।। ৩।।

খড়গ্রাম থেকে এড়োয়ালীর দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। এড়োয়ালীর ‘আঠারোপাড়া’ বিশাল গ্রাম। আঠারোপাড়া গ্রাম কথাটা বোধ হয় অনেকের কাছেই নতুন ঠেকছে। সুতরাং ব্যাপারটা সম্পর্কে দু-এক কথা বলা প্রয়োজন।

জমিদারবাবুদের ভদ্রাসন যে-গ্রামে থাকত সেখানে সাধারণত স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজ গড়ে তোলা হতো। অর্থাৎ বামুন-কায়েতদের ‘বাবুপাড়া’ ছাড়াও কামার, কুমোর, তাঁতি, জেলে, ধোপা, নাপিত, বদ্যি, ঘরামি, চাষি, গোয়ালা, ময়রা, বায়েন, ডোম, মুচি, পালকি-বেহারা কাহার প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সব বৃত্তির মানুষদের জন্য আলাদা আলাদা পাড়া থাকত। তাদের চাকরান জমি দিয়ে স্থায়িভাবে গ্রামে বসত করানো হতো। অর্থাৎ এরা ছিল জমি দিয়ে বসানো প্রজা, তারা তাদের চাকরান সম্পত্তি ভোগদখলের বিনিময়ে পুরুষানুক্রমে জমিদারবাবুদের সেবা করে যেত। মুসলমানপাড়া থাকত গ্রামের এক প্রান্তে। সব মিলিয়ে আঠারোটি পাড়া থাকত বলে এধরনের গ্রামকে বলা হতো ‘আঠারোপাড়া গ্রাম’।

২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে এড়োয়ালীর এলাকা ১০৪০.১৯ হেক্টর। জনসংখ্যা ৫৯১৭ জন, বাড়ির সংখ্যা ১৫৬৭টি। তবে এতদিনে অবশ্য লোকসংখ্যা এবং বাড়ির সংখ্যা দুই-ই বেড়েছে। এড়োয়ালীর আশপাশের গ্রাম হলো আয়রা, আউগ্রাম, গয়েসপুর, জটারপুর, কাঁদুরি ইত্যাদি।

এড়োয়ালীর রায়চৌধুরীরা বীরভূম জেলার ঢেকার রাজা রামজীবন রায়ের বংশধর। সম্রাট শাহজাহান তাঁকে শায়েস্তা খাঁর অধীনে ‘রাজা’ খেতাব দিয়েছিলেন এবং সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলেও তাঁর যথেষ্টই প্রতাপ ছিল। শোনা যায়, কলেশনাথের মন্দিরনির্মাণের কারণে কর দিতে না পারায় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আক্রমণে ঢেকা ধ্বংস হয়। যদিও এড়োলের রায়চৌধুরী পরিবারের অনেকেরই বক্তব্য—মুর্শিদকুলির আক্রমণে নয়, বর্গিদের হাতে সম্মানহানির ভয়ে রামজীবন সস্ত্রীক রামসাগর দিঘির জলে আত্মহত্যা করেন এবং বর্গিদের হামলায় ঢেকা ধ্বংস হয়। আবার এমন কথাও শোনা যায় যে, সিউড়ির কাছে রাজনগরের পাঠান শাসক ও নবাব আলিবর্দী খাঁর দেওয়ান আলিনকী খাঁর হাতে ঢেকা ধ্বংস হয় আর রামসাগর নয়, ঢেকাতেই অন্য একটি দিঘির জলে রামজীবন সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। ঐ দিঘির মাঝখানে রামজীবন তাঁর বজরা ডুবিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে বর্তমানে ঐ দিঘি ‘লাডুবরি’ নামে পরিচিত।

