স্বামী গঙ্গানন্দ ছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর মন্ত্রশিষ্য। ১৯০৪ সালে তিনি রামকৃষ্ণ সংঘে যোগদান করেন। ১৯২৬ সালে স্বামী শিবানন্দজী তাঁকে সন্ন্যাসদীক্ষা দেন। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক স্বামী ধ্যানানন্দ তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে স্বামী গঙ্গানন্দ তাঁকে যেসকল কথা বলেছিলেন, তা হুবহু তাঁর ডায়েরিতে লিখে রাখেন। তার থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ এখানে পরিবেশিত হলো, যা এখনো পর্যন্ত অপ্রকাশিত।
পুরীতে মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দজী) আমায় (স্বামী গঙ্গানন্দকে) বললেন : “কলিকালে সিদ্ধি হয় না কেন জানিস? ‘পরদানগ্রহণেন হস্তাঃ দগ্ধাঃ চক্ষুর্দগ্ধং পরস্ত্রীদর্শনেন।’”
মহাপুরুষ মহারাজ আমায় বলেছিলেন : “We the disciples of Sri Ramakrishna—one can die for another.” তাঁদের পরস্পরের মধ্যে এত ভালবাসা ছিল! তাঁরা একজন আরেকজনকে জানতেন।
শশী মহারাজ পুরীতে এলেন মহারাজকে নিতে। তিনি প্রণাম করলে মহারাজ বললেন : “শশী, আজ জগন্নাথের মঙ্গলারতি হয়েছে, দর্শন করতে যাবে না?” শশী মহারাজ বললেন : “মহারাজ, তোমাকে দেখছি; আর জগন্নাথ দর্শনে যেতে হবে? তবু তুমি যখন বলছ তখন যাব।” শশী মহারাজ, মহারাজকে কী দৃষ্টিতেই না দেখতেন!
সাধুদের সেবা করলে চিত্ত শীঘ্র শুদ্ধ হয়। মহাপুরুষ মহারাজ বলতেন—বিশ বছরের কর্মগুলো দু-মাসে হয়ে যায়।
শরীরে বল না থাকলে সাধন-ভজন হয় না। পরে যে
ন পশ্চাত্তাপ না করতে হয় যে, ধ্যান করতে পারিনি। কাজ করবে কিন্তু ধ্যান করা চাই-ই। এখন না করলে পরে আর হবে না।
রাজা মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম : “আপনি যা বললেন তাই করব, না, বিচার করে করব?” তিনি বললেন : “বিচার করে করবি।” মহারাজ একবার বলেছিলেন : “প্রথমে লোক গুরু হয়, তারপর মনই গুরু হয়।”
জিগির না থাকলে হয় না। গরমকালে রাত্রে আরতির কিছু পরেই ঘণ্টা পড়লে দুখানা রুটি রেখে দেবে। ধ্যান-জপ সেরে খেয়ে নেবে। এসব কথা কী আর বলে দিতে হয়! নিজে থেকেই মনে ওঠে। আসল কথা—ব্যাকুলতা নেই।
জীবনে সুখের ভাগ কম, দুঃখই বেশি। এক গুণ সুখ তো দশ গুণ দুঃখ। বিয়েতে যত সুখ হয়, স্ত্রী মরে গেলে তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ হয়। টাকা পেলে যত সুখ হয়, টাকা গেলে তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ হয়। কারণ এই যে, সুখের সময় মনটা অন্যান্য বিষয়েও ছড়িয়ে থাকে, কিন্তু দুঃখের সময় সমস্ত মনটা মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তাই শোক বেশি হয়। এইরকম দুঃখের সংসারে জন্ম-মৃত্যু বড় কষ্টের, সে-কারণে প্রার্থনা করতে হয় যাতে এই জন্মেই মুক্তি হয়। এজন্মেই মুক্ত না হলে কী গ্যারান্টি আছে যে, পরজন্মে মুক্ত হব? পরজন্মে যে মানুষ হব, তারই বা কী গ্যারান্টি? কোনো ভীষণ অপরাধের ফলে হয়তো পশু-পক্ষী হয়ে জন্মাতে হলো! হরি মহারাজ বলতেন : “যা মুক্তি পরজন্মানি সা শূকরী বিষ্ঠা।” “অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা ইচ্ছা তাই কর”—এর মানে হরি মহারাজ বলেছেন : “এক্ষুনি অদ্বৈতজ্ঞান লাভ করে তারপর যা ইচ্ছা তাই কর।” ঠিক কথা। বাপ কা বেটা। ‘Intellectual Conviction’ নয়।
