। প্রধান পূজারীর ভূমিকা পেলেন গদাধর। তার গদাধর থেকে রামকৃষ্ণ হয়ে ওঠার এই শুরু। কিছুদিনের মধ্যেই লোকে টের পেল, নতুন পূজারীটি বড়ই অদ্ভুত। সাধারণভাবে যেরকম পূজা-অর্চনা হয়ে থাকে, এর কাজ সেরকম মোটেই নয়। এই পূজারী মন্দিরের কালীমূর্তিকে ‘মা’ বলে ডাকে, এবং তার সঙ্গে ব্যবহারটিও এমন করে যেন মা কালী সত্যিই তার ঘরের মা – সে দেবীপ্রতিমার সঙ্গে কথা বলে, এমনকি প্রতিমার মুখে খাবারও তুলে দেয়। লোকে মনে করতে শুরু করল, নতুন পূজারীর মাথার ঠিক নেই। তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে রামকৃষ্ণ সত্যিই প্রতিমার মধ্যে চিন্ময়ী মা কালীকে খোঁজেন, তাঁকে ডাকাডাকি করেন। শেষে একদিন সত্যিই রামকৃষ্ণের ইচ্ছে পূর্ণ হল, তিনি মা কালীর সাক্ষাৎ দর্শন পেলেন। এক নতুন আধ্যাত্মিকতা : কামারপুকুরের পরিবার-পরিজনদের মধ্যে কেউই শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যোন্মাদ অবস্থার প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। তাঁরা ভাবলেন, গদাধরের মাথার গোলমাল হয়েছে, তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এই ভেবে তার গদাধরের বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। বিয়ে হল জয়রামবাটীর রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে সারদামণির সঙ্গে। কিন্তু আত্মীয়রা যা ভেবে বিয়ে দিলেন, ফল হল তার বিপরীত। সারদা নিজেই রামকৃষ্ণের সুযোগ্য সাধনসঙ্গিনী হয়ে উঠলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এবার কঠিন থেকে কঠিনতর সাধনায় নিজেকে নিয়োগ করলেন। একে একে তিনি হিন্দুধর্মের মূল শাখাগুলিকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। তন্ত্রের পথে তাঁর গুরু হলেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী – এই অসাধারণ ক্ষমতাশালী সাধিকা ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে আসেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে রামকৃষ্ণ তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করলেন অচিরেই। এর তিন বছর পরে বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী তোতাপুরী দক্ষিণেশ্বরে এলে রামকৃষ্ণ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অদ্বৈতবাদে দীক্ষা নিলেন। এই সময়েই তাঁর নির্বিকল্প সমাধি লাভ হয়। সমাধির পরে প্রায় ছয় মাস শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈতবোধের ভাবে ছিলেন, নিজের স্বতন্ত্র শরীরের বোধও তাঁর ছিল না। এই উদাহরণগুলি ছাড়াও আরো নানারকম আধ্যাত্মিক পরীক্ষানিরীক্ষা ও অনুসন্ধানে দক্ষিণেশ্বরের এই দিনগুলি ভরে থাকত। এক কথায় বলতে গেলে হিন্দুধর্মের তিন হাজার বছরের আধ্যাত্মিক অনুশীলনকে শ্রীরামকৃষ্ণ এক জীবনে ঘনীভূত করলেন।