এখানে এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, তা সত্ত্বেও দুটি কথা বলা প্রয়োজন। প্রথমত, কলেশনাথের মন্দির তৈরি শেষ হয় ১৬৬০ সালে আর মুর্শিদকুলি খাঁ মুর্শিদাবাদে আসেন ১৭০৩ সালে। সুতরাং কলেশনাথ বা কলেশ্বরের মন্দিরনির্মাণের কারণে বকেয়া কর নিয়ে মুর্শিদকুলির সঙ্গে রামজীবনের বিরোধ হওয়া অসম্ভব। আর দ্বিতীয় কথাটি হলো, আলিনকী খাঁ এবং বর্গিদের আক্রমণ রামজীবনের জীবৎকালে ঘটেনি। কাজেই সস্ত্রীক রামজীবনের আত্মহত্যার কাহিনিটি জনশ্রুতি মাত্র। এঘটনাগুলি ঘটেছিল রামজীবনের পুত্র রাজা রামচন্দ্রের আমলে।

রামচন্দ্র বার্ধক্যের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। এক বছর রাজবাড়ির কালীপুজোয় (মতান্তরে সিংহবাহিনী) বলিতে ‘বেঁড়ে’ পড়ে (এক আঘাতে বলি সম্পন্ন না হওয়া)। এর অর্থ হলো—দেবী বলি গ্রহণ করলেন না। ধর্মপ্রাণ রামজীবন বৃদ্ধবয়সে এই মানসিক আঘাত সহ্য করতে পারেননি। সেবছরেই ৭১ বছর (মতান্তরে ৬৮ বছর) বয়সে কোনো এক তীর্থ‌ক্ষেত্রে রাজা রামজীবন এবং কয়েকদিন পর তাঁর স্ত্রী সুজয়াদেবী দেহত্যাগ করেন।

তবে গত শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও যে ঢেকার ধ্বংসাবশেষ টিকে ছিল, সেকথা জানা যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খড়্গ’ গল্পটি থেকে : “নওয়াপাড়া হইয়া ঢেকায় পৌঁছিলাম অপরাহ্ণবেলায়।

“গ্রামের দ‌ক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে রায়বংশের কীর্তি-কলাপের ধ্বংসাবশেষ। মেটে গ্রাম্য রাস্তাটা ধরিয়া গ্রামের প্রান্তে পা দিতেই নজরে পড়িল রাস্তাটির দু-পাশে সু-প্রাচীন দেবদারু তরুশ্রেণী পথটিকে ছায়াশীতল করিয়া রাখিয়াছে। বুঝিলাম এইটিই ছিল রাজপথ।…

“সম্মুখেই ধ্বংসোন্মুখ এক বিশাল অট্টালিকা।

“অর্ধভগ্ন সু-উচ্চ অলিন্দের উপর তিনটি সুবৃহৎ খিলান এখনও অটুট অবস্থায় দাঁড়াইয়া আছে। অলিন্দের এক পার্শ্বের আলিসা দেওয়া চত্বর এখনও টিকে আছে। অপর পার্শ্বেরটি ভাঙিয়া গেছে। অভগ্ন চত্বরটির গা বহিয়া সিঁড়ি উঠিয়া গেছে।… সেই সিঁড়ি ভাঙিয়া চত্বরের উপরে উঠিলাম। দেখিলাম দালানটির দুই পার্শ্বে দুটি নাতিবৃহৎ প্রকোষ্ঠের মধ্যে সেই খিলানওয়ালা হল। হলের নীচে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠের চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়।

“এইটিই ছিল রাজার বিচারভবন ও সভাভবন।… দ‌ক্ষিণ দিকে যে চত্বরটি অটুট ছিল, সেই দিকের দ্বিতল প্রকোষ্ঠখানি এখনও দাঁড়াইয়া আছে, এই দিকের সিঁড়ি দিয়া উপরেও ওঠা যায়। আমিও… উপরে উঠিলাম। ফালি বারান্দা-ঘেরা ঘরখানির চারিদিকেই খিলান। সেই খিলানের ফাঁক দিয়া পশ্চিম দিকে যাহা দেখিলাম—তেমনটি বোধহয় জীবনে আর দেখিব না।