আমি আত্মা—ব্রহ্ম। এও একটা রাস্তা—বিচারপথ। এটাই শেষ নয়। সমাধি না হলে ঠিক জ্ঞান হয় না। বিচারের শেষে সমাধি। প্রেম-ভক্তিও একটা রাস্তা। যে প্রেম-ভক্তি লাভ করেছে, ব্রহ্মজ্ঞান তার অতি নিকটে।
ঢাকায় পূজনীয় বাবুরাম মহারাজ আমায় এক ভক্তের বাড়ি যেতে বলেন। পূজনীয় মহারাজকে প্রণাম করে যাওয়ার কথা বলায় তিনি বললেন : “আজ বৃহস্পতিবারের বারবেলা, এখন যাবি?” আমি বললাম : “দুর্গানাম করে যাই।” তিনি বললেন : “তা হলেও ঠাকুর বৃহস্পতিবারের বারবেলা, অশ্লেষা ও মঘা মানতেন। আমরাও ঐ তিনটে মেনে চলি।”
পুরীতে মহারাজ আমাকে বললেন : “তুমি ব্রহ্মচারী। নিজে রান্না করে খাও।” কিছুদিন ঐরূপ খাওয়ার পর বললেন : “এখন ভিক্ষা করে খাও।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম—সব জাতের লোকের কাছে ভিক্ষা করব কি না? তিনি বললেন : “যার কাছ থেকে ঘৃণা না হয়, তার কাছ থেকে ভিক্ষা করো।”
মহারাজ তপস্যা করতে যাওয়ায় আমি বলেছিলাম— তপস্যা করলে অভিমান হবে। তিনি বললেন : “তপস্যার অভিমান ভাল।” অর্থাৎ আমি তপস্বী—এই অভিমান ভাল। সাধন-ভজনের অনেক বিঘ্ন আছে। স্বামী অনুভবানন্দকে রাজা মহারাজ বলেছিলেন—প্রত্যহ অন্তত পাঁচহাজার জপ করা উচিত।
১৯২১ সালে পূজনীয় শান্তানন্দ মহারাজ, জগদানন্দ মহারাজ, অনুুভবানন্দ মহারাজ প্রমুখের ভুবনেশ্বরে সন্ন্যাস হয়। মহারাজ নিয়ম করেছিলেন—ভোর ৪টায় উঠবে, ধ্যান-জপ করবে। বেলুড় মঠে তাই হতো—মহারাজের ঘরে ও বারান্দায়। ধ্যান-জপের পর ভজন গাওয়া হতো। ‘বিশ্ব এখন ভজন গাও।’ সেবক বিশ্ব মহারাজকে রাজা মহারাজ এরকম বলতেন। শ্যামাসংগীত হতো। মহারাজ বলেছিলেন—সকলকে গান শিখতে হবে।
মহাপুরুষ মহারাজ একদিন বলেন—দীক্ষার সময় ভগবানই গুরুর দেহ আশ্রয় করে দীক্ষার্থীকে কৃপা করেন। তিনি বলতেন : “শুধু ‘রামকৃষ্ণ’ নাম জপেই সব হবে।” স্বামী সারদানন্দজীর পত্রে আছে—“তাঁর নামই মহামন্ত্র, যত পার জপ করিবে। তাহাতেই সব হইবে, ইহাতে যদি বিশ্বাস না হয় এবং অন্য দীক্ষা লইতে ইচ্ছা হয় ভুবনেশ্বরে মহারাজকে পত্রে লিখিও।”
মহাপুরুষ মহারাজ একজনকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন প্রাণায়াম শেখানোর জন্য। আমি মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলাম : “আপনি নিজে না শিখিয়ে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন কেন?” তিনি বলেন : “তুমি এখন ঐসব করছ তাই।” যোগ বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে কালীকৃষ্ণ মহারাজ সেই চিঠি আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন জবাব দেওয়ার জন্য। জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম ও যোগের সমবায়ে চরিত্র গঠন করা মঠের আদর্শ।
