সাল ১৭৫৭। পলাশীর যুদ্ধ শেষ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের কাছে পরাজিত। শুরু হয়েছে ইংরেজ শাসন, আর সেই সূত্রেই আমাদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে একটা নতুন দুনিয়া। কত নতুন নতুন চিন্তা, দর্শন, তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি-প্রযুক্তি! তা ঘিরে কত জিজ্ঞাসা, কত কৌতূহল! পশ্চিম দুনিয়ার এই জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের ধাক্কায় আমরা হয়তো তখন কিছুটা বেসামালও। তবু এরই ভিতর দিয়ে আমরা সন্ধান করছি জীবনের নতুন নতুন দিক, নতুন নতুন অর্থ। গড়ে তুলতে চাইছি বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। আর তখন এই নিয়ে প্রবল উৎসাহ উত্তেজনার ভিতরেই কে যেন গেয়ে বলল : ‘তোর দেলকা ভিতর, দেলকা ভিতর।’ মানে—বাইরে যাকিছু খুঁজছ সবই তোমার দেল বা অন্তরের ভিতর আছে। সুরটা হয়তো একেবারে নতুন নয়, তবু বোঝা গেল এটা একটা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অনুসন্ধান। রেল, টেলিগ্রাফ, গ্যাসের বাতি, এটা ওটা নয়—পুরোপুরি নিজেকে আবিষ্কার, নিজের ভিতরে যা আছে তার আবিষ্কার।

এই সুরটাই ঐ পলাশীর যুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে রামপ্রসাদের গানে বারবার আসছিল—

“কাল মেঘ উদয় হল অন্তর অম্বরে।
নৃত্যতি মানস শিখী কৌতুকে বিহরে।।”
“হৃৎকমলে ভাব বসে, চতুর্ভুজা মুক্তকেশী।
রামপ্রসাদ এই ঘরে বসি, পাবে কাশী দিবানিশি।।”
“মা আমার অন্তরে আছ।।
তোমায় কে বলে অন্তরে শ্যামা।।
(মা আমার অন্তরে আছ।।)”
“প্রসাদ বলে আমার হৃদয়, অমল কমল সাঁচ।
তুমি সেই সাঁচে নির্ম্মিতা হয়ে, মনোময়ী হয়ে নাচ।।”
“ধাতু পাষাণ মাটির মূর্তি, কাজ কি রে তোর সে গঠনে।
তুমি মনোময় প্রতিমা করি, বসাও হৃদি পদ্মাসনে।।”
“আপন মন মগ্ন হলে মা, পরের কথায় কি হয় তারে।
পরের কথায় গাছে চড়ে, আপন দোষে পড়ে মরে।।”
“ডুব দেরে মন কালী বলে; হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে।”

টুকরো টুকরো এই গানগুলোর কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু একটাই—অন্তরের সাধনা, অন্তরের খোঁজ। রামপ্রসাদেরও আগে সরহের চর্যাগানে—

“হাথেরে কাঙ্কন মা লেউ দাপন।
আপনে অপা বুঝ তু নিঅমন।।”
যা আধুনিক বাংলায়—
“হাতের কাঁকন ওগো দেখো না দর্পণে।
আপনারে দেখো তুমি আপনার মনে।।”
কিংবা বিদ্যাপতির পদকীর্তনে ভাবোল্লসিত রাধার—
“কি কহব রে সখি আনন্দ-ওর।
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।”