“বিশাল এক সরোবর…। চারি পাড়ে তাহার রায়বংশের কীর্তি-কলাপের ধ্বংসাবশেষ।…

“এই রামসাগর। লম্বায় এক মাইল হবে।

“রামসাগরের দ‌ক্ষিণপাড়ের উপর বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাইতেছিল।… প্রাসাদের ঠিক মধ্যস্থলে অন্দরের ঘাটটি প্রকাণ্ড একটি ছাতিম গাছের নিবিড় ছায়াতলে কত যুগ আগে যেন ঘুমাইয়া গেছে। ঘাটটির মধ্যস্থলে একটি চত্বর—চত্বরটির দু-পাশে দুটি পল-কাটা মিনার। মিনার দুটির কোল হইতে… দুইটি সিঁড়ি সায়রের জলতলে চলিয়া গেছে।… পশ্চিমপাড়ে… ভগ্নশীর্ষ সারি সারি দেউলমালার কোলে সুবৃহৎ নাটমন্দিরের চিহ্ন আজও দাঁড়াইয়া ছিল।”

ঢেকায় রাজা রামজীবন রায়ের রাজধানী মনোহরপুরের কোনো চিহ্নই আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০১৮-র জুন মাসে ঢেকা গিয়ে দেখেছিলাম শুধু তাঁর প্রতিষ্ঠিত বলে কথিত একটা ছোট্ট কালীমন্দির (তাও বর্তমানে পুনর্নির্মিত) আর রায়ভবানী, রামসাগর ও লাডুবরি নামে তিনটে দিঘি আজও কোনোমতে টিকে আছে। রামসাগরের দৈর্ঘ্য এখন খুব বেশি হলেও তিনশো মিটারের বেশি হবে না। তার দ‌ক্ষিণপাড়ে রাজার প্রাসাদ কিংবা পশ্চিমপাড়ে তাঁর ঠাকুরবাড়ি ও সারি সারি দেউলমালার একখণ্ড ইটও খুঁজে পাওয়া যায় না। রামসাগরের উঁচু পাড় প্রায় সমতল করে বিভিন্ন পাড়া গড়ে উঠেছে, যার সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছে আটাত্তর সালের বন্যার পরে। তাঁর কাছারিবাড়ির জায়গায় হেল্‌থ সেন্টার হয়েছে।

বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ঢেকা এবং লোকপাড়া নেহাতই ছোট দুটি গ্রাম, যাদের লোকসংখ্যা গ্রামপিছু গড়ে ছয়-সাতশোর বেশি হবে না। খাতায়-কলমে দুটি আলাদা গ্রাম হলেও নৈকট্যের কারণে তাদের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। অবশ্য ২০১০ সালে ময়ূরেশ্বর ব্লকের প্রথম কলেজ ‘রামজীবন রায় মহাবিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়েছে লোকপাড়ায়। রামজীবন রায়কে ঢেকা-লোকপাড়া-নওয়াপাড়া-কলেশ্বরের মানুষজন ভুলে যায়নি। তারা তাদের হতভাগ্য রাজাকে আজও মনে রেখেছে তাঁর প্রজাদরদি ভূমিকার জন্য।

সাঁইথিয়া-কান্দি রোড ধরে কোটাসুর হয়ে সতেরো কিলোমিটার গেলে কলেশ্বরের মোড়। সেখান থেকে ডানদিকে আরো তিন কিলোমিটার গেলে রামজীবন রায়ের তৈরি কলেশনাথ (লোকমুখে ‘কলেশ্বর’) শিবের মন্দির তার একশো পনেরো ফুট উচ্চতা নিয়ে আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো এককালে কলেশনাথের ছোট পাথরের মন্দির ছিল, সেই মন্দিরকেই রামজীবন ইটের বিশাল মন্দিরে রূপান্তরিত করেন। পরে দ্বারকানাথ দেবতাপাসী (বা দেবতপস্বী) নামে এক সাধু মন্দিরটি সংস্কার করেন। এখনো শিবরাত্রিতে কলেশ্বরের মেলায় অন্ততপ‌ক্ষে ৩০-৪০টি গ্রামের লোক এসে জোটে।

রামজীবন শাক্ত ছিলেন। তারাপীঠের মন্দিরও তিনিই তৈরি করান এবং একাজে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বাঘডাঙার ভূমিহার জমিদাররা। আজও দুর্গাপুজোর পর চতুর্দশীর সময় তারামায়ের মন্দিরে রামজীবনের বংশধর এড়োয়ালীর রায়চৌধুরীরা বলি পাঠান এবং তাঁদের পুজো হয় সবার আগে। তারাপীঠের বর্তমান মন্দির অবশ্য রামজীবনের প্রাচীন মন্দিরের ভিতের ওপরে ১৭৪০ শকে (১৮১৮ সালে) মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় তৈরি করান।

