বাংলায় বহু মন্দির আছে যা শ্রেণিবিভাগ করলে প্রধানত চারটি শৈলীতে বিভক্ত করা যায়—চালা, রত্ন, শিখর ও দালান। প্রত্যেকটিকে আবার উপবিভাগে ভাগ করা যায়। রত্ন মন্দিরের শ্রেণিবিভাগগুলি হলো—একরত্ন, পঞ্চরত্ন, নবরত্ন, ত্রয়োদশরত্ন, সপ্তদশরত্ন, একবিংশতিরত্ন ও পঞ্চবিংশতিরত্ন। এই শ্রেণিবিভাগের মধ্যে আমরা পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন শৈলীর মন্দিরের সঙ্গেই বেশি পরিচিত, যদিও অন্য রত্নমন্দিরও বর্তমান। এর মধ্যে পঞ্চবিংশতিরত্ন বা পঁচিশটি চূড়াবিশিষ্ট মন্দির বাংলার তিনটি জেলায় মোট পাঁচটি আছে। পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনায় আছে তিনটি—লালজীর মন্দির (১৭৩৯), কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির (১৭৫১) ও গোপালজীর মন্দির (১৭৬৬), হুগলির সুখাড়িয়ায় আনন্দভৈরবীর মন্দির (১৮১৩) এবং বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে শ্রীধরের মন্দির (১৮৪৫)। এর থেকে স্পষ্ট, পঁচিশটি চূড়াবিশিষ্ট মন্দির বর্ধমানে প্রথম স্থাপিত হয় ও একই জেলায় বা বলা ভাল, কালনাতেই অল্প দূরত্বের মধ্যে তিনটি এই শৈলীর মন্দির সাতাশ বছরের মধ্যে স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই তিনটি দেবালয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মণ্ডলের (এ. এস. আই., কলকাতা সার্কেল) দ্বারা সংরক্ষিত। আবার আরেক দিক দিয়ে দেখলে এই তিনটি মন্দিরের মধ্যে বেশ সাদৃশ্য আছে—প্রতিটি মন্দির টেরাকোটা অলংকরণে সজ্জিত এবং আরাধ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণ। এর মধ্যে গোপালজীর মন্দিরের গর্ভগৃহে অবস্থান করছেন গোপাল।
অন্যদিকে আর যে দুটি পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দির দুই জেলায় আছে, তার মধ্যে সেরকম সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় না। সুখাড়িয়ায় মন্দিরের আরাধ্যা দেবী হলেন আনন্দময়ী কালী আর সোনামুখীতে শ্রীধরের মন্দিরে অবস্থান করছেন শালগ্রাম শিলা শ্রীধর। শেষোক্ত মন্দিরটি লালজীর মন্দিরের একশো বছরেরও অনেক পরে তৈরি হয়েছে; শুধু তাই নয়, চারটি পঁচিশ চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরের থেকে গঠনশৈলী ও টেরাকোটা শিল্পকলার দিক থেকেও এটি স্বতন্ত্র।
পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দির আবার দুরকমের হয়—সাধারণ ত্রিতল-বিশিষ্ট ও ছোট দ্বিতল-বিশিষ্ট। এদিক দিয়ে বিচার করলে কালনার তিনটি ও সুখাড়িয়ার মন্দির ত্রিতলবিশিষ্ট ও বৃহদাকার এবং সোনামুখীর শ্রীধর মন্দির আকারে ছোট ও দুই তলা উঁচু। এপ্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, পশ্চিম মেদিনীপুরের নাড়াজোলে একটি পঞ্চবিংশতিরত্ন রাসমঞ্চ আছে। রাসমঞ্চ ঠিক মন্দির না হলেও মন্দিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বিশেষ ধরনের স্থাপত্য। রাসের সময় রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহকে এখানে বসানো হয়।
কালনায় বর্ধমান মহারাজাদের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের মধ্যে লালজীর মন্দির সবচেয়ে প্রাচীন। বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের রাজত্বকালে তাঁর মা ব্রজসুন্দরী দেবী এই পঁচিশচূড়াবিশিষ্ট মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের সম্মুখে রয়েছে একটি চারচালা নাটমণ্ডপ ও পশ্চাতে রন্ধনশালা। এখানে নিত্যসেবার সাথে সাথে রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী ও রাসযাত্রা পালিত হয়ে থাকে। এই মন্দিরের তিনটি তলায় মোট পঁচিশটি চূড়া বা রত্ন অবস্থান করছে—প্রথম তলায় ছাদের চারকোণায় তিনটি করে মোট বারোটি চূড়া; দ্বিতীয় তলা তৈরি হয়েেছ বেড় কমিয়ে ও তার ছাদে আটটি কোণায় আটটি চূড়া এবং তৃতীয় তলে বেড় উচ্চতায় কিছু হ্রাস করে চার কোণায় চারটি চূড়া ও মধ্যে অবস্থান করছে কেন্দ্রীয় চূড়াটি। অর্থাৎ চূড়াগুলির বিন্যাস হলো ১২+৮+৪+১। টেরাকোটা অলংকরণে সজ্জিত এই মন্দিরের কোণে ও গায়ে রয়েছে মৃত্যুলতা। টেরাকোটায় স্থান পেয়েছে দেবদেবীর মূর্তি, অশ্বারোহী সৈন্য, শিকারের দৃশ্য ইত্যাদি। এই মন্দিরের বেষ্টিত প্রাঙ্গণে আরো দুটি মন্দির রয়েছে—গিরিগোবর্ধনের মন্দির ও নারায়ণের মন্দির। মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এক উঁচু ভিত্তিবেদির ওপর অবস্থান করছে দক্ষিণমুখী আরেকটি পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দির—সেটি কৃষ্ণচন্দ্রের। বর্ধমানরাজ ত্রিলোকচন্দ্রের মা লক্ষ্মীকুমারী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে কৃষ্ণচন্দ্র ও রাধিকার বিগ্রহ।