যত মত, তত পথ : শ্রীরামকৃষ্ণ যে সময়ের মানুষ, তা ভারতের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বর্ণময় অধ্যায়। ভারতে, বিশেষ করে বাংলার বুকে তখন যা ঘটছিল তাকে অনেকে নাম দিয়েছেন ‘বাংলার রেনেসাঁস’, কারণ সমাজজীবন, সাহিত্য, জ্ঞানচর্চা, শিল্প – সবদিকেই তখন নবজাগরণের আলোড়ন উঠেছে, আর সেই আলোড়নের ঢেউ লাগছে সারা ভারতে। শ্রীরামকৃষ্ণ এই নবজাগরণের একজন প্রধানতম নায়ক – আধ্যাত্মিকতার জগতে তিনি বিপ্লব এনে দিলেন। হিন্দুধর্মকে আত্মস্থ করা যখন সম্পূর্ণ হল, রামকৃষ্ণ তখন অন্য ধর্মগুলির দিকে মন দিলেন। একে একে ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম ও শিখধর্মের পথে তিনি এগোলেন, ও প্রতিটিতেই সফলকাম হলেন। যীশু খ্রীষ্ট ও হজরত মহম্মদের দর্শনও তিনি পেয়েছিলেন। এতদূর এসে তিনি পরিষ্কার বুঝলেন যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মগুলি আসলে একই লক্ষ্যে পৌঁছনোর আলাদা আলাদা রাস্তা মাত্র। তিনি বললেন, “যত মত, তত পথ।”
সারদাদেবীর সঙ্গে : ইতিমধ্যে জয়রামবাটীতে সারদাদেবীর কানে পৌঁছেছে তাঁর স্বামীর তথাকথিত মস্তিষ্কবিকৃতির খবর। খবর পেয়ে তিনি স্থির করলেন যে এরকম সময়ে রামকৃষ্ণের কাছে গিয়ে থাকাই তাঁর কর্তব্য। প্রায় ৯৭ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে সারদাদেবী এসে পৌঁছলেন কলকাতায়। শ্রীরামকৃষ্ণের ‘পাগলামি’র গুজবে অবশ্য সারদাদেবী ভুললেন না। তিনি বুঝেছিলেন যে এ তাঁর স্বামীর এক বিশেষ দিব্য অবস্থা। শ্রীরামকৃষ্ণ পরম প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে অভ্যর্থনা জানালেন, এবং নিজের আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গী করে নিলেন সারদাকে। সারদাদেবী সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি সাধ্বীর জীবন যাপন করতে লাগলেন, জপ-ধ্যানে নিজেকে নিমগ্ন রেখে শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠলেন সহজেই। শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাকে তাঁর সহকারী বা শিষ্যা হিসেবে দেখতেন না, তিনি সারদার মধ্যে সাক্ষাৎ মহাশক্তিকে দেখতে পেতেন। মন্দিরের মা কালীই রক্ত-মাংসের মানুষীর রূপ ধরে স্ত্রী হয়ে আছেন, – শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাব ছিল। ১৮৭২ সালে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল। ফলহারিণী কালীপূজার রাতে, শ্রীরামকৃষ্ণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূজাপদ্ধতি অনুসরণ করে ষোড়শোপচারে সারদামণির পূজা করলেন। সারদার মধ্যে যে বিশ্বমাতৃত্বের ভাব সুপ্ত হয়ে ছিল, তার ঘুম ভাঙল।
গুণীজনসমীপে : কলকাতার সুশীলসমাজে শ্রীরামকৃষ্ণের নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এক সভায় ধর্মীয় পণ্ডিতেরা রামকৃষ্ণকে অবতার বলে ঘোষণা করলেন। তখনকার কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের খুব জনপ্রিয়তা, ফলে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ব্রাহ্ম নেতাদের সাক্ষাৎ অবশ্যম্ভাবী ছিল। কেশবচন্দ্র সেন তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর তাঁর অনুরাগী ভক্ত হয়ে উঠলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অবতার হলেও তিনি আধুনিক যুগের অবতার, সুতরাং তাঁর আলাপ-আলোচনা ও চেনা-পরিচিতির ক্ষেত্রও কেবলমাত্র ধর্মজগতের পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষাব্রতী, সাহিত্যসেবী, সমাজসংস্কারক, তরুণ ছাত্র সবরকম মানুষই তাঁর কাছে আসত, তাঁর কথা শুনত। এই দিনগুলির প্রাণবন্ত লেখ্য মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত” বইয়ে রক্ষিত আছে।
ভক্তদের সঙ্গে : ফুল ফুটলে ভ্রমর এসে জুটবেই। শ্রীরামকৃষ্ণের পরিচিতি কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের আসা আরম্ভ হল। এই ভক্তদের মধ্যে যেমন শান্তি ও জীবনে দিশা পেতে চাওয়া গৃহীরা ছিলেন, তেমন ছিল আদর্শবাদী তরুণ ছাত্রেরা, যারা জ্ঞান ও সত্যের অণ্বেষী। এই দ্বিতীয় দলটিই ভবিষ্যতের রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের মূল। এই দলেরই একজন ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যে পরে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে পৃথিবীর সামনে আত্মপ্রকাশ করবে।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত : শ্রীরামকৃষ্ণ কোনো বই লেখেননি, কখনো কোন জনসভায় বক্তৃতাও দেননি। নিজের কথা সংরক্ষিত করে রাখার জন্য কোনোরকম চেষ্টাই তিনি করেননি, সেরকম মানসিকতা তাঁর ছিল না। দক্ষিণেশ্বরে তাঁর ঘরে প্রতিদিন যে অনুরাগী ভক্তেরা আসত, তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। এই সংলাপগুলিরই সংরক্ষিত রূপ আমরা পাই শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখা “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত” বইটিতে। মহেন্দ্রনাথ নিয়মিত শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ভক্তদের কথোপকথনের নোট নিতেন, তা থেকেই তিনি পরে বইটি প্রস্তুত করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কথাগুলি – এবং তাঁর উপমা ও অননুকরণীয় ভঙ্গী – শুধুমাত্র ধর্মের দিক থেকেই নয়, সাহিত্য ও সমাজ-ইতিহাসের দিক থেকেও প্রভূত সমাদর পেয়েছে। ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে “The Gospel of Sri Ramakrishna” নামে এর একটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
শেষের দিনগুলি : কঠোর সাধনা ও ভক্তদের সঙ্গে অবিরাম সাক্ষাতের ধকলের দরুণ ধীরে ধীরে শ্রীরামকৃষ্ণের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করল। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর গলায় ক্যানসার ধরা পড়ল। ভক্তেরা দক্ষিণেশ্বর থেকে তাঁকে নিয়ে গেলেন এক প্রশস্ত ও খোলামেলা বাগানবাড়িতে, স্বাস্থ্যের উন্নতির আশায়। এখানেও শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ভক্তদের দেখা হওয়ার বিরাম রইল না। ভক্তেরা আপ্রাণ সেবায় তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু ক্যানসার দুরারোগ্য। শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ অবস্থাতেই তাঁর এই তরুণ ভক্তগুলির মধ্যে অবিরাম ভ্রাতৃত্ববোধ চারিয়ে দিতে লাগলেন, কারণ তাঁর তিরোধানের পরে তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এরাই। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই অগাস্ট, ভোরবেলা, শ্রীরামকৃষ্ণ দেহত্যাগ করলেন। শেষ মুহূর্তে তিনি কালীর নাম উচ্চারণ করতে লাগলেন, তার মধ্যেই তাঁর প্রাণ শরীর ছেড়ে অসীমের সঙ্গে মিশে গেল। রয়ে গেল এক অনন্য জীবনের স্মৃতি, এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের নবাঙ্কুর।