রামজীবনের গৃহদেবী সিংহবাহিনীর পুজোয় প্রতিদিন ছাগবলি হতো। অথচ তাঁরই প্রাসাদে মদনমোহনেরও (গোবিন্দরায়) নিত্যপূজা হতো। সেই রামজীবনই আবার কলেশনাথ শিবের মন্দির তৈরি করান। অর্থাৎ রামজীবনের ধর্মীয় ভাবনায় শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণবের এক অদ্ভুত সমন্বয় ঘটেছিল। তাঁর কাছে শাক্তমতটি প্রধান হলেও শৈব ও বৈষ্ণবের গুরুত্ব ও সম্মান কিছু কম ছিল না। অবশ্য সত্যি কথা বলতে কী, মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ঐতিহ্যই হলো বৌদ্ধধর্মের প্রচ্ছন্ন ধারাবাহিকতার মাধ্যমে শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণবের সমন্বয়, যার প্রভাব বীরভূমের অনেক অংশেও দেখা যায়। এবিষয়ে বিশদভাবে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই; তবু একটা কথা বলা প্রয়োজন, বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাবে মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূম জেলার বেশ কিছু অংশে শৈব, শাক্ত এবং বৈষ্ণব—এই তিন ধারার মধ্যেই দেহসাধনা এবং পরকীয়া সাধনের প্রাবল্য ছিল, যা এই তিন ধারার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকলেও থাকতে পারে।

পাঁচ

রাজা রামজীবন রায়ের মৃত্যুর খুব অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর বড় ছেলে ভগবতীচরণের মৃত্যু হয়। মেজ ছেলে কবি রামভদ্র সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করেন এবং সেজ ছেলে কেশব রাজা হওয়ার বদলে ঢেকার মহামন্ত্রীত্ব বেছে নেন। ফলত ছোট ছেলে রামচন্দ্র ঢেকার সিংহাসনে বসতে বাধ্য হন।
নবাব আলিবর্দীর সেনাপতি রাজনগরের আলিনকী খাঁ ও তাঁর বড়ভাই মহম্মদ উলজাম খাঁ দুবার ঢেকা আক্রমণ করেন। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে (১৭৩৪-৩৫ সাল) বিশ্বাসঘাতকতার কারণে রাজা রামচন্দ্র ও তাঁর সেনাপতি রামশরণ মল্ল যুদ্ধ‌ক্ষেত্রেই নিহত হন এবং ঢেকা-মনোহরপুর লুণ্ঠিত হয়। নিজের সম্মান বাঁচাতে রামচন্দ্রের স্ত্রী অর্থাৎ ছোট রানিমা রামসাগরের (নাকি লাডুবরি) জলে বজরা ডুবিয়ে আত্মহত্যা করেন। ভগবতীচরণের বংশধরেরা খড়গ্রামে বড়ঞা গ্রামের কাছে মটুকেশ্বরের গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। রামজীবন রায়ের অন্য বংশধরেরা বীরভূম জেলার নওয়াপাড়া (নপাড়া) ও হাতিয়ায় আশ্রয় নেন।

পরবর্তিকালে বর্গিদের হাঙ্গামা শুরু হলে ঢেকা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয় এবং বর্গি আক্রমণে রাজধানী মনোহরপুর ধ্বংস হয়। খাজনা জমা না পড়ায় জমিদারি চলে যায় নবাব সরকারের অধীনে। খড়গ্রামে তখন সৈয়দ আবুসাহেব মকদুমি ইস্পাহানি বা ‘মকদুম সাহেব’ নামে এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় পির বাস করতেন। তিনি ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁর গুরু (মতান্তরে গুরুভাই)। রাজা রামজীবন রায়ের সঙ্গেও তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। খড়গ্রামে বাদশাহি সড়কের পূর্বদিকে গ্রামের মধ্যে মকদুম সাহেবের কবরস্থান ‘মকদুম সাহেবের আস্তানা’ নামে আজও টিকে আছে। লোকমুখে খবর পেয়ে মকদুম সাহেব নিজে গিয়ে ভগবতীচরণের বংশধরদের মটুকেশ্বরের জঙ্গল থেকে খড়গ্রামে নিজের কাছে এনে রাখেন।