আমার ওপর মহারাজের বরদান ছিল, তা না হলে আমি হয়তো রামাশ্রয় স্বামীর শিষ্য হয়ে যেতাম! তিনি অতি মহান পুরুষ ছিলেন। জ্ঞানী, প্রেমিক, যোগী, স্নেহবান এবং খুব ত্যাগী।
যো-সো করে আগে বুড়ি ছুঁয়ে ফেল। বাবা তপস্যা কর, তপস্যা কর। এই সময়। এখন না করলে আর হবে না। সাধনার শেষ নেই। ধ্যান-জপ না করলে চিত্ত মলিন হয়, নিষ্কাম কর্ম করা যায় না। বিক্ষিপ্ত চিত্তে রাগ-দ্বেষ বেশি হয়।
মনকে বোঝাবে যে, আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সকলকেই দুঃখভোগ করতে হয়। সুখের চেয়ে দুঃখের ভাগই বেশি। মন! তুমি কোথায় সুখ খুঁজছ? ওখানে তো দুঃখই বেশি। এই সুখ-দুঃখের পারে যাও, পরমানন্দ লাভ করবে। সময় থাকতে থাকতে এই প্রহেলিকার পারে যেতে হয়। ভক্তি-ভাবের গান লেখ। তাই গাও, চিত্ত স্থির হবে। আরতিতে যাবে। তারপর ধ্যান করবে। ধ্যানের সময় ঘুম পেলে একটা ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে চোখ মুছে ফেলবে। ঠাণ্ডাজল ঘুমের ঔষধ। জিগির থাকা চাই, যাতে ধ্যানে বিঘ্ন না হয়। সময় থাকতে থাকতে বুড়ি ছুঁয়ে নাও। পরে যেন কাঁদতে না হয় যে, জীবনটা বৃথা গেল, সাধন-ভজন করতে পারলাম না।
বাবুরাম মহারাজ আমায় এক ঘণ্টার মধ্যে কাজ করতে এবং বাকি সময় ধ্যান-জপ করতে বলেছিলেন। পুরীতে শরৎ মহারাজ গান করছিলেন। মহারাজ, হরিবল্লভবাবু, কৃষ্ণলাল মহারাজ আর বোধহয় হরি মহারাজও বসেছিলেন। শ্যামের না কি অন্য কারুর ৩/৪ বছরের একটা মেয়ে কাঁদছিল। গানে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই কৃষ্ণলাল মহারাজ আমাকে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বলায় আমি অন্দরমহলে তাকে ছেড়ে দিয়ে এলাম। পরে মহারাজ আমায় ডেকে বললেন : “তুই যখন অন্দরে যাচ্ছিলি, হরিবল্লভবাবু আমার মুখের দিকে চেয়েছিলেন—আমার লজ্জা হচ্ছিল।” আমি বললাম : “আমায় কৃষ্ণলাল মহারাজ নিয়ে যেতে বলেছিলেন।” তিনি বললেন : “কৃষ্ণলাল তো ওরকম বলে না।” আমি আবার বললাম : “কৃষ্ণলাল মহারাজ বলেছেন।” তখন তিনি বললেন : “বললেই বা, ভয় কী? তুই কি তার ভাতে আছিস না কাপড়ে আছিস?” মহারাজ একদিন আমায় বললেন : “দেখ, আমায় অভক্তি করিসনি, অশ্রদ্ধা করিসনি।”
শ্রীশ্রীমা সাধারণত ঘোমটা দিয়ে থাকতেন। আমি যখন উদ্বোধনে গেলাম, দুধাপ সিঁড়ি নেমে এসে তিনি আমায় প্রসাদ দিলেন এবং আশীর্বাদ করলেন। একবার আমায় উদ্বোধনে নাচতে ও গাইতে বললেন। আমি তাই করলাম। হরি মহারাজ বলেছিলেন (কোনো একটা বিশেষ ব্যাপারে) : “You are very serious.” আমি বললাম : “Life is not a gambling. I have not come here to play a game.” পরে মহারাজকে ঐ কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন : “থাক গো।”—অর্থাৎ কথাটা উড়িয়ে দিলেন। মহাপুরুষ মহারাজকেও বলেছিলাম, তিনি বললেন—বাইরে বেশিদিন থাকলে ঐরকম হয়।
বেলুড়ে মহারাজকে দেখেই দীক্ষা নিতে প্রবল ইচ্ছা হলো। তাঁকে দেখে কোনো সংশয় হয়নি। কিন্তু তিনি বললেন : “তুই আমায় দুবছর দেখ।” আমি কিন্তু অপেক্ষা করতে পারিনি। মহারাজ বলেছিলেন : “নিষ্কিঞ্চন না হলে কি তাঁর কৃপা হয়?”