সেসব ছত্রেও হয়তো হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা সম্পদের খোঁজ ছিল। কিন্তু রামপ্রসাদ আমাদের সামনে সেই সম্পদের উন্মোচন করলেন। নিজের ভিতরে অনুসন্ধান করে জগতের ঐশ্বর্য আবিষ্কার—রামপ্রসাদের মূল কথা। সেই অনুসন্ধিৎসা তিনি সঞ্চার করে দিলেন আমাদের জাতীয় জীবনে। শুধু শাক্ত গানে নয়, বাউল আঙ্গিকের ব্রহ্মসংগীতে এমনকী রবীন্দ্রনাথের গানেও চলতে লাগল একই খোঁজ। আর এখানে যখন ইংরেজ সভ্যতার আবহাওয়ায় এই আত্মানুসন্ধানের পথ তৈরি হচ্ছিল, বিষয়টা তখন আরেকভাবেও ভাবতে পারি। পাশ্চাত্য সভ্যতার অভিঘাতে আমাদের যে নতুন করে জ্ঞানান্বেষণের স্পৃহা জেগেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই অন্বেষণের অভিমুখ ছিল প্রধানত বাইরের দিকে—‘দেশ দেশান্তে যাওরে আনতে নব নব জ্ঞান’।বাইরের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝতে চাওয়াই হয়তো এর ল‌ক্ষ্য। জ্ঞানার্জনের এই ধরনটারই কি একটা পালটা বয়ান বা ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ হয়ে উঠল ঐ আত্মানুসন্ধান? জ্ঞানার্জনের ল‌ক্ষ্যে দেশ-দেশান্তরে না ছুটে অামরা এসে দাঁড়ালাম নিজ নিকেতনের সামনে—যেখানে এমনিই পৌঁছে যায় বিশ্বলোকের সাড়া।

এখানে রামপ্রসাদের গানের সঙ্গে প্রায় একই টানে বাউল ব্রহ্মসংগীতের কথা বলা হলো বলে আরো কয়েকটা কথা যোগ করা যাক। ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এই যোগাযোগ ল‌ক্ষ্য করেছিলেন। বহু বছর আগে রামপ্রসাদের সঙ্গে রামমোহনের সাদৃশ্যগুলি নজরে এসেছিল দীনেশচন্দ্র সেনের একটি কথা থেকে—“রামপ্রসাদের কণ্ঠে যে গানের অবসান হইয়াছিল, তাহা পুনরায় রামমোহনের কণ্ঠে উত্থিত হইয়া নব্য সমাজকে মাতাইয়া তুলিল।” রামমোহন রামপ্রসাদের ‘তারা আমার নিরাকারা’ থেকে শুরু করেছিলেন শুধু নয়, রামপ্রসাদের শাক্ত গানের অনেক কথা, অনেক ধরন-ধারণই এসেছে রামমোহনের এবং পরবর্তিকালের ব্রহ্মসংগীতে। শাক্ত, বাউল ও ব্রহ্ম সংগীত—তিনটি আলাদা সাধনার ধারা, আলাদা চর্চার ধারা; কিন্তু কাছাকাছি সময়ের এই তিনটি ধারার মধ্যে গভীরে মেলামেশা রয়েছে। ভাষা, শব্দ, চিত্রকল্প, সুর সব মিলিয়ে যে-প্রকাশরীতি—সেদিক থেকে যেমন, তত্ত্বের দিক থেকেও সেই মেলামেশার অসংখ্য চিহ্ন রয়েছে গানের শরীরে। দৃষ্টান্ত দিয়ে তা বোঝানোও যায়। কিন্তু তাছাড়াও কথা আছে। শাক্তদের তন্ত্রসাধনার সঙ্গে বাউলদের সাধনার যোগের কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি। কিন্তু ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা রামমোহন যে তন্ত্রের অনুগামী ছিলেন এবং তাঁর গুরু স্বামী হরিহরানন্দ যে প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন—কথাটা বোধহয় তেমন মনে রাখি না। স্বামী হরিহরানন্দ ব্রাহ্মসমাজে মহানির্বাণতন্ত্র চর্চার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। ব্রহ্মসংগীতে মহানির্বাণতন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। বলা হয়, তন্ত্র বাউলসাধনারও একটা ভিত্তি। শাক্ত সাধকদের কেউ কেউ যেমন বাউলসংগীত রচনা করেছেন, তেমনি ব্রহ্মসংগীত রচয়িতাদের অনেকেই বাউল ভাবের গান বেঁধেছেন। আন্দুল কালীকীর্তন দলের প্রতিষ্ঠাতা শক্তিসাধক প্রেমিক মহারাজের গানের বইটির নামই আন্দুল কালীকীর্ত্তন ও বাউল গীতাবলী। শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তি-সাধনার সঙ্গে বাউল, ব্রহ্ম সংগীত মিলিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে যেমন বাউলদের তেমনি ব্রাহ্মসমাজেরও ঘনিষ্ঠতা ছিল। নিজেই বলেেছন—একসময়ে তাঁর কাছ থেকে ব্রাহ্ম ভক্তরা মায়ের নাম নিয়ে এসেছিলেন। এইভাবে শাক্ত, বাউল ও ব্রহ্মসংগীতের ভিতর আদান-প্রদানের পথ ধরে আত্মবী‌ক্ষণের যে-সাধনা এগিয়ে চলেছিল, সেটিই রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রসারিত। বাউল ও ব্রহ্ম সংগীত রবীন্দ্রনাথের চর্চার বহিরঙ্গেই রয়েছে। আর অন্তরঙ্গে রয়েছে শাক্তদর্শনের সুগভীর প্রভাব। দেখতে গেলে, এই তিনটি গানের ধারা যেন কখনো কখনো এক হয়ে আসে। কারণ, তিন ধরনের গানে খোঁজ তো একটাই—নিজের ভিতরকার খোঁজ। সেইসঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের মন, হৃদয়, ‘আমি’। এটাই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে জ্ঞানচর্চার একটা পালটা বয়ান, যার নির্মাণ শুরু হয়েছে রামপ্রসাদের হাতে।

