রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সহাধ্যক্ষ পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী প্রভানন্দজী (বরুণ মহারাজ) গত ১ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে মহাসমাধিতে লীন হন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
পূজ্যপাদ মহারাজজী গত ১১ অক্টোবর ২০২২ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সেবাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে ওখানেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। শরীরত্যাগের বেশ কিছুদিন আগে তাঁর আন্ত্রিক রক্তক্ষরণ হয়। জীবনের শেষপর্বে কিডনি বিকল হওয়ায় কয়েকবার তাঁর ডায়ালিসিস করতে হয়। ক্রমে অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসে।
পূজ্যপাদ মহারাজজীর জন্ম ১৯৩১ সালের ১৭ অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের তিপ্পেরা জেলার আখাউড়া গ্রামে। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে পাঠকালে তিনি স্বামী প্রেমেশানন্দের সংস্পর্শে আসেন এবং সেবাকার্যে অংশগ্রহণ করেন। এরপর কলকাতায় এসে তিনি পাথুরিয়াঘাটায় রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে (ছাত্রাবাসে) থাকার সুযোগে স্বামী লোকেশ্বরানন্দের সান্নিধ্যে আসেন। পূজ্যপাদ মহারাজের প্রেরণায় তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি রামবাগান অঞ্চলে মানবসেবাযজ্ঞে আত্মনিয়োগ করেন। শ্রীমৎ স্বামী শঙ্করানন্দজী মহারাজের মন্ত্রশিষ্য স্বামী প্রভানন্দজী ১৯৫৮ সালে রামকৃষ্ণ সংঘের নরেন্দ্রপুর কেন্দ্রে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালে শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের কাছ থেকে সন্ন্যাসলাভ করেন।
তিনি কিছুকাল নরেন্দ্রপুরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। নরেন্দ্রপুরে থাকাকালীন দুবছর তিনি ‘ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিক্রিয়েশন’ (বর্তমানে লোকশিক্ষা পরিষদ)–এর দায়িত্ব বহন করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে এখান থেকে শুরু হয় রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম ও একমাত্র গ্রামোন্নয়নমূলক মাসিক পত্রিকা সমাজশিক্ষা। তিনি কয়েক বছর রামকৃষ্ণ মিশন সারদাপীঠের অন্তর্গত বিদ্যামন্দির কলেজের অধ্যক্ষতাও করেছেন। কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে সহ-সম্পাদকরূপে তিনি তিনবছর সেবা করেন। পরবর্তিকালে তিনি পুরুলিয়া বিদ্যাপীঠ এবং রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি কেন্দ্রেই গঠনমূলক চিন্তা ও তার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে মহারাজ তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন।
১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে পূজ্যপাদ মহারাজ রামকৃষ্ণ মঠের অছি পরিষদ ও রামকৃষ্ণ মিশনের পরিচালন সমিতির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সাল থেকে দীর্ঘ এগারো বছর তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৭ থেকে পাঁচবছর তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর ২০১২ সালে তিনি সহাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পূজ্যপাদ মহারাজ সারাজীবন যেমন গভীর নিষ্ঠায় শাস্ত্রপাঠ, জপধ্যান ও সংঘসেবার মাধ্যমে সাধুজীবন যাপন করেছেন, তেমনি তিনি নবীন সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীদের এবিষয়ে অনুপ্রাণিত করতেন, যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। তাঁর অভিভাবকসুলভ স্নেহপূর্ণ ও নীতিনিষ্ঠ ব্যবহারে সকলে
মুগ্ধ হতো।
ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় পূজ্যপাদ মহারাজ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা বইগুলির মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা (দুই খণ্ডে), ব্রহ্মানন্দ চরিত, সারদানন্দ চরিত ও রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা। শেষোক্ত গ্রন্থটি প্রথমে ধারাবাহিকভাবে উদ্বোধন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বস্তুত, দীর্ঘকাল যাবৎ বহু গবেষণামূলক ও ভাবপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা উপহার দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন এই পত্রিকাকে। ইংরেজি ভাষায় তাঁর লেখা First Meetings with Sri Ramakrishna এবং Early History of Ramakrishna Movement গ্রন্থদুটি সুপ্রসিদ্ধ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সুবক্তা মহারাজজী বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর সুচিন্তিত বক্তৃতাবলি তাঁর মেধা ও পাণ্ডিত্যের সাক্ষ্য বহন করে।
বেলুড় মঠে অবস্থিত রামকৃষ্ণ সংগ্রহ-মন্দিরে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বহু মূল্যবান দ্রব্য ও নথিপত্র সংরক্ষিত রয়েছে। এটি স্বামী প্রভানন্দজীর একক প্রচেষ্টা ও দীর্ঘকালীন শ্রমের নিদর্শন।
সহ-সংঘাধ্যক্ষরূপে পূজ্যপাদ মহারাজ ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ ও নেপালের বিভিন্ন কেন্দ্রে মোট ৪০,৪০৯ জন অধ্যাত্মপিপাসু মানুষকে মন্ত্রদীক্ষা প্রদান করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে গিয়ে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারা ও বেদান্তের প্রচার ও প্রসার করেন।
স্বামী প্রভানন্দজীর জ্ঞানস্পৃহা ও গবেষণাকর্ম সর্বজনবিদিত। তাঁর অসাধারণ মেধা, পাণ্ডিত্য, সেবাপরায়ণতা ও ত্যাগ-তপস্যাপূত জীবনের জন্য তিনি বহুমানিত। সর্বোপরি সংঘসেবায় তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর মহাপ্রয়াণে রামকৃষ্ণ সংঘের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো।