অরণ্যের গভীরে হারিয়ে গেল মৃগ। তপস্বী ব্রাহ্মণের পক্ষে মৃগ অন্বেষণ একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু দুরন্ত মৃগের বাঁকানো শিঙের মধ্যে বেকায়দায় ঝুলে আছে ঋষির অরণি আর মন্থ। তখন অগ্নির স্ফুলিঙ্গ লাভের জন্য বেশ পরিশ্রমের প্রয়োজন হতো। কাষ্ঠনির্মিত অরণি আর তার ওপর কাঠের তৈরি দণ্ড মন্থের পরস্পরের তীব্র ঘর্ষণজনিত তাপ থেকে বেরিয়ে আসত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তপস্বীর আশ্রম-প্রাঙ্গণে সর্বদা প্রজ্বলিত থাকত অগ্নিকুণ্ড। যার যখন প্রয়োজন হতো, অগ্নি গ্রহণ করত সেই কুণ্ড থেকেই। তাই কষ্টে অর্জিত অগ্নির তখন ছিল ভিন্ন আদর। আর সেই অগ্নি প্রজ্বলনের মাধ্যম যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তবে তা চিন্তার বিষয় বইকি! কারণ, অগ্নি প্রজ্বলন করতে না পারলে তার অবশ্যকর্তব্য অগ্নিহোত্র লোপ পাবে।


অরণি ও মন্থকে উদ্ধারের জন্য ব্রাহ্মণ দ্রুত উপস্থিত হলেন পাণ্ডবদের কাছে। দীর্ঘ বারোবছরের বনবাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এরপর অজ্ঞাতবাসের দিনগুলো কোথায় অতিবাহিত হবে তা নিয়ে চিন্তিত দ্রৌপদী-সহ অন্য পাণ্ডবেরা। কাম্যকবনে বসবাসের পাট চুকিয়ে তাঁরা উপস্থিত হয়েছেন দ্বৈতবনের মধ্যে। দিনের প্রথম প্রহরে পাঁচ ভাই আহার অন্বেষণ করতে বের হবেন, এমন সময় কুটিরদ্বারে উপস্থিত সেই ব্রাহ্মণ। মৃগটিকে ধরে, খঁুজে এনে দিতে হবে অরণি ও মন্থ। ঐ দেখা যায় মৃগ ছুটে চলেছে গভীর অরণ্যের দিকে। ব্রাহ্মণের কথা শুনে একছুটে কুটির থেকে নির্গত হলেন পঞ্চপাণ্ডব। অঙ্গে কবচ বাঁধতে যেটুকু সময় লাগে। পাঁচজন একসঙ্গে ছুটে চলেন মৃগের পিছনে। বনের মধ্যে কেউ যদি পাণ্ডবদের কাছে কোনো সাহায্য ভিক্ষা করে, তত্‌ক্ষণাত্‌ তাকে সাহায্য করাই তাঁদের ধর্ম। আর একটি মৃগ ধরে দেওয়া কী এমন ব্যাপার! পঞ্চপাণ্ডব মৃগের পিছে পিছে ছুটে চলেন, অবশেষে প্রবেশ করেন দ্বৈতবনের গভীরে।