দুই

রামপ্রসাদের হাতে এই বয়ান যেভাবে তৈরি হচ্ছিল, তাতে দুটি বিষয় একটু আলাদা করে দেখতে চাই। ‘হৃৎকমল’—এই শব্দবন্ধটি বা এই চিত্রটি এবং মনকে সম্বোধন করে বা মনের সঙ্গে কথা বলা দিয়ে গান রচনার রীতিটি। রামপ্রসাদের আগে বাংলা সাহিত্যে এই দুইয়ের কোনো ব্যবহার আছে বলে মনে হয় না। নিজের অন্তরে প্রবেশ করতে আমরা পরে বারবার এই দুই মুদ্রা ব্যবহার করেছি। হৃৎকমল ভাবলেই মনে হয়, আমাদের ভিতর কারো জন্য যেন একটা আসন পাতা। কিন্তু সে-আসন কার জন্য, তিনি কে? তন্ত্রে মানুষের শরীরের ছয়টি স্থানে ছয়টি পদ্মের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পদ্ম হৃদয়ে। নাম—‘অনাহত’। এটিই কি হৃৎকমল? তবে শাক্ত গানে হৃৎকমল বা হৃদয়পদ্মের কথাই বারবার এসেছে। কারণ, তাতে হৃদয় আছে। হৃদয়-মনের দরজা দিয়েই তো আমরা উপলব্ধির জগতে প্রবেশ করি। আর উপলব্ধি ছাড়া ঐ হৃৎকমলের আসন কার জন্য পাতা জানব কী করে

এছাড়া মনকে সম্বোধন করে গান রচনার রীতিটি মানুষকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, রামপ্রসাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা গানের একটা আলাদা ধরনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু শাক্ত, বাউল বা ব্রহ্ম সংগীত নয়—নিধুবাবুর প্রেমের গানও একইভাবে লেখা হলো। কিন্তু রীতিটি এসেছিল কোথা থেকে বলা মুশকিল। অনুমান করা যায়—নানক, কবীর, সুরদাস প্রমুখ ভারতীয় সন্তদের ভক্তিসাহিত্য থেকে। রামপ্রসাদ ‘মন রে, কৃষি কাজ জান না’ গানে যে-মনের সঙ্গে কথা বলছেন, সেই মন-কৃষককে আমরা নানকের গানেও পাই—

“ইহু তনু ধর্‌তী বীজু কর্‌মা করো
সলিল আপাউ সারিঙ্গ্‌পানী।
মনু কির্‌সাণু হরি রিদে জঙ্‌মাই লৈ
ইউ পাওয়্‌সি পদু নিরবাণী।।”১০