শ্রীরামকৃষ্ণের বার্তা : শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী ও বাণী অনুধাবন করলে আমরা তাঁর যে মূল বার্তাগুলি পাই, তা হল: ঈশ্বরলাভই মানুষ-জীবনের উদ্দেশ্য। এ ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে চিরন্তন তৃপ্তি বা শান্তি পাওয়া যায় না। পরম সত্য এক ও অপরিবর্তনশীল; কিন্তু এই পরমের কাছে আলাদা আলাদা বহু পথ ধরে যাওয়া যায়। বিভিন্ন ধর্মে এই এক পরমকেই আলাদা আলাদা ভাবে ঈশ্বর, জিহোবা, গড, আল্লা, ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। পরমার্থ লাভের নানা পথ আছে। পৃথিবীতে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বৈচিত্র্যের কারণে নানা ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে, তারা বিভিন্ন পথে পরমার্থ লাভের কথা বলেছে। তাদের কোনোটাই ভুল নয়, কারণ সবারই মূল লক্ষ্য একই। বহিরঙ্গের আচার-বিচার ধর্মের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। অন্তরের পবিত্রতাই আসল। কাম ক্রোধ ইত্যাদি বদগুণের থেকে মুক্ত থাকলে এই পবিত্রতা আমাদের মধ্যে ফুটে ওঠে, এবং এই দিয়েই পরমার্থ লাভ হয়। সকলেই প্রকৃতপক্ষে পবিত্র ও সৎ, কিন্তু ঐহিক বিভ্রমের কারণে আমরা নিজেদের মধ্যে হীনতা ও দীনতা দেখতে পাই। আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে এই বিভ্রম ধীরে ধীরে কেটে যায়, ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মবোধ ফিরে আসে। জগতে কারোরই নিরাশ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, ভগবান সবেতেই আছেন। ঈশ্বরকে পাবার জন্য ঘরদোর ছেড়ে পাহাড়ে বা বনে যাওয়ার দরকার নেই। ঐকান্তিক ইচ্ছা ও ব্যাকুল প্রার্থনা, এবং সেইসাথে অবিচল সত্যনিষ্ঠা – এই দিয়ে, গৃহী বা সন্ন্যাসী, যে কেউ ভগবানকে পেতে পারে। ঈশ্বর সবখানে এবং সবার মধ্যেই আছেন, কিন্তু সবার মধ্যে তাঁর প্রকাশ সমান নয়। সাধুপ্রকৃতির মানুষের মধ্যে এই প্রকাশ স্পষ্টতর। নারীরা ঈশ্বরের মাতৃসত্ত্বার প্রকাশ, এবং সব নারীই মায়ের মতো শ্রদ্ধার্হ। জীবে দয়া করার ধারণা একধরনের মতিভ্রম, কেননা জীবমাত্রেই ঈশ্বর, সে দয়ার পাত্র নয়। বরং, আর্তজনের প্রতি সেবার ভাব নিয়ে তাদের জন্য যথাসাধ্য কাজ করাই শ্রেয়। এতে শিবজ্ঞানে জীবসেবা হয়। অজ্ঞানতা, এবং তা থেকে জন্মানো স্বার্থবুদ্ধিই সব যন্ত্রণার মূল। এই জীবন পরমব্রহ্মেরই সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ। সুখ, দুঃখ, সাফল্য, ব্যর্থতা সমস্তকিছুই ঈশ্বরের প্রকাশ ধরে নিয়ে ধৈর্য্যের সঙ্গে জীবনে এগিয়ে যেতে হবে, এবং সব কাজের ফল ঈশ্বরে অর্পণ করতে হবে।
বিশ্বসংস্কৃতিতে শ্রীরামকৃষ্ণের অবদান
আধ্যাত্মিক আদর্শ: শ্রীরামকৃষ্ণ আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মকে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছেন। অধিকাংশ সময়েই ধর্ম আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে এতটা দূরের হয়ে দাঁড়ায় যে হয় মানুষ তা থেকে বিমুখ হয়, নয়তো ধার্মিক হতে গিয়ে সংসারের প্রতি তার অসীম বিরাগ উপস্থিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ আধুনিক জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলির সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। ধর্ম যা মানুষকে জীবনবিমুখ না করে তাকে জীবনসমুদ্রের দক্ষ নাবিক করে তুলতে পারে, সেই বিষয়ে তিনি যত্নবান হয়ে এমনভাবে আধ্যাত্মিকতাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, যে একবিংশ শতাব্দীতেও তাঁর শিক্ষা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