বন গভীর থেকে গভীরতর হয়, কিন্তু মৃগ যেন মায়াময়, ধরি ধরি করেও তাকে ধরা যায় না! একসময় তা চোখের বাইরে চলে যায়। পঞ্চপাণ্ডব হতাশ হয়ে বসে পড়েন, এরকম তো আগে কখনো হয়নি! তবে আজ ঋষির অরণি সংগ্রহে ব্যর্থ হলেন কেন? সকলে একটি মৃগের পিছনে ছুটেই বা এত ক্লান্ত হলেন কী করে? পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকান। বেশ আশ্চর্য লাগে তাঁদের। যুধিষ্ঠির বলেন—আমরা সকলেই খুব তৃষ্ণার্ত! নকুল, তুমি গাছে উঠে দেখ তো কোনো পানীয় জল বা জলজ উদ্ভিদের দেখা পাও কি না! যুধিষ্ঠিরের কাছে আদেশ পাওয়া মাত্রই নকুল দ্রুত তরতর করে বটবৃক্ষের ডগায় উপস্থিত হলেন। আনন্দে চিত্‌কার করে ওঠেন নকুল—এখানে প্রচুর জলচর পাখি বিচরণ করছে, সারস পাখির রবও কানে আসছে। জলজ শ্যাওলা সামান্য কিছু দূরের গাছগুলোর গায়েও আশ্রয় নিয়েছে। অর্থাত্‌ আমাদের থেকে কয়েক পা অগ্রসর হলেই বিরাট জলাশয়!—বেশ, তুমি সেখানে যাও! তূণে করে জল সংগ্রহ করে নিয়ে এস। নকুল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশমতো জলাশয়ের দিকে অগ্রসর হলেন। কিছুক্ষণ পরই পায়ের তলার মাটি জলে ভেজা মনে হলো, বনজ বৃক্ষ অতিক্রম করতেই চতুর্থ পাণ্ডব নকুলের সম্মুখে উপস্থিত হলো বিরাট জলাশয়! তার টলটলে জল দেখে তৃষ্ণার্ত নকুলের তৃষ্ণা আরো বৃদ্ধি পেল। তিনি তরতর করে, বনজ ঘাসের দল পায়ে দলে উপস্থিত হলেন দীঘির কিনারায়! জল পান করতে যাবেন, এমন সময় শুনলেন আকাশ থেকে কে যেন বলে উঠলেন—দাঁড়াও, এই জল অনেক আগে থেকে আমার অধিকারে, সুতরাং এই জল পান করার সাহস করো না। তবে মাদ্রীনন্দন, আমার কিছু প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর দিয়ে জল পান করতে পার। নকুল একথাগুলি শুনলেন বটে, কিন্তু তিনি অত্যন্ত পিপাসার্ত ছিলেন, তাই ভাবলেন—আগে জল পান করি তারপর দেখা যাবে। সুতরাং দ্রুত জল পান করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ধরাশায়ী হলেন।


বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো। নকুলকে ফিরে আসতে না দেখে যুধিষ্ঠির এবার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সহদেবকে পাঠালেন। দীঘির কাছে যেতেই সহদেবের চোখে পড়ল প্রাণহীন নকুলের দেহ। তিনি সন্তপ্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু এত তৃষ্ণা যে, ভ্রাতার মৃতদেহ রেখেই একছুটে জলের দিকে ধাবিত হলেন এবং সেই আকাশবাণী শুনলেন—প্রশ্নের উত্তর দাও এবং জল গ্রহণ কর। সহদেবও সেকথা না শুনে জল পান করলেন এবং ভূতলে শায়িত হলেন। সময় আরো অতিক্রান্ত হলো, যুধিষ্ঠির এবার অর্জুনকে ডেকে বললেন—হে শত্রুদমন বীভত্‌সু, তোমার ভাইরা অনেকক্ষণ হলো জল আনতে গিয়েছে। তুমি দেখ তো তারা কোথায় গেল! অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আদেশে উপস্থিত হলেন জলাশয়ের পাড়ে, কিন্তু এ কী! প্রাণপ্রিয় নকুল ও সহদেবের নিশ্চল প্রাণহীন দেহ! কে তাদের বধ করার সাহস করল? যুধিষ্ঠিরের আদেশে অর্জুন ধনুর্বাণ নিয়ে জল আনতে এসেছিলেন। তাই তিনি ধনুঃসংযোগ করে চারিদিক অবলোকন করতে লাগলেন। কিন্তু কাউকে না দেখতে পেয়ে জলের দিকেই ধাবিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে আকাশবাণী শুনলেন—কুন্তীনন্দন, তুমি জলের দিকে ধাবিত হলে কেন? বলপূর্বক তুমি এই জলগ্রহণ করতে পারবে না। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তারপর জলগ্রহণ কর। অর্জুন রাগতভাবে বলে উঠলেন—আড়ালে থেকে কথা বলছ কেন? দৃষ্টিগোচর হও! তাহলে আমার বাণের আঘাতে নিষেধ করার ভাষাও ভুলে যাবে! অর্জুন এই বলে সমস্ত আকাশ কর্ণী, নালীক, নারাচ ইত্যাদি শব্দভেদী বাণে বাণে আচ্ছাদিত করে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার আকাশবাণী ভেসে এল—অর্জুন! আমাকে বধ করে তোমার কী লাভ? আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জল পান কর, নইলে তুমিও মরবে। অর্জুন এই অগোচর বাণীকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন এবং জলাশয় থেকে জল পান করেই ভূতলে পতিত হলেন।