রামজীবন রায়ের বড় ছেলে ভগবতীচরণের দুই পুত্র—জয়সিংহ আর রঘুনাথ। জয়সিংহের দুই পুত্র দেবদত্ত ও ইন্দ্রমণি আর রঘুনাথের পুত্র শ্যামসুন্দর। মকদুম সাহেবের অনুরোধে ১৭৫১ সালে নবাব আলিবর্দী খাঁ তিন ভাইকে ‘লাট কীর্তিহাট’ প্রত্যর্পণ করার আদেশ দেন এবং তাঁদের ‘চৌধুরী’ খেতাব দান করেন। রামজীবন রায়ের প্রকৃত উপাধি ছিল চট্টোপাধ্যায়, যা সম্মানসূচক ‘রায়’-এর আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আর এখন থেকে রাজা রামজীবনের বংশধরেরা রায় থেকে ‘রায়চৌধুরী’ হলেন, যা তাঁরা আজও ব্যবহার করে চলেছেন।

বিভিন্ন আমির-ওমরাহ ও ধনীদের দানে মকদুম সাহেবের এক বিশাল জমিদারি গড়ে উঠেছিল, কিন্তু অনাথ-আতুরের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ পির সাহেবের দুনিয়াদারির প্রতি কোনো আগ্রহই ছিল না। সেজন্য নির্লোভ মানুষটি নিজের জমিদারির খড়গ্রাম পরগনাটি পুত্রসম তিন ভাইকে দান করে কিছুটা ভারমুক্ত হন। তাঁর পরামর্শ এবং সাহায্যেই দেবদত্ত, ইন্দ্রমণি ও শ্যামসুন্দর ১৭৫৪ সাল থেকে খড়গ্রামের পশ্চিমে এড়োয়ালীতে স্থায়িভাবে বসবাস করতে থাকেন।

এড়োয়ালী তখন এক জঙ্গল এলাকা, যার এক প্রান্তে একটি ছোট আদিবাসী পল্লি ও তাদের ধর্মরাজের থান ছিল। আর অন্য প্রান্তে বাদশাহি সড়ক তৈরির সময় থেকে কয়েকটি মুসলমান পরিবার বাস করত। স্বয়ং মকদুম সাহেব এই পরিবারগুলির বসবাস ও জীবিকার জন্য জমিজায়গা দান করে গিয়েছিলেন। পরে এই পাড়াটির নাম হয় ‘হালিমপাড়া’। তিন ভাই জঙ্গল কাটিয়ে বিভিন্ন বৃত্তির প্রজাদের লাখেরাজ চাকরান জমি দিয়ে বসিয়ে আঠারোপাড়া গ্রাম পত্তন করেন এবং ১৭৫৪-৫৫ সাল নাগাদ এড়োয়ালীতে কালীপুজো আরম্ভ করেন। যতদূর জানা যায়, এড়োয়ালীর আদি কালী ছিলেন ‘ধর্মকালী’। ধর্মরাজতলার পাশে অবস্থান বলে এই নাম।

অবশ্য এড়োয়ালীতে আসার বেশ কয়েক বছর আগেই রায়চৌধুরীরা কালীপুজো শুরু করেছিলেন। ১৭৩৫ সাল থেকে খড়গ্রামে বাস করলেও ১৭৪২-এ বর্গি আক্রমণ শুরু হলে ভগবতীচরণের বংশধরেরা পরিবার-পরিজনদের নিয়ে পাটনবিলের এক দুর্গম দ্বীপগ্রাম শিবপুরে চলে যান। মকদুম সাহেবের আশ্রয়ে থাকাকালীন সংগত কারণেই তাঁদের প‌ক্ষে কালীপুজো করা সম্ভব ছিল না, যা তাঁরা শিবপুরে এসে শুরু করেন। রাজা রামজীবন রায়ের প্রপৌত্ররা স্থায়িভাবে এড়োয়ালী চলে যাওয়ায় ১৭৫৪ সালে শিবপুরের কালীপুজোটি কাছেই ‘গহিরা’ গ্রামে চলে যায়। পুজোর খরচ অবশ্য এড়োলের জমিদাররাই দিতেন।