বাংলায় সোজাসুজি মানে করলে দাঁড়ায়—এই তনু বা শরীর হলো জমি, কর্ম হলো বীজ। তা ঈশ্বরের নামপূত জলে সিঞ্চিত। আর মন হলো কৃষক এবং সব মিলিয়ে হৃদয়-বৃ‌ক্ষ ফলবতী হলে নির্বাণলাভ হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে মনের সঙ্গে কথা বলাটা এত জরুরি হয়ে উঠেছিল কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তকে হয়তো অনেকের মনে আছে। কমলাকান্ত একদিন নজর করলেন—তাঁর মন হারিয়ে গিয়েছে। মনের সন্ধানে পাকশালায় প্রসন্ন গোয়ালিনির কাছে, এমনকী প্রসন্নর মঙ্গলা গাইয়ের কাছেও তিনি গেলেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না। তারপর কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বেরিয়ে এক সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে দেখা। কিন্তু তাতেও তাঁর মন নেই। শারীরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, রহস্যালাপ—কোনো কিছুতেই নেই। যে কতকগুলি ছেঁড়া পুঁথিতে তাঁর মন থাকত, সেখানেও খুঁজে পেলেন না। অবশেষে আবিষ্কার করলেন—তাঁর মন কোথাও বাঁধা পড়েনি বলেই হারিয়ে গিয়েছে। এবং এই মন হারিয়ে যাওয়ার জন্য কমলাকান্ত যে-বিষয়টিকে তুলে ধরলেন সেটি প্রণিধানযোগ্য—“ইংরেজি শাসন, ইংরেজি সভ্যতা ও ইংরেজি শি‌ক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ‘মেটিরিয়েল্‌ প্রস্পেরিটি’র উপর অনুরাগ আসিয়া দেশ উৎসন্ন দিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইংরেজ জাতি বাহ্য সম্পদ্‌ বড় ভালবাসেন—ইংরেজি সভ্যতার এইটি প্রধান চিহ্ন—তাঁহারা আসিয়া এদেশের বাহ্য সম্পদ্ সাধনেই নিযুক্ত—আমরা তাহাই ভালবাসিয়া আর সকল বিস্মৃত হইয়াছি। ভারতবর্ষের অন্যান্য দেবমূর্তিসকল মন্দিরচ্যুত হইয়াছে—সিন্ধু হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত কেবল বাহ্য সম্পদের পূজা আরম্ভ হইয়াছে। দেখ, কত বাণিজ্য বাড়িতেছে—দেখ, কেমন রেলওয়েতে হিন্দু-ভূমি জাল-নিবদ্ধ হইয়া উঠিল—দেখিতেছ, টেলিগ্রাফ কেমন বস্তু! দেখিতেছি, কিন্তু কমলাকান্তের জিজ্ঞাসা এই যে, তোমার রেলওয়ে টেলিগ্রাফে আমার কতটুকু মনের সুখ বাড়িবে? আমার এই হারান মন খুঁজিয়া আনিয়া দিতে পারিবে?…

“কি ইংরেজি, কি বাঙ্গালা, যে সম্বাদ-পত্র, সাময়িক পত্র, স্পীচ, ডিবেট, লেক্‌চর, যাহা কিছু পড়ি বা শুনি, তাহাতে এই বাহ্য সম্পদ্ ভিন্ন আর কোন বিষয়ের কোন কথা দেখিতে পাই না। হর হর বম্‌ বম্‌! বাহ্য সম্পদের পূজা কর। হর হর বম্‌ বম্‌! টাকার রাশির উপর টাকা ঢাল! টাকা ভক্তি, টাকা মুক্তি, টাকা নতি, টাকা গতি! টাকা ধর্ম, টাকা অর্থ, টাকা কাম, টাকা মো‌ক্ষ! ও পথে যাইও না, দেশের টাকা কমিবে, ও পথে যাও, দেশের টাকা বাড়িবে। বম্‌ বম্‌ হর হর! টাকা বাড়াও, টাকা বাড়াও, রেলওয়ে টেলিগ্রাফ অর্থ-প্রসূতি, ও মন্দিরে প্রণাম কর! যাতে টাকা বাড়ে, এমন কর; শূন্য হইতে টাকা বৃষ্টি হইতে থাকুক! টাকার ঝন্‌ঝনিতে ভারতবর্ষ পুরিয়া যাউক! মন! মন আবার কি? টাকা ছাড়া মন কি? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই; টাঁকশালে আমাদের মন ভাঙ্গে গড়ে। টাকাই বাহ্য সম্পদ্। হর হর বম্‌ বম্‌। বাহ্য সম্পদের পূজা কর।”১১