অর্জুনের বিলম্ব দেখে বেশ বিস্মিত হলেন যুধিষ্ঠির। ভীমকে বললেন—হে ভরতনন্দন পরন্তপ, দেখ তো ঘটনাটি কী? তোমার কোনো ভাই এখনো জল নিয়ে ফিরল না কেন? ভীম আদেশমাত্র জলাশয়ের দিকে রওনা হলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে বিশাল দীঘি এবং তার পাশে তিন ভাইয়ের মৃতদেহ দেখে চিত্‌কার করে উঠলেন—এ নিশ্চয়ই কোনো যক্ষ বা রাক্ষসের কাজ। আজ আমাকে যুদ্ধ করতে হবে! বেশ, আগে জল পান করি তারপর যুদ্ধ করব।—এই বলে ভীম যেই জল পান করতে গেলেন অমনি একই আকাশবাণী লাভ করলেন এবং সেই নিষেধ অমান্য করে জল পান করতেই তিনিও নিহত হলেন।


চিন্তিত হলেন যুধিষ্ঠির। কোনো ভ্রাতাই জল নিয়ে ফিরে এল না! এমন তো হওয়ার কথা নয়। এবার তিনি স্বয়ং সরোবরের দিকে অগ্রসর হলেন। জনশব্দশূন্য মহাবনে কিছুদূর অগ্রসর হতেই যুধিষ্ঠির স্বর্ণপদ্মশোভিত অপূর্ব সুন্দর সরোবরের দেখা পেলেন। যুধিষ্ঠিরের মনে হলো, এই সরোবর কী স্বর্গের কারিগর বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেছেন? জলে সোনার বরণ পদ্ম ভাসছে! চারিদিকে বেত, কেতকী, করবী ফুলের সমাহার! বড় অশ্বত্থ বৃক্ষে সরোবরের তীর আচ্ছাদিত। বেশিক্ষণ সেই সুখসৃষ্টিকারী দৃশ্য দেখার সুযোগ পেলেন না যুধিষ্ঠির; যেই মাত্র সরোবরের তীরে ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেবের প্রাণহীন দেহ নিস্পন্দভাবে পড়ে থাকতে দেখলেন সেইমাত্র যুধিষ্ঠির শোকে বিহ্বল হলেন। এ যেন প্রলয়কালে স্থানচ্যুত লোকপালগণ অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে পড়ে রয়েছেন! কে এদের মতো বীরদের হত্যা করল? এদের উদ্দেশে কত মুনি, ঋষি, দেবতা কত ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন! সেই ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে এরা হত হলো কীভাবে? যুধিষ্ঠির মৃত ভ্রাতাদের উদ্দেশে বলতে লাগলেন—তোমরা শাস্ত্রজ্ঞ, দেশকালজ্ঞ, তপস্বী ছিলে; তবে তোমরা ভূতলশায়ী হলে কীভাবে? যুধিষ্ঠিরের মনে নানা চিন্তার তরঙ্গ—এদের দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, চারিদিকে কারোর পায়ের ছাপও দেখা যাচ্ছে না; তবে কে এদের মৃত্যুর কারণ? দুর্যোধন কি গুপ্তহত্যার মাধ্যমে ভ্রাতাদের বধ করাল? হয়তো বক্রবুদ্ধি শকুনি মামা সেই মন্ত্রণাই দিয়েছেন। আগে জল পান করি তারপর এর বিচার করব। এই ভেবে যুধিষ্ঠির জল পানের উদ্দেশে সরোবরের তীরে উপস্থিত হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আকাশবাণী শুনলেন—আমি শৈবাল ও মত্‌স্যভোজী বক! আমিই তোমার ভাইদের বধ করেছি। কারণ, তারা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জল পান করেছিল। তুমি যদি উত্তর না দাও, তোমারও অবস্থা এইরকমই হবে। এই জল আমার, তাই সাহস করো না!