পুরীতে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্যের ওখানে কথা শুনলাম—মহারাজ তাস খেলেন। একটু criticism-এর ভাব। ব্যাপারটা আমিও জানতাম। ফিরে এসেই দেখি, মহারাজ ও শরৎ মহারাজ তাস খেলছেন! আমি ওঁদের এই কথা বললাম। মহারাজ বললেন : “তা সকলেই কি সকলকে মানে?” মহারাজের ঐ কথায় তাঁর ওপর শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।
স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিলাতি জিনিস, লবণ পর্যন্ত বর্জন করেছিলাম। তুলসী মহারাজের বকুনিতে একজায়গায় নিমন্ত্রণে বিলািত লবণ খেয়েছিলাম। মহারাজকে সেই কথা বলাতে তিনি বললেন : “কেন খেলি? যখন প্রতিজ্ঞা করেছিলি তখন তুলসীর কথায় কেন প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করলি? এতে মনের জোর কমে যায়।”
National Spiritটা মহাপুরুষ মহারাজ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। হরিদ্বারে একজন আমায় দেখিয়ে ওঁকে বলেছিল—ইনিও স্বদেশি। মহাপুরুষ মহারাজ বলেছিলেন : “ভাল, National Sprit রাখা ভাল।”
মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে কথামৃত নিয়ে বিক্রি করে তাঁকে টাকা দিয়েছি়। সেসময় ঠাকুরের প্রচার খুব কম ছিল।
কাকভূশণ্ডি (অথবা অন্য কোনো সাধু)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : “আপনি তো জ্ঞানী, তবে এখনো রামনাম জপ করেন কেন?” তিনি বললেন : “যা থেকে একবার উপকার পেয়েছি তাকে ছাড়ব কেন?” কোনো এক মন্ত্রের কথা রাজা মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম : “এটা তো বীজমন্ত্র নয়!” মহারাজ বললেন : “শ্রদ্ধা থাকলেই হয়।” অর্থাৎ শ্রদ্ধা থাকলে বীজমন্ত্র না হলেও জপ করে সিদ্ধ হওয়া যায়। কথামৃতে আছে, গরমকালে ধ্যান-প্রাণায়ামাদির সুবিধা না হলে কীর্তনগানাদিতেও কাজ হয়। জোরে জোরে কীর্তন করলে মনে অন্য চিন্তা আসতে পারে না, মন স্থির হয়। শীতকালে খুব ধ্যান করবে। খুব তপস্যা করো। তপস্যা কী? না, সর্বদা মন ঐদিকে লেগে থাকবে এবং সুবিধা পেলেই ধ্যানে বসে যাবে। একজায়গায় পড়ে থাকাই লক্ষ্য নয়, তপস্যা করাই লক্ষ্য। বেশি স্থানপরিবর্তন করাও ভাল নয়। মহারাজ আমায় বলেছিলেন : “অত স্থানপরিবর্তন করা ভাল নয়। অন্তত ৩/৪ মাস একজায়গায় থেকে ধ্যান-ভজন করবি।”
আমি চলে গেলেও এইসব বিচার (মহারাজের কথাবার্তা) তোমার মনে উঠবে। “অবশ্যমেব ভোক্তব্যং কৃতং কর্ম শুভাশুভম্।” (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ)
বাবুরাম মহারাজ বলেছেন : “বিচার করা অর্থাৎ আমি আত্মা—ওটাও একটা পাশ।” অর্থাৎ বিচারই শেষ নয়।
ভক্তরা অহং ত্যাগ রেখে উপাসনা করে। জ্ঞানীরা ঈশ্বর ও আমি এক মনে করে। তাদের ঈশ্বর মায়িক। ভক্ত চিনি খেতে চায়, হতে চায় না। যারা বিচারশীল লোক, তারা এই খেলারও পারে যেতে চায়। তাদেরই নির্বিকল্প সমাধি হয়। ভক্তদের নির্বিকল্প সমাধি হয় না। অর্থাৎ যে-ভক্ত চায় না, তার হয় না। তারা মুক্তি চায় না। তারা মুক্তি চাইলে তাদের ইষ্টই তাদের মুক্তি দিয়ে দেন।
যাদের নীরোগ সুস্থ শরীর, ব্রহ্মচারী, সবল—তারা যদি যোগীন্দ্র না হয় তো হবে কারা? বল না থাকলে হয় না।
“শরীরপোষণার্থী সন্ য আত্মানং দিদৃক্ষতি।
গ্রাহং দারুধিয়া ধৃত্বা নদীং তর্তুং স গচ্ছতি॥”
(বিবেকচূড়ামণি)
ধ্যান-ভজনের যাতে সাহায্য হয়, তার জন্য শরীরপোষণ করা পাপ নয়।
“আত্মানম্ অরণিং কৃত্বা
প্রণবঞ্চোত্তরারণিম্। জ্ঞাননির্মথনাভ্যাসাৎ
পাশং দহতি পণ্ডিতঃ॥” (কৈবল্যোপনিষদ, ১১)
অরণি কাঠ ঘষতে ঘষতে যেমন দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি ধ্যান করতে করতে সমস্ত বাসনা গেলে আত্মদর্শন হয়।
ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করবে—“হে প্রভু, তোমার সেই পরম সত্যস্বরূপ দেখিয়ে দাও, যোগীরা যার ধ্যান করে।” আমি আত্মা—এই বোধ যতক্ষণ না পাকা হয় ততক্ষণ তাঁকে প্রার্থনা করতেই হবে। কেননা এখন পরোক্ষ জ্ঞান হয়েছে, অপরোক্ষ জ্ঞান তো হয়নি। তা না হলে ধ্যান, ভজন, প্রার্থনা ছেড়ে দিলে পস্তাতে হবে। বেলুড় মঠে মহারাজ বলেছিলেন : “কত লোক বেদান্ত পড়ে নাস্তিক হয়ে যায়! ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্’—বেদান্তের সার কথা। তাও করবে আবার সাকার উপাসনাও করবে।”
মহারাজের কথা লিখে ছাপিয়ে কী হবে? যা শুনেছ জীবনে ফলাও। কিছু কর। এখন মনে রাজা হওয়ার ইচ্ছা নেই, ঘর-সংসার করার ইচ্ছা নেই, কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলি তো বহির্মুখ আছে়। এখন যদি ‘আমি আত্মা’, ‘আমার আবার সাধনের দরকার কী’ বলে সাধন-ভজন ত্যাগ কর, তাহলে সেই কৌপীন কা ওয়াস্তের মতো হবে। চিত্তে রাগদ্বেষ হেতু ক্রমে অধঃপতন হবে। তাই প্রাণপণে সাধন করে যাও। গুরুদত্ত মন্ত্রে কী আছে জেনে নাও।
রামাশ্রয় স্বামী জিজ্ঞাসা করলেন : “তোমার মন্ত্র কী?” আমি গুরুদত্ত মন্ত্র বলতে ইতস্তত করছি দেখে তিনি বুঝে বললেন : “ভেদ, কি অভেদ?” আমি বললাম : “ভেদাভেদের মাঝামাঝি।” পরে মহারাজকে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন—আমাদের ভেদ অভেদের মধ্যে একটাও দেওয়াল নেই।
পুরীতে স্নান করছিলাম, শরৎ মহারাজ মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছিলেন। সেই সময় বললেন : “দেখ, জগন্নাথের কাছে কেউ যদি রাজা ও সাধু হতে চায় তো জগন্নাথ তাকে আগে রাজা ও পরে সাধু করেন।” (সব ভোগ শেষ না হলে সাধু হয় না—এই প্রসঙ্গে কথাটি ওঠে।)
আমার কথা এই, নিজে করে বুঝে নেব। ইনি এই বলেছেন, উনি ঐ বলেছেন—তাতে আমার কী? আমি করে দেখে বুঝে নেব।
আমি তখন পুরীতে, সেটা ১৯০৭ সাল। তখন মহাপুরুষ মহারাজ আমায় চিঠি লেখেন—৩টি ছেলে এসেছে। জিতেন মহারাজ, শান্তানন্দ মহারাজ ও গিরিজা মহারাজ। তিনজনে দেওঘরের পথ দিয়ে হেঁটে কাশী গিয়েছিলেন। মহাপুরুষ মহারাজ আমায় লিখেছিলেন : “তাঁর কৃপায় সাধন পূর্ণ হলেই আনন্দ। আর কিছু চাইবার থাকে না।” পুরীতে মহারাজ আমায় বললেন (আমি যোগের আসনাদি করছি দেখে) : “আমরাও কিছু কিছু জানি।” ঠাকুরের কাছে মহারাজ শিখেছিলেন।
আজ ভাগবতের প্রথম শ্লোকটি পড়া হয় টীকা-সহ। সিদ্ধান্তপ্রদীপ টীকা—দ্বৈতাদ্বৈত মত। আমরা সব মতই মানি। কারো সঙ্গে আমাদের ঝগড়া নেই। প্রভুই সব। দ্বৈতও তিনি অদ্বৈতও তিনি। সাকারও তিনি নিরাকারও তিনি। মায়াও তিনি। প্রভু ছাড়া আর কিছু নেই। উপাদানও তিনি নিমিত্তও তিনি। অদ্বৈত গেঁাসাই যখন অদ্বৈতের কথা বলতে শুরু করলেন, তখন মহাপ্রভু বাধা দিয়ে বললেন : “তাহলে আমাকে আনলে কেন?” যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী এক-একটা ভাবের প্রচার হয়। পুরীতে মহারাজ বললেন তপস্যা করলে শরীর ক্ষীণ হয়, কিন্তু মনের জোর বাড়ে। জপ-ধ্যান, শাস্ত্রপাঠ, সাধুসঙ্গ, বিচার—এসব করতে করতে সংযম করার শক্তি ও প্রবৃত্তি হয়। বহির্মুখ ইন্দ্রিয়গুলি অন্তর্মুখ হয়ে আসে। ভিতরে একটা পবিত্র ভাব আনা ও তজ্জনিত আনন্দলাভ করা—এই হলো উদ্দেশ্য।
স্বামীজী বা মহারাজকে ঠাকুর তো সব করে দিয়েছিলেন, তবু তাঁরা কঠোর তপস্যা করলেন কেন? যা পেয়েছিলেন সেগুলি রক্ষার জন্য, লোককল্যাণের জন্য। কুস্তিগীর পালোয়ানের কুস্তির কৌশলগুলি জানা আছে। কিন্তু অভ্যাস না থাকলে বল থাকে না। সমাধির কৌশল তত্ত্বজ্ঞানীর জানা থাকে, কিন্তু অভ্যাসরূপ তপস্যা না থাকলে সমাধি আনা বা পরের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করা সম্ভব হয় না। স্বামীজী বলেছিলেন—আবার যদি কৌপীনমাত্র সম্বল করে তপস্যা করি তো নির্বিকল্প সমাধি করিয়ে দিতে পারি। সারার্থ—তপস্যাই সমস্ত শক্তির উৎস।