তাহলে, এই বাহ্য সম্পদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মনকে ফিরিয়ে আনতেই কি আমরা বারবার মনের সঙ্গে একটা সংলাপ তৈরির চেষ্টা করছিলাম? আর আত্মসন্ধানের প্রশ্নে তো মনের সামনে এসেই সর্বপ্রথম দাঁড়াতে হয়।

তিন

আত্মসন্ধানের বিষয়টাকে হয়তো এপর্যন্ত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকভাবেই বলা হলো, কিন্তু সন্ধান করে আমাদের ভিতরে আমরা কী অনুভব করছি? কাকে অনুভব করছি? আমাদের হৃৎকমলে কে? তিনি কি আমাদেরই কোনো বৃহৎ নিত্য সত্তা, যাঁর ভিতরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি? রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তর্যামীকে যেভাবে অনুভব করেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে অনেকটা এরকম চিন্তাই আছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন : “আমার একটি যুগ্মসত্তা আমি অনুভব করেছিলুম যেন যুগ্ম ন‌ক্ষত্রের মতো, সে আমারই ব্যক্তিত্বের অন্তর্গত, তারই আকর্ষণ প্রবল। তারই সংকল্প পূর্ণ হচ্ছে আমার মধ্য দিয়ে, আমার সুখে দুঃখে, আমার ভালোয় মন্দয়। এই সংকল্প-সাধনায় এক আমি যন্ত্র এবং দ্বিতীয় আমি যন্ত্রী হতে পারে…।”১২

এই চিন্তাই মিশে রয়েছে শাক্ত সাধকের গানে (‘সকলি তোমার ইচ্ছা’), ‘আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী’র সুরে। বাউল সাধকের ভাবটিও ঠিক তাই (‘গুরু, তুমি যন্ত্রের যন্ত্রী/ না বাজাও বাজবে কেনে’)।১৩ হৃৎকমলের এই যন্ত্রীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাঁর জীবনদেবতা। রামপ্রসাদ তাঁকে কখনো বলেছেন মা, কখনো ব্রহ্মময়ী, কখনো মুক্তকেশী, কখনো রজনীরূপিণী। আবার কখনো করুণাময়ী, মৃত্যুরূপা, এমনকী হয়তো সর্বনাশীও। বাউল সাধকেরা ডেকেছেন মনের মানুষ, অচিন মানুষ বা অধর মানুষ বলে। আর রবীন্দ্রনাথ তো সারা জীবন ধরে অসংখ্য নামে অসংখ্য সম্পর্কের দিক থেকে তাঁকে বেঁধেছেন। ধীরে ধীরে তিনি চলে এসেছেন শুধুই একান্ত নিবিড় একটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে। আর এখান থেকেই তৈরি হচ্ছে ‘পার্সোনাল গড’-এর ধারণা। ঘুরে যাচ্ছে বাংলা ভক্তিগানের ধারা। গত শতকের একেবারে গোড়ায়, পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ও রজনীকান্তের হাতে যে ভক্তিগান আমরা পেলাম তা শুনে কেউ যদি বলেন—এ কোন দেবতার গান, সত্যিই উত্তর দেওয়া কঠিন। অথবা বলতে হয়—জীবনদেবতার গান।

তবে অন্তরে যাঁর সঙ্গে মিলিত হচ্ছি, তাঁকে যে-সম্পর্কেই বাঁধি না কেন, তিনি কিন্তু আমার ভিতরে একা। জগতের মাঝে যিনি বিচিত্র, তিনিই অন্তরে একাকী। শুধু আমি আর তিনি—আমারই আরেক সত্তা। জগতের বহু আমার ভিতরে এক হয়ে রয়েছেন। বৈচিেত্রর মধ্যে, বহুর মধ্যে বিরোধ সম্ভব—একের মধ্যে বিরোধ থাকে না। অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতিতে যে-সমন্বয়ের বার্তা, তা আসলে আমাদের এই অন্তর-সাধনার উপলব্ধি।