যুধিষ্ঠির একথা শুনে অবাক হয়ে বললেন—হে অদৃশ্যচারী! আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনি রুদ্র, বসু বা মরুদ্‌গণের মধ্যে কোন প্রধান দেবতা? না হলে একটা পক্ষী আমার বীর ভাইদের হত্যা করতে পারে না। কোন মহাতেজা আপনি? যিনি আজ হিমালয়, পারিপাত্র, বিন্ধ্য, ও মলয়—এই চার বিরাট পর্বতের মতো চার ভাইকে ধরাশায়ী করেছেন? দেবগণ, গন্ধর্বগণ, অসুরগণ এবং রাক্ষসগণও মহাযুদ্ধে যাদের সহ্য করতে পারেন না, আপনি তাদেরই বধ করেছেন? একটি পক্ষী হয়ে? আমি ভাবতে পারছি না! আচ্ছা, আপনি কি এখানেই রয়েছেন? যদি থাকেন আমাকে দর্শন দিন। যুধিষ্ঠিরের এই কথা শুনে উত্তর এল—তোমার মঙ্গল হোক যুধিষ্ঠির! আমি যক্ষ, জলচর পক্ষী নই! আমিই তোমার মহাবল ভাইদের বধ করেছি! যুধিষ্ঠির কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলেন—তালবৃক্ষের মতো উঁচু, বিকৃত নয়ন, অগ্নি ও সূর্যের মতো তেজস্বী এবং পর্বতের মতো বিশালদেহী যক্ষ একটি বৃক্ষকে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি দুঃখিত যুধিষ্ঠিরকে বললেন—রাজা! আমি তাদের বারংবার নিষেধ করেছিলাম, জল পানের আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছিলাম; তবু তারা আমাকে অগ্রাহ্য করে জল পান করেছে। কোনো জীবিত মানুষ আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জল পান করতে পারে না!


যক্ষ! এই জলাশয় যখন আপনার অধীনে তখন আমি বলপূর্বক একে ব্যবহার করতে চাই না। সত্‌পুরুষেরা কোনোপ্রকারেই আত্মপ্রশংসা পছন্দ করেন না। আপনি প্রশ্ন করুন, আমি নিজের বুদ্ধি অনুসারে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করব।—যুধিষ্ঠির বললেন।


যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে বকরূপী যক্ষ তাঁকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। সৃষ্টি হলো বক-যুধিষ্ঠির সংবাদ। পরস্পরের এই বাক্যালাপ জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান দান করে। কখনো জগৎসৃষ্টি সম্বন্ধে, কখনো বা জীবন সম্বন্ধে এই প্রশ্নাবলির পরিধি বিস্তৃত।


যক্ষের প্রশ্ন—কে সূর্যকে ওপরে রেখেছে? কারা সূর্যের চারপাশে বিচরণ করে? কে সূর্যকে অস্তে প্রেরণ করে? এবং তখন কোথায় সূর্য অবস্থান করেন?
—ব্রহ্মই আদিত্যকে উদিত করান, দেবগণই এঁর পার্শ্বচর, ধর্মই এঁকে অস্তগমন করান এবং সত্যেই ইনি প্রতিষ্ঠিত।


যক্ষের প্রশ্ন হলো—ব্রাহ্মণ কোন গুণে শ্রোত্রিয় হন? মানুষ কীভাবে ব্রহ্মলাভ করে? লোক একাকী থেকেও কী করে সহায়শালী হয়? আর কোন উপায়ে নির্বোধ মানুষও বুদ্ধিমান হয়?


—ব্রাহ্মণ শাস্ত্রজ্ঞানের মাধ্যমে শ্রোত্রিয় হন। ব্রহ্মলাভ হয় তপস্যার মাধ্যমে। যার ধৈর্যগুণ আছে সে একাকী হলেও সহায় লাভ করে। বৃদ্ধের উপদেশ শুনে চললে নির্বোধ মানুষও বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে।


যক্ষের প্রশ্ন—ব্রাহ্মণদের দেবত্বের কারণ কী? তাঁদের কোন ধর্ম সাধুদের মতো? ব্রাহ্মণদের মানুষভাব কী? এবং তাঁদের দুর্জনতুল্য আচরণই বা কী?