মহাপুরুষ মহারাজ বলেছিলেন : “আমাদের এমন পবিত্র থাকতে হবে যে, আমাদের দেখে সকলে বলবে —আহা এরা এমন ভাল, না জানি এদের গুরুরা কেমন ছিলেন! বোধহয় অবতার ছিলেন।”
কোনোরকমে একবার সমাধি হলেও সাধনার প্রয়োজন থাকে। কিন্তু যারা সর্বদা ঐ ভাবে থাকতে চায়, তাদের তপস্যা করতে হবে। যিনি একবার সমাধিসুখ আস্বাদন করেছেন তিনি সেই সুখ বারবার আস্বাদন করার জন্য, সেটা স্থায়ী করার জন্য ধ্যানাদি করেন। ভগবানলাভ করলে নিজের মুক্তির জন্য আর সাধন-ভজনের প্রয়োজন নেই সত্য; কিন্তু লোককল্যাণ করতে হলে, সমাধির আনন্দ স্থায়ী করে রাখতে হলে সাধন-ভজন জারি রাখতে হবে। নইলে মহারাজ প্রমুখ অত কঠোর করলেন কেন? তাঁদের তো ঠাকুর সব করে দিয়েছিলেন। সাধনা করে নিজে না বুঝলে এসব কথা বোঝা যায় না।
এই বেলা তপস্যা করে বস্তুলাভ করে নাও। খাওয়া-দাওয়া ও বাক্যের সংযম, ধ্যান, জপ ইত্যাদি করে যাও প্রাণপণে; নইলে পরে অনুতাপ করতে হবে। সত্য, ত্যাগ, তপস্যাই ঠাকুরের শরীর। যেখানে এগুলির অভাব সেখানে তিনি নেই। পুরীতে মহারাজ একজন বাবাজীকে বলছিলেন : “মাছ কাটলে যেমন ছটফট করে, ভগবানলাভের জন্য সেইরকম ছটফটানি হয়।”
ধ্যানের অভ্যাস করলে মনে অন্য চিন্তা এলে সেগুলি তাড়ানোর শক্তি হয়। দেরাদুনে আমার মনে যেই বাজে চিন্তা এল, অমনি ‘দূর হয়ে যাও’ বলে তাদের তাড়িয়ে দিলাম। ধ্যানে ‘Will Power’ বাড়ে। তাই ধ্যানে নিষ্ঠা রাখা ভাল।
পুরীতে শশী মহারাজ বললেন : “কালীর (স্বামী অভেদানন্দজী) জন্য চিন্তা হচ্ছে।” মহারাজ বললেন : “থাক, ঠাকুর দেখবেন।” কাশীতে মহাপুরুষ মহারাজকেও তিনবছর দেখেছি। কখনো কারো নিন্দা করছেন শুনিনি। তাঁকে দেখেছি বলেই মঠে আসতে পেরেছি। তাঁকে না দেখলে মঠে আসা হতো না। মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ, শশী মহারাজ, শরৎ মহারাজ, বাবুরাম মহারাজদের মুখে কারো সম্পর্কে কোনো নিন্দা শুিননি। তাঁদের তুলনা নেই। ‘যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ’—এ গীতার কথা। তপস্বী না হলে কিছুই হবে না। সময় থাকতে থাকতে করে নাও। পরে শরীর দুর্বল হলে আর হবে না।
একজন তান্ত্রিকী পূজা করত, আমার সেরকম পূজা করার ইচ্ছা হয়েছিল। মহারাজকে জিজ্ঞাসা করায় বললেন : “তুই ব্রহ্মচারী, তুই আবার কী (তান্ত্রিকী) পূজা করবি? তুই ধ্যান করবি। ইচ্ছা হলে কিছু ফুল জোগাড় করে এনে ঠাকুরের পায়ে দিবি।”
ধ্যান করতে করতে আর না পারা গেলে জপ করতে হয়, জপের সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান করতে হয়। জপ করতে করতে ধ্যান হয়—তখন জপ চলে না। আবার ধ্যান বন্ধ হলে আপনা-আপনি জপ হতে থাকে। এরকম অনেক অবস্থা আছে।
মহারাজদের বই পড়লে উদ্দীপনা হয়। ধর্মপ্রসঙ্গে ব্রহ্মানন্দ ও শিবানন্দ বাণী ইত্যাদি পড়লে দেখা যায়, দুজনের উপদেশের ধারা একটু ভিন্ন। মহাপুরুষ মহারাজ ভক্তি ও শরণাগতির ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। মহারাজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ়ভাবে জপধ্যান করতে বলেছেন।
বেদান্তের অধিকারী হতে হয়। ধ্যান-জপ করে তারপর বেদান্ত শুনতে হয়, নইলে উলটো বোঝে। আসন খুব বেশি করার কোনো দরকার নেই। ধ্যানই লক্ষ্য। বেলুড় মঠে মহারাজের নিকট দীক্ষা নিয়ে আমি আসনে বসে গেলাম—মন্ত্রসিদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত উঠব না। ঠাকুরঘর বন্ধ হলো, খাওয়ার ঘণ্টা পড়ল। আমার ডাক পড়ল। পূজনীয় বাবুরাম মহারাজ পর্যন্ত ডাকলেন, তবু গেলাম না। ২টা বেজে গেল। মহারাজকে ডাকতে গেলাম। মহারাজ বললেন : “কী চাস? রাজ্য না রাজকন্যা? কত বিঘ্ন আছে জানিস? শরীরটাকে ঠিক করে ফেল, তা না হলে কী দিয়ে সাধন করবি?”