ধর্মের জগতে সম্প্রীতি: মানুষকে প্রেম ও উদারতা শেখানোর জন্য যে ধর্মের উৎপত্তি, মানুষ সেই ধর্মের অজুহাতেই যুগে যুগে পরস্পরের সঙ্গে হানাহানি করেছে – এ এক বিচিত্র পরিহাস। আধুনিক যুগে এই সমস্যা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বায়িত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই বিরল মানুষ যিনি স্পষ্ট ভাষায় ধর্মে-ধর্মে বিভেদকে অস্বীকার করেছেন এবং সব ধর্মকে সমান সম্মানের আসনে বসিয়ে সেগুলিকে সমাদর করে গ্রহণ করেছেন। এই সম্প্রীতির বার্তা স্বামী বিবেকানন্দের চেষ্টায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ আধুনিকমনস্ক মানুষই এই ভাব অবলম্বন করেন। মানুষ মনে করে যে তার একার মতই সঠিক, অন্য যেকোনো মত কোনো না কোনো দুর্বলতায় দুষ্ট। এই ধারণার জন্য অনেকসময়েই মানুষ অপরের শুভকামনা করতে গিয়ে তার ওপর নিজের মত জোর করে চাপিয়ে দেয়, এবং খানিকটা অজ্ঞাতসারেই অপরের অনিষ্ট করে বসে। এ ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে একধরনের কুশিক্ষার প্রভাবে আমরা সাম্প্রদায়িকতায় ভুগি, মনের ভেতরে ঘৃণা লালন করি, অন্য দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা ভাষার মানুষকে ভালোবাসতে ভুলে যাই, এবং এই সবটাই আমরা করি ধর্ম বা নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদেরকে বারে বারে মনে করিয়ে দেন – যত মত, তত পথ। তিনি বলেন, যে যার ভাবে থাকে, থাকুক। চূড়ান্ত বিচারে ভারতবর্ষ যে প্রেমের পুণ্যভূমি, তার দুয়ার যে সকলের জন্য খোলা। এর জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে এই ভারতীয় যুগপুরুষ পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল। প্রাচীন ও নবীনের মধ্যে সেতুবন্ধন: শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন প্রাচীন রীতি ও নবীন ভাবনার এক অভিনব সঙ্গম। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, শ্রীরামকৃষ্ণ বনের বেদান্তকে ঘরে এনেছিলেন।
নীতিবোধের পুনরুজ্জীবন: শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার বলতেন, সততা ও পবিত্রতার বিকল্প নেই। তথাগত বুদ্ধের মতো তিনিও ধর্মকে বহিরঙ্গের জাঁকজমক, সঙ্কীর্ণ আচার-বিচার ও নানা অস্বাস্থ্যকর অনুষঙ্গ থেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে আধ্যাত্মিকতার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।
ঐশ্বরিক প্রেম: প্রেমকে শ্রীরামকৃষ্ণ জাগতিক আবেগের স্তর থেকে আধ্যাত্মিক প্রেরণার স্তরে উন্নীত করেছিলেন। উপনিষদে যে জ্ঞান বহুকাল ধরে সঞ্চিত ছিল, তাকেই শ্রীরামকৃষ্ণ হৃদয়ের উত্তাপে সঞ্জীবিত করে মানুষের কাছে পরিবেশন করলেন, যাতে আধুনিক যুগের কর্মব্যস্ত, লঘুবুদ্ধি জীবনেও সেই পারমার্থিক জ্ঞান প্রাসঙ্গিকতা পায়। রামকৃষ্ণ-ভাবধারায় সরলতা ও প্রেমই সবচেয়ে বড় কথা – যার জোরে মন্দিরের প্রতিমা থেকে শুরু করে দীনতম প্রাণী পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যেই ‘ব্রহ্ম’ দেখা দেন, এবং আমরা নিজেকে ও ঈশ্বরকে পরস্পরের মধ্যে আবিষ্কার করি। মানবিক আধ্যাত্মিকতা ও ঐশ্বরিক মানবিকতা – এই সর্বজনীন সম্পদের অধিকার শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের দিয়ে গেছেন।