—বেদ-অধ্যয়নই ব্রাহ্মণদের দেবত্বের কারণ। সাধুদের মতো তপস্যা হলো ব্রাহ্মণদের প্রধান ধর্ম। মরণ তাঁদের মানুষভাব এবং পরনিন্দা হলো ব্রাহ্মণদের দুর্জনতুল্য আচরণ।


যক্ষের প্রশ্ন—ক্ষত্রিয়ের দেবত্বের কারণ কী? তাঁদের কোন ধর্ম সাধুদের মতো? ক্ষত্রিয়দের মানুষভাব কী? এবং তাঁদের দুর্জনতুল্য আচরণই বা কী?


—অস্ত্রনৈপুণ্যই ক্ষত্রিয়দের দেবত্বের প্রধান কারণ। সাধুদের মতো যজ্ঞ করাই তাঁদের প্রধান ধর্ম। ভয় হলো তাঁদের মানুষভাব এবং শরণাগতকে ত্যাগ তাঁদের পক্ষে দুর্জনের তুল্য আচরণ।


যক্ষের প্রশ্ন—যজ্ঞের প্রধান সাম কী? যজ্ঞের প্রধান যজু কী? কোন বস্তু যজ্ঞে অধিক প্রয়োজনীয়? যজ্ঞ কোন বস্তুকে অতিক্রম করে না?


—প্রাণ হলো জ্ঞানযজ্ঞের সাম, মন জ্ঞানযজ্ঞের যজু, মন্ত্র যজ্ঞে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু, আর যজ্ঞ কখনো মন্ত্রকে অতিক্রম করে না।


যক্ষের প্রশ্ন—যাঁরা দেবতাদের দান করতে চান, তাঁদের পক্ষে উত্কৃষ্ট জিনিস কী? আবার যাঁরা পিতৃলোককে দান করতে চান, তাঁদের পক্ষে শ্রেষ্ঠ জিনিস কী? যাঁরা লোকসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেন, তাঁদের পক্ষে শ্রেষ্ঠ কী? সন্তান উত্পন্ন করেন যাঁরা তাঁদের জন্য শ্রেষ্ঠ কোনটি?


—যাঁরা দেবতাকে দান করতে চান তাঁদের পক্ষে বৃষ্টিই প্রধান। যাঁরা পিতৃলোককে দান করেন, তাঁদের পক্ষে শুক্রই প্রধান, যাঁরা লোকসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেন, তাঁদের পক্ষে ধেনু শ্রেষ্ঠ। যাঁরা সন্তানকামী তাঁদের পক্ষে পুত্রই শ্রেষ্ঠ।


যক্ষের প্রশ্ন : এমন কে আছেন যিনি লোকসমাজে সম্মানিত, স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করলেও জীবিত থাকেন না?


—দেবতা, অতিথি, পোষ্যবর্গ, পিতৃলোক ও আত্মা—এই পাঁচ শ্রেণিকে যে-ব্যক্তি যথাযথ দান করেন না তাঁদের ইন্দ্রিয় স্বাভাবিকভাবে কাজ করলেও তাঁরা জীবিত নন।


যক্ষের প্রশ্ন—কে পৃথিবীর থেকে গুরুতর? কে আকাশের থেকে উচ্চতর? কে বায়ুর থেকেও দ্রুততর? এবং কারা তৃণের থেকেও সংখ্যায় অধিক?


—জননী পৃথিবীর থেকেও গুরুতর, পিতা আকাশের থেকেও উচ্চতর, মন বায়ুর থেকে দ্রুততর এবং চিন্তা তৃণের থেকেও সংখ্যায় অধিক।


যক্ষের প্রশ্ন—কোন প্রাণী নিদ্রিত হয়েও নয়ন মুদ্রিত করে না? কোন প্রাণী জন্মগ্রহণ করে স্পন্দিত হয় না? কার হৃদয় নেই? এবং কোন পদার্থ বেগের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়?


—মাছ নিদ্রিত হলেও চোখ বোজে না। ডিম জন্মের পর স্পন্দিত হয় না। পাথরের হৃদয় নেই। নদী বেগবান হয়ে বৃদ্ধি পায়।


যক্ষের প্রশ্ন—বিদেশগামীর মিত্র কে? গৃহস্থের মিত্র কে? রোগীর মিত্র কে? এবং আসন্নমৃত্যু লোকেরই বা মিত্র কে?