মন্ত্র সম্বন্ধে আসল কথা হলো—যার যাতে বিশ্বাস। এবিষয়ে রাজা মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বললেন : “আসল জিনিস বিশ্বাস। বিশ্বাস থাকলে হয়।” রত্নাকর দস্যু ‘মরা, মরা’ জপ করে সিদ্ধ হলেন শ্রদ্ধা ছিল বলে। কবীর ‘রাম রাম’ জপ করে সিদ্ধ হলেন।
Idle thoughts and idle talks যদি avoid করে চলতে পার তো spiritual progress শীঘ্র শীঘ্র হবে।
(১২.২.৫৩। আজ শিবরাত্রি। রাত্রে আধপোয়া দুধ চিনি-সহ নিজে শিবজীকে ভোগ দিয়ে মহারাজ আমাকে প্রসাদ দিলেন।) শরীরকে বেশি কষ্ট দেওয়া ভাল নয়। উদ্দেশ্য ভুল না হয়। উদ্দেশ্য—বেশি করে তাঁকে স্মরণ করা। যাতে তাই করার সুবিধা হয়, তাই দেখতে হবে।
“অভ্যাসবৈরাগ্যাভ্যাং তন্নিরোধঃ”, “অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে”—আগে অভ্যাসের কথা বললেন। অভ্যাস করতে করতে বৈরাগ্য আসে। কারণ, অভ্যাস করলে মন স্থির হয়ে গেলে বিষয়ের দোষগুলি ভাল করে নজরে আসে; তার ফলে বিষয়ে বিতৃষ্ণা বাড়ে। অভ্যাস ছেড়ো না। সকাল-সন্ধ্যায় িনয়মিত জপ-ধ্যান করে যাও। এর ফলে কিছু না কিছু পাবেই। না পেলে এগনো মুশকিল। কারণ এদিকের সুখ তো ছেড়েছ—ওদিকের কিছু না কিছু চাই। পরম সত্য পেতে হলে আরো এগিয়ে যেতে হবে।
আসল কথা—ধ্যান করতে হবে, আলস্য ধরলে সর্বনাশ। বেশির ভাগ লোকই কিছু কিছু করে ছেড়ে দেয়। ২/৩ বছর লাগাতার করা দরকার। দেহতে আত্মবুদ্ধি করেই যত দুঃখ! একবার দেহতে আত্মবুদ্ধি চলে গেলে আর কি কেউ ইচ্ছা করে আবার দেহতে আত্মবুদ্ধি আনতে চায়? হরি মহারাজ এক জহুরির গল্প বলেছিলেন। এক রানি এক জহুরিকে ডেকে পাঠিয়েছিল। রাজা এসে পড়ায় তাকে পায়খানায় বন্দী থাকতে হয়। রাজার বাহ্যে পাওয়ায় পায়খানায় বাহ্যে করে, রানিও ঐরূপ করে। সকালে মেথর জহুরিকে দেখে ফেলে। জহুরি এক লাখ টাকা দিয়ে সব প্রকাশ করতে নিষেধ করে। পরে রানি আরেকদিন ডেকে পাঠায়। সে কি আর যাবে?