এই সাধনারই আরেকটা কথা—একধরনের ব্যক্তিচেতনা অর্থাৎ ‘আমি’র বোধ। ইংরেজিতে ভাবলে ‘ইনডিভিজুয়ালিটি’র সাধনা। এমনকী আমার ভিতরে আমারই যে বড় সত্তা, সেই জীবনদেবতার ঝোঁকও ব্যক্তিগতর দিকেই। ইংরেজি শি‌ক্ষাও হয়তো আমাদের মধ্যে একভাবে ব্যক্তিচেতনাকে বড় করে তুলেছিল—যেটাকে উনিশ শতকীয় আধুনিকতার চিহ্নও বলা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে এই বোধের মৌলিক ভিন্নতা আছে। তাতে আছে মূলত আত্মাদর। আর এতে আত্ম থাকলেও ঠিক আত্মাদর নেই। রবীন্দ্রনাথ এই আমিত্বকে তাই ‘নিত্য অহং’ বলেছেন।১৪

অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে যখন এই সাধনার ধারা গড়ে উঠেছে, সেই সময়কে আমরা অনেকেই বলি নবজাগরণের কাল। কিন্তু আমাদের জীবনে সেই জাগরণ ঠিক কিসের? সেটা ছিল এই ‘নিত্য অহং’-এর জাগরণ। তুমি কার, কে তোমার বা ঘুরিয়ে বললে আমি কার, কে আমার—এই প্রশ্ন থেকেই সেই জাগরণ। আমরা যাঁকে নবজাগরণের পথিকৃৎ বলি, সেই রামমোহন এবং তাঁর বন্ধুবর্গের গানের কেন্দ্রে এটাই ছিল মূল প্রশ্ন। রামমোহন তাঁর গানে সেখান থেকেই এই জাগরণের কথা ধরেছেন—

“নিজ গ্রামে পরগৃহে চোর প্রবেশিলে মন।
লোকে শুনে তাহে কত মনে মনে ভীত হন।।
নবদ্বারী দেহপুরে, কালরূপী তদ্বারে,
নিত্য পরমায়ু হরে, নাহি তার অন্বেষণ।
মোহরাত্রি তম-ঘন, মায়া-নিদ্রায় প্রাণিগণ,
প্রহরী নাহিকো কোনো, কে করে বারণ।
শুনো মন অতঃপরে, জ্ঞান-অসি করে ধরে,
জানিয়া কৃতান্ত-চোরে করো নিবারণ।।”১৫

নিজের ভিতরে এই জেগে থাকা বা নিজেকে জাগিয়ে রাখাই আমাদের নবজাগরণের মূল চেতনা। এর সঙ্গেই রামমোহন জড়িয়ে নিচ্ছেন বাহ্যসম্পদের পূজা অর্থাৎ বিষয়মুখিতা থেকে সরে এসে নিজের ঘরে আত্ম-উপাসনার বীজ বপন করার কথা, বিবেক-বৈরাগ্যের কথা। বিবেক রামমোহনের গানে খুব বড়। আর বিবেকই তো সেই প্রহরী—আমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রহরী। তাই রামমোহন শুধু পথিকৃৎ নন, রামমোহনই আমাদের নবজাগরণের বিবেক।