—বিদেশগামীর মিত্র সহচর বা সঙ্গী। গৃহস্থের মিত্র স্ত্রী। রোগীর মিত্র চিকিত্সক আর আসন্নমৃত্যু লোকের মিত্র দান।


যক্ষের প্রশ্ন—রাজশ্রেষ্ঠ! সমস্ত লোকের অতিথি কে? সনাতন ধর্ম কী? অমৃত কী? এবং এই জগত্ কোন বস্তুময়?


—অগ্নি সমস্ত লোকের অতিথি, সত্যধর্মই সনাতন ধর্ম, সোমরস আর গোদুগ্ধই অমৃত এবং সমগ্র জগৎই হলো বায়ুময়।


যক্ষের প্রশ্ন—কে একাকী বিচরণ করে? কে দুবার জন্মগ্রহণ করে? হিমের ওষুধ কী? এবং বিশাল ক্ষেত্র কী?


—সূর্য একাকী বিচরণ করেন, চন্দ্র একবার জন্মগ্রহণ করে আবার জন্মান, অগ্নি হিমের ওষুধ আর বিশাল ক্ষেত্র হলো পৃথিবী।


যক্ষের প্রশ্ন—ধর্মের একমাত্র কারণ কী? যশের একমাত্র কারণ কী? স্বর্গের একমাত্র কারণ কী? এবং সুখেরই বা একমাত্র কারণ কী?


—ধর্মের একমাত্র কারণ যজ্ঞাদির নৈপুণ্য। যশের একমাত্র কারণ দান। স্বর্গের একমাত্র কারণ সত্য। আর সুখের একমাত্র কারণ সচ্চরিত্র।


যক্ষের প্রশ্ন—মানুষের বহির্ভূত আত্মা কী? তার দৈবকৃত সখা কে? তার জীবিকানির্বাহের উপায় কী? মানুষের প্রধান আশ্রয় কী?


—মানুষের বহির্ভূত আত্মা পুত্র, দৈবকৃত সখা স্ত্রী, জীবিকানির্বাহের উপায় মেঘ, প্রধান আশ্রয়—দান।


যক্ষের প্রশ্ন—ধন্য লোকদের কোন গুণ শ্রেষ্ঠ, ধনের মধ্যে কোন ধন শ্রেষ্ঠ? লাভের মধ্যে কোন লাভ প্রধান? এবং সুখের মধ্যে কোন সুখ উত্তম?


—যারা ধন্য তাদের মধ্যে কার্যদক্ষতাই উত্কৃষ্ট গুণ। ধনের মধ্যে শাস্ত্রজ্ঞান শ্রেষ্ঠ ধন, লাভের মধ্যে আরোগ্য প্রধান লাভ এবং সুখের মধ্যে সন্তোষ সবথেকে উত্কৃষ্ট সুখ।


যক্ষের প্রশ্ন—জগতে কোন ধর্ম প্রধান? কোন ধর্ম সর্বদা ফল উত্পন্ন করে? কোন বস্তু সংযত করলে মানুষ শোক পায় না? এবং কাদের সঙ্গে সন্ধি কখনো নষ্ট হয় না?


—দয়াই প্রধান ধর্ম, বেদোক্ত ধর্মই সর্বদা ফল উত্পাদন করে, মনকে সংযত করলে জীব শোক পায় না। আর সজ্জনের সঙ্গে সন্ধি করলে সেই সন্ধি বিনষ্ট হয় না।


যক্ষের প্রশ্ন—মানুষ কী পরিত্যাগ করলে লোকের প্রিয় হয়? কী পরিত্যাগ করে চিত্তসন্তাপ ভোগ করে না? কী পরিত্যাগ করে ধনী হয়? এবং কী পরিত্যাগ করে সুখী হয়?


—মানুষ গর্ব পরিত্যাগ করলে লোকের প্রিয় হয়, ক্রোধ পরিত্যাগ করলে চিত্তসন্তাপ ভোগ করে না, আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করলে ধনী হয় আর লোভ পরিত্যাগ করলে সুখী হয়।


যক্ষের প্রশ্ন—কী জন্য ব্রাহ্মণকে দান করা হয়? কী জন্য নট ও নর্তককে দেওয়া হয়? কী উদ্দেশ্যে পোষ্যবর্গকে বিতরণ করা হয়? এবং কী জন্যই বা রাজগণকে বা তাঁদের প্রধান পুরুষদিগকে দান করা হয়?