১২+৮+৪+১—এইভােব মন্দিরের চূড়াগুলি সাজানো। এখানেও মন্দিরের গায়ে ও কোণে রয়েছে মৃত্যুলতা। মন্দিরের সম্মুখে রয়েেছ অপূর্ব টেরাকোটা অলংকরণে সজ্জিত ত্রিখিলান প্রবেশপথ। বকাসুর বধ, নৌকাবিলাস, সৈন্য, অশ্বমেধযজ্ঞ প্রভৃতি মন্দিরগাত্রে শোভা পাচ্ছে। মন্দিরে নিত্যসেবা হয়। এই মন্দিরের বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে আরো তিনটি দেবালয়—বদরীনারায়ণ, রাধাবল্লভ ও রামসীতার মন্দির।
এই মন্দির থেকে খানিক দূরে কালনায় তৃতীয় পঁচিশ চূড়াবিশিষ্ট মন্দির। রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের রাজত্বকালে এটি নির্মিত। পূর্বমুখী উচ্চবেদির ওপর অবস্থিত দোচালা নাটমন্দিরযুক্ত এই দেবালয়ের অধিষ্ঠিত দেবতা গোপালজী। লালজী ও কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দিরের মতোই এর চূড়াগুিলর বিন্যাস। মন্দির সজ্জিত রয়েেছ অপরূপ টেরাকোটার অলংকরণে, যা সাধারণের নজর কাড়ে। এই মন্দিরে ফ্রেসকোর কাজ দেখা যায়। এখানে নিত্যসেবার সাথে সাথে উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়।
হুগলি জেলার সুখাড়িয়ায় বীরেশ্বর মুস্তাফির নির্মিত পঁচিশ চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন আনন্দময়ী কালী, যিনি একটি কাঠের সিংহাসনে অবস্থান করছেন। এই মন্দিরে চূড়াগুিলর বিন্যাস আগের মতোই। এই মন্দিরে পোড়ামাটির ভাস্কর্যে দেখা যায় বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, পশুপক্ষী, ফুলকারি নকশা ইত্যাদি। অন্যান্য মন্দিরের মতো এই মন্দিরে আছে ত্রিখিলানযুক্ত প্রবেশপথ। চূড়াগুলি আড়াআড়িভাবে খাঁজকাটা। কালনার তিনটি মন্দিরের চেয়ে এখানে অপেক্ষাকৃত কম টেরাকোটার অলংকরণ চোখে পড়ে। এই দক্ষিণমুখী মন্দিরে কোনো নাটমন্দির নেই। মন্দিরের দুদিকে ছয়টি করে মোট বারোটি মন্দির আছে। এর মধ্যে দুটি পঞ্চরত্ন ও বাকি দশটি আটচালা শৈলীর। দ্বাদশ মন্দিরের মধ্যে একটি পঞ্চরত্ন মন্দির গণেশের ও বাকিগুলি শিবের। বারোটি মন্দিরই ছয়টি করে দুটি বেদির ওপর অবস্থান করছে ও মন্দিরে ওঠার জন্য মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি রয়েছে।
শেষ পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দির হলো বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে শ্রীধরের মন্দির। ১৮৪৫ সালে স্থাপিত এই মন্দিরের স্থপতি হলেন হরি সূত্রধর। অন্যান্য পঁচিশ চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরের তুলনায় এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীতে একটি স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। পূর্বে উল্লিখিত চারটি মন্দিরই ত্রিতলবিশিষ্ট, কিন্তু এই মন্দিরে তলার সংখ্যা না বাড়িয়ে মাত্র দুটি তলায় এই মন্দিরের কেন্দ্রীয় চূড়া ছাড়া আরো চব্বিশটি চূড়া বসানো আছে। প্রতি কোণায় তিনটি করে এক-একটি তলায় বারোটি—এইভাবে দুটি তলায় মোট চব্বিশটি চূড়া শোভা পাচ্ছে আর আছে কেন্দ্রীয় চূড়া। এই নিয়ে আছে মোট পঁচিশটি চূড়া, যা দেবালয়টিকে অভিনব করে তুলেছে। চূড়াগুলির বিন্যাস এইরকম—১২+১২+১।
পশ্চিমমুখী এই মন্দির উঁচু ভিত্তিবেদির ওপর অবস্থিত। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েেছন শ্রীধর নারায়ণ। পারিবারিক এই মন্দিরে নিত্যসেবা হয়। দেবালয়ের চারদিকের দেওয়ালে ও বারান্দায় অজস্র পোড়ামাটির ফলকে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি থেকে শুরু করে কৃষ্ণলীলা, পশুপক্ষী, নকশা, এমনকী সমকালীন সামাজিক চিত্রও প্রকাশ পাচ্ছে। এগুলির অনেকাংশ এখনো অক্ষত আছে।
বাংলার মন্দির-স্থাপত্যে এই পাঁচটি পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দির নিশ্চয় এক অভিনব ও শ্রেষ্ঠত্বের ইতিহাস বহন করে।