ভাগবত পড়াটা Continue করো। উপনিষদগুলি যা বাকি আছে পড়ে নিও। অন্যের কাছে পড়তে হবে না, নিজেই পারবে। সঙ্গে সাধন-ভজন থাকলে সব clear হয়ে যাবে। বৈরাগ্যই অভয়। মহারাজ বৈরাগ্য রাখতে বলতেন। সাধুর সকল সময়ই বৈরাগ্য রাখা উচিত। জ্ঞানের পরও।
সন্ন্যাস নেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করবে না। আগে সাধন-ভজনের দ্বারা বল বাড়াও। যথাসাধ্য ধ্যান-জপ, আসন-প্রাণায়াম, শাস্ত্রপাঠ কর। সময় একটুও নষ্ট না হয়। এখন তপস্যা না করলে পরে ভুগতে হবে। আলস্য করলে আর রক্ষা নেই! গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করে দেখ কী হয়। মহাপুরুষ মহারাজ বলেছিলেন : “এইসব বিল্ডিং-টিল্ডিঙের ওপর আস্থা স্থাপন করলে ঠাকুরকে ভুলে যেতে হয়।”
ভাগবত পাঠ কর। পুরাণগুলিও সব একবার দেখে নিও। দেবীভাগবত পাঠ কর। শিবপুরাণ, পদ্মপুরাণ, আত্মপুরাণ—এইসবে অনেক ভাল কথা আছে। ভাল যা নিতে পার নিও। বৃন্দাবনে তোমার খুব সুবিধা। সহজে এস্থান ছেড়ো না। তপস্যা থাকলে আসক্তি হবে না।
বেলুড় মঠে মহারাজ আমাকে বলেছিলেন : “ঘরের মালিককে সব দিকে নজর রাখতে হয়।” যে মোহন্ত হয়, তার সব দিকে দৃষ্টি থাকা উচিত।
কাজ বুঝে নেওয়ার লোক অনেক পাবে, কিন্তু সাধন-ভজন বুঝে নেওয়ার লোক পাবে না। অর্থাৎ একজনকে কাজ দিয়ে কাজ করল কি না তা দেখার লোক পাবে কিন্তু জপ-ধ্যান, পাঠাদি করল কি না তা দেখার লোক পাওয়া কঠিন।
শ্রীশ্রীবৃন্দাবন ধাম। বুধবার, ১৩.৫.৬৪। পূজনীয় গোেপশ মহারাজ আমাকে মিশনের সদস্য হতে বলেন। Join করার পর প্রায় ১৫ বছর কেটেিছল বরাবরই মিশনে, তবু সদস্য ছিলাম না। দরখাস্তে পূজনীয় গোপেশ মহারাজই সই করেন। সেদিন কথায় কথায় “শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন—বৃন্দাবনের রজ ব্রহ্মস্বরূপ, এখানে থাকার তো ইচ্ছা বরাবর ছিল।” ইত্যাদি কথার উত্তরে তিনি বলেন : “তুমি তো রামকৃষ্ণ মিশনের।” তিনি আমায় আলোক দিলেন।শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপা।
আমি মুক্তির বিরোধী ছিলাম। মহাপুরুষ মহারাজকে বলেছিলাম—কাশীতে থাকব না। পুরীতে মহারাজকে বলেছিলাম—জগন্নাথ-দর্শনে যাব না। ‘রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা’। মহারাজ বলেছিলেন : “নির্বাণমুক্তি হবে কেন! কত সব লোক আছে, সেখানে থাকবি, পুনর্জন্ম হবে না।”
মুক্তিতে মানুষ আনন্দরূপ হয়ে যায়। যে-মানুষ মুক্ত হয়ে যায়, সে পরবর্তী কল্পে আসে না। আধিকারিক পুরুষ স্বামীজীর কথা আলাদা। মুক্তি কী জিনিস জান না বলে মুক্তি চাও না। গর্ভবতী স্ত্রীর যেমন সর্বদা ফিকির থাকে—যাতে গর্ভ নষ্ট না হয়, তেমনি সাধকের ফিকির থাকবে—যেন ধ্যানে কোনো বাধা না হয়।
ব্রহ্মবিদ্যা লাভের জন্য শরীরের যত্ন নিতে হয়। ভোরে উঠে নিত্য ধ্যান করতে হয়। আসন করে বসার অনেক গুণ আছে।
মঠে পড়ার কথা বলায় মহারাজ বলেছিলেন : “এখানে সুবিধা পাচ্ছ, পড়ে নাও। পরে তপস্যাদি করো।” পুরীতে আবার যখন পড়ার কথা বলি তখন মহারাজ বলেন : “চারধাম করে এসে আবার পড়ো।” অর্থাৎ পড়াটাই সব নয়, ধ্যানই আসল। মহারাজ আমায় ধ্যান করতে বলেছিলেন।
হরি মহারাজের সঙ্গে নাঙ্গোলে ১ বছর ছিলাম (যখন হরি মহারাজ আমেরিকা থেকে ফিরে তপস্যায় যান)। আলমোড়ায় মহাপুরুষ মহারাজ একজায়গায় ছিলেন, আমি আরেক জায়গায়। ৫/৬ মাস মধ্যে মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম। তিনি বলেছিলেন : “অত selfish হয়ো না। যারা আসবে তাদের সঙ্গে ধর্মপ্রসঙ্গ করো, তাদের কল্যাণ হবে।”
মহারাজ আমায় বলেছিলেন প্রার্থনা করতে—“হে প্রভু! তুমিই নানারূপে—তুমি সাকার, তুনি নিরাকার। আমি তোমার শরণাগত, তোমার আশ্রিত। আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। তুমি স্থূল, তুমি সূক্ষ্ম, তুমি কারণ, তুমি মহাকারণ, তুমি সচ্চিদানন্দ। তোমা হতেই উৎপন্ন চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ, সমুদ্র।”