—ধর্মের জন্য ব্রাহ্মণকে দান করা হয়, যশের জন্য নট বা নর্তককে দেওয়া হয়, ভরণপোষণের জন্য পোষ্যদের দান করা হয়, আর ভয়নিবৃত্তির জন্য রাজগণ ও রাজার প্রধান পুরুষদের দান করা হয়।


যক্ষের প্রশ্ন—কে সমস্ত লোককে আবৃত করে রেখেছে? কী জন্য লোকের প্রকৃত স্বভাব প্রকাশ পায় না? মানুষ কী দোষে মিত্র ত্যাগ করে এবং কী দোষেই বা স্বর্গে যেতে পারে না?


—অজ্ঞানই সমস্ত লোককে আবৃত করে রেখেছে, তমোগুণের জন্য জীবের স্বরূপ প্রকাশ পায় না, মানুষ লোভবশতই মিত্রকে ত্যাগ করে। সঙ্গদোষে স্বর্গে যেতে পারে না।


যক্ষের প্রশ্ন—মানুষ জীবিত থেকেও কেন মৃতের মতো থাকে? রাজ্য ঠিক থেকেও কেন মৃততুল্য হয়ে পড়ে? শ্রাদ্ধ সাঙ্গ হলেও তা মৃতের তুষ্টিদান করে না কেন? আবার যজ্ঞ সুসম্পন্ন হয়েও তা ফলদান না করার কারণ কী?


—মানুষ জীবিত থেকেও দরিদ্রতাবশত মৃতের মতো থাকে, রাজ্যে অরাজকতা এলে তা মৃততুল্য হয়ে যায়, শ্রাদ্ধকাজ পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণ ছাড়া পালন করলে তা মৃতের তুষ্টিদান করে না। যজ্ঞ সুসম্পন্ন হলেও যথাযথ দক্ষিণার অভাবে তা ফলদানে অসমর্থ হয়।


যক্ষের প্রশ্ন—দিক কী? জল কী? অন্ন কী? বিষ কী? এবং শ্রাদ্ধের কাল কী? এগুলো বলে জল পান করতে পার রাজশ্রেষ্ঠ!


—সাধুজনই দিক, আকাশই জল, গরুই অন্নসংগ্রহ-কারক, কারো কাছে কিছু চাওয়াটাই বিষতুল্য। পঙ্‌ক্তিপাবন ব্রাহ্মণ প্রাপ্তিকালই শ্রাদ্ধের কাল। যক্ষ, আপনি কি এটি সঠিক মনে করেন না?


যক্ষের প্রশ্ন—বার্তা কী? আশ্চর্য কী? পথ কী? এবং সুখী কে? এই চারটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জল পান কর।


—স্বয়ং মহাকাল সূর্যরূপ অগ্নি, দিন আর রাত-রূপ কাঠের মাধ্যমে এবং মাস ও ঋতু-রূপ হাতা দিয়ে মায়ামোহের বিরাট কড়াইতে প্রাণীদের নিক্ষেপ করে তাদের পাক করছেন। এই হলো বার্তা।


প্রাণীরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন যমালয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যে জীবিত সে ভাবছে—আমি কোনোদিন যমালয়ে যাব না। এর থেকে আশ্চর্য আর কী?


বেদ বিভিন্ন, স্মৃতি ভিন্ন ভিন্ন, প্রতিটি মুনির মত ভিন্ন; কিন্তু ধর্মের তত্ত্ব অজ্ঞেয় স্থানে, গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে আছে। সুতরাং মহাপুরুষ যে-পথে গমন করেছেন সেই পথই অনুসরণীয়।


আর হে বক! যে-লোক অঋণী হয়ে স্বদেশে বাস করে, সে দিনের শেষভাগে শাকভাত খেলেও সর্বাধিক সুখী। সে-ই সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ ও আমোদ অনুভব করে।