চার

আমরা শেষে গোটা বিষয়টা নিয়ে একটা কথা ভাবতে চাই। আমাদের অন্তরের সাধনা এমন গানে গানে ভাষা পেল কেন? অন্যত্র যে পায়নি, তা নয়। কিন্তু গানে তা যত গভীর ও ব্যাপ্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে, বোধহয় আর কোথাও নয়। এটা ঠিক, গানে গানে এসেছে বলেই সেই সাধনার মূল কথাটা হয়তো সমাজের সর্বস্তরে, এমনকী নির‌ক্ষর মানুষের কাছেও পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কোনো কারণ আছে কি? অনুমান করা যায়—আছে। হৃদয়, মন, বিবেকের জগৎ মূলত বিমূর্ত জগৎ। আর সুরের থেকে বেশি বিমূর্ত কী আছে? তাই সুর যত সহজে আমাদের সেই জগতে নিয়ে যেতে পারে, অন্য কিছু হয়তো পারে না। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, ভারতীয় সুরের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের সুর যখন ঘুরে ঘুরে সা-এ ফেরে, সমে ফেরে—সে যেন নিজ নিকেতনে ফেরা। সেই সুর পাশ্চাত্যের হারমনির কলতান থেকে আলাদা। সেই সুর রাত্রির মতো নিঃসঙ্গ—একলা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : “য়ুরোপের সংগীত প্রকাণ্ড এবং প্রবল এবং বিচিত্র, মানুষের বিজয়রথের উপর থেকে বেজে উঠছে। ধ্বনিটা দিগ্‌দিগন্তের ব‌ক্ষস্থল কাঁপিয়ে তুলছে। বলে উঠতেই হয়—বাহবা! কিন্তু, আমাদের রাখালী বাঁশিতে যে রাগিণী বাজছে সে আমার একলার মনকে ডাক দেয় একলার দিকে সেই পথ দিয়ে যে পথে পড়েছে বাঁশবনের ছায়া, চলেছে জলভরা কলসী নিয়ে গ্রামের মেয়ে, ঘুঘু ডাকছে আমগাছের ডালে, আর দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাঝিদের সারিগান—মন উতলা করে দেয়, চোখটা ঝাপসা করে দেয় একটুখানি অকারণ চোখের জলে। অত্যন্ত সাদাসিধে, সেইজন্যে অত্যন্ত সহজ মনের আঙিনায় এসে আঁচল পেতে বসে।”১৬

এই যে ‘একলার মনকে ডাক দেয় একলার দিকে’—এটাই আমাদের অন্তরের সাধনার মূল সুর। সেই সুরেই বাঁধা হৃৎকমলের গান। তাই সেই গান নির্জন এককের গান।  

তথ্যসূত্র

১ সেনগুপ্ত, বাঁধন, রামপ্রসাদ ও তাঁর সমগ্র রচনাবলী, এন. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৪২১, পৃঃ ২৪৭, ২৪৫
২ ঐ, পৃঃ ৩০৫-৩০৬
৩ ঐ, পৃঃ ২৯৫
৪ ঐ, পৃঃ ২১৮
৫ সংগীত-সংগ্রহ, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ, বৈদ্যনাথ-দেওঘর, ২০০৯, পৃঃ ১৩২
৬ সরহ, ‘নাদ ন বিন্দু ন’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (সম্পাদিত), হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় উপস্থাপিত), মহাবোধি বুক এজেন্সী, কলকাতা, ১৪০৭, পৃঃ ১৫১ (বাংলায় অনুবাদ লেখক-কৃত)
৭ বন্দ্যোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র (সম্পাদিত), বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস ও অন্যান্য বৈষ্ণব মহাজন গীতিকার, দেব সাহিত্য কুটীর, কলিকাতা, পুনর্মুদ্রণ, পৃঃ ২৬৪
৮ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ‘চল্‌রে চল্‌ সবে ভারত-সন্তান’, যোগীন্দ্রনাথ সরকার (সংকলিত), বন্দে মাতরম্, সিটি বুক সোসাইটি, কলকাতা, ১৩৫৫, পৃঃ ৭৮
৯ সেন, দীনেশচন্দ্র, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স্, কলকাতা, ১৩৩৪, পৃঃ ৫১৭
১০ Chaudhuri, Dr. Sarbananda, ‘Guru Nanak in Bengali Anthologies of Music’, Journal of Regional History, Department of History, Guru Nanak Dev University, Amritsar, vol. XI-XII (New Series), 2005-2006, p. 5
১১ বঙ্কিম রচনাবলী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৯, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩০—৪০
১২ ‘চিত্রা’, রবীন্দ্র-রচনাবলী, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৩৯৩, ৪র্থ খণ্ড, সূচনা
১৩ শাহ্, লালন, ‘গুরু সু-ভাব দেও আমার মনে’, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বাংলার বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলকাতা, ১৩৬৪, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৬১
১৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০১, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ১৪৫
১৫ লাহিড়ি, দুর্গাদাস (সম্পাদিত), বাঙালির গান, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও সর্বানন্দ চৌধুরী (সহকারী সম্পাদক), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০১, পৃঃ ১৪৩-৪৪
১৬ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, সংগীতচিন্তা, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৪২৯, পৃঃ ১৯৪