এড়োয়ালীর জমিদাররা অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা বংশপরম্পরায় প্রতি বছর ২১ ভাদ্র মকদুম সাহেবের আস্তানায় গিয়ে ‘পুণ্যাহ’ পালন করতেন। আস্তানার দেখাশোনা এবং পিরস্থানের খরচপত্রের জন্য এড়োয়ালীর জমিদাররা খাদেমদের অনেক পিরোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন।

শ্যামসুন্দরের অকালমৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগাভাগি শুরু হয়। দেবদত্ত ও ইন্দ্রমণি নিজেরা সম্পত্তির পাঁচ আনা করে ভাগ নিয়ে ছয় আনা দেন ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে। এর ফলে এড়োয়ালী গ্রামের প্রধান দুটো অংশের নাম হলো ছয় আনি আর দশ আনি। দশ আনির আবার দুটো ভাগ—বড় পাঁচ আনি আর ছোট পাঁচ আনি। জমিদারির ছয় আনার মালিকদের অংশ ছয় আনি। পাঁচ আনা করে পাওয়া দুই ভাইয়ের বড় ভাইয়ের অংশ হলো বড় পাঁচ আনি আর ছোট তরফের অংশের নাম ছোট পাঁচ আনি।

সম্পত্তি ভাগের সাথে সাথে গৃহদেবতাদেরও ঘরবদল ঘটল। সিংহবাহিনী গেলেন ছয় আনিতে আর গোবিন্দরায় রয়ে গেলেন দশ আনিতে। তবে যেকোনো কারণেই হোক এবার গোবিন্দরায়ের কিছু গুরুত্ববৃদ্ধি ঘটল। এড়োলের তন্ত্রমতে কালীপুজোর আগে গোবিন্দরায়ের অনুমতি নেওয়া চালু হলো।

আগেই বলা হয়েছে, বৌদ্ধতান্ত্রিক বশিষ্ঠদেব তিব্বত থেকে দেবী তারাকে এনে কিরীটেশ্বরী ও দোহালিয়া হয়ে শেষপর্যন্ত তারাপীঠে থিতু হন। অর্থাৎ তারাপীঠের সঙ্গে বৌদ্ধতন্ত্রের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বরাবরই ছিল। তারাপীঠের সঙ্গে রাজা রামজীবন ও এড়োয়ালীর সম্পর্কের কথাও একটু আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু যে-কথাটা বলা হয়নি তা হলো, এড়োয়ালীতে অন্তত তিনজন সিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন—যাঁদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে বামাখ্যাপার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
খুঁজে দেখলে এড়োয়ালীর কালীপুজোতেও বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাব দুর্লভ নয়। এড়োয়ালীর কালীপুজোর ‘মুদ্রায়’/পূজান্তে সেদ্ধ ডিম খেয়ে উপোস ভাঙা হয়, যা চিনাচারের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছাড়া আর কিছু নয়। আবার কালীপুজোর আগে গোবিন্দরায়ের অনুমতি নেওয়া, পৌষ মাসে গোবিন্দরায়ের যুগলমূর্তিকে নিয়ে শীতলদিঘির পাড়ে ‘পৌষাল্যো’ বা রাধাকৃষ্ণের চড়ুইভাতি, বিয়েতে বরের বাড়িতে রং খেলা ইত্যাদির মধ্যে অতীতের বৈষ্ণব ভাবনার প্রভাবও রয়ে গিয়েছে। সব থেকে বড় কথা, এই তন্ত্র ও বৈষ্ণব ভাবনার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে স্মরণকালের মধ্যে কোনো বিরোধের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। [ক্রমশ]

তথ্যসূত্র

১ ‘খড়্গ’, তারাশঙ্কর গল্পগুচ্ছ, সাহিত্য সংসদ্, কলিকাতা, ২০০৮, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৭৬-৭৭


গল্পকার, গবেষক-প্রাবন্ধিক