যক্ষ আবার প্রশ্ন করলেন—শ্রেষ্ঠ পুরুষ এবং যিনি সকল ধনের অধীশ্বর, তিনি কে ও কীরকম? যুধিষ্ঠির জানালেন—যে-পুরুষের পুণ্যকীর্তির কথা যতদিন স্বর্গ ও পৃথিবীতে প্রচারিত থাকে, ততদিন সেই পুরুষ পুরুষপদবাচ্য। আর যার কাছে প্রিয়-অপ্রিয়, সুখ–দুঃখ এবং ভূত-ভবিষ্যৎ—এই দুই-ই সমান তিনিই সকল ধনের অধীশ্বর।


যক্ষ এবার তুষ্ট—রাজা, তুমি পুরুষের বিষয়ে এবং সকল ধনের অধীশ্বর সম্বন্ধে কথা বলেছ, আমি খুশি। তুমি তোমার চার ভাইয়ের মধ্যে কোনো একজনের জীবনভিক্ষা করতে পার।


—মাদ্রীপুত্র নকুল জীবিত হোক!
—কিন্তু ভীম তোমার সব থেকে প্রিয়, আর অর্জুন তোমাদের সকলের প্রধান অবলম্বন, তাহলে বিমাতা পুত্র নকুলকেই কেন জীবিত চাইছ রাজা?
—আমি চাই আমার দুই মাতাই পুত্রবতী থাকুন।
—ভরতশ্রেষ্ঠ, তুমি অনিষ্ঠুরতার কথা বলেছ। তাই তোমার সব ভাই জীবিত হোক।


সেই বিশাল দীঘির তীরে চার ভাই জাগ্রত হলেন। এবার যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন—একপায়ে বিশাল দেহ নিয়ে আপনি কে এই সরোবরের তীরে দাঁড়িয়ে আছেন? আমার এই ভাইদের লক্ষ যোদ্ধা পরাজিত করতে অক্ষম, তাদের আপনি নিহত করলেন আবার প্রাণদান করলেন! আমি আপনাকে যক্ষ বলে মনে করতে পারছি না। আপনি আমাদের সুহৃদ বা পিতৃতুল্য কেউ হবেন।


উত্তর আসে—হে বীর, আমি তোমার পিতা স্বয়ং সনাতন ধর্ম। যশ, সত্য, দম, শৌচ, সরলতা, লজ্জা, অচাঞ্চল্য, দান, তপস্যা ও ব্রহ্মচর্য—এই দশটি আমার মূর্তি। অহিংসা, সমতা, শান্তি, তপস্যা, পবিত্রতা ও বিদ্বেষ না করা—এই ছয়টি আমাকে প্রাপ্তির দ্বার জানবে। আমার পুত্ররূপে তুমি সর্বদা এইগুলি অবলম্বন করে আমার এত প্রিয় হয়েছ।


যুধিষ্ঠির আনত হন। যক্ষরূপী ধর্ম সন্তুষ্ট হয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বর চাইতে বললেন। ধর্মরাজ প্রথম বরেই চাইলেন—যেন সেই অগ্নিহোত্র লোপের শঙ্কায় শঙ্কিত ব্রাহ্মণ অরণি আর মন্থ পুনরায় লাভ করে অগ্নিহোত্রের লোপ থেকে রক্ষা পান। সন্তুষ্ট ধর্ম জানান, তিনিই যুধিষ্ঠিরকে পরীক্ষা করার প্রয়োজনে সরোবরের তীরে নিয়ে আসার জন্য স্বয়ং হরিণ-বেশে ব্রাহ্মণের সেইসব সামগ্রী হরণ করেছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাঁর সেবিষয়ে আর কোনো চিন্তা নিষ্প্রয়োজন।


সম্মুখেই অজ্ঞাতবাসের কাল, যক্ষরূপী ধর্ম পঞ্চপাণ্ডবকে বিরাটরাজ্যে অজ্ঞাতবাস করার পরামর্শ দিয়ে বরদান করেন—যদিও তোমরা নিজেদের রূপেই বিচরণ করবে তবু কেউ তোমাদের চিনতে পারবে না।` এই বর অজ্ঞাতবাসকালে পাণ্ডবদের কীভাবে রক্ষা করেছিল তা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

সহায়ক গ্রন্থ
১. মহাভারতম্, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ কর্তৃক বঙ্গানুবাদিত। বনপর্ব, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা, ১১ খণ্ড, পৃঃ ২৫৩৫—২৫৮৭

অধ্যাপিকা, গবেষণা বিভাগ,
রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার