[পূর্বানুবৃত্তি : চৈত্র ১৪২৯ সংখ্যার পর]

।।২।।

মার এক আত্মীয় ছেলেকে এবং আমাকে ললিতবাবু বাগবাজারস্থ ৫৩/২ বসুপাড়া লেনের বাসাবাড়িতে একদিন দিবাভোজে আমন্ত্রণ দেন। ললিতবাবু পূর্বে প্রমোদের স্রোতে ভেসে গিয়ে প্রায় বানচাল হয়েই যেতেন, মা তাঁকে অনন্ত অপার দয়ায় রামকৃষ্ণতীরস্থ করেন। তিনি আট-নয়টি সন্তানের জনক। সব কয়টিকে একে একে যমকরে অর্পণ করে একরকম বেহেড হওয়ার উপক্রম! মাকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দম্পতি কূল পান। ললিতপত্নীর দাসীনাম, মার দাসী হয়ে সার্থক। জ্বরের আগার জয়রামবাটীতে দাতব্য ডাক্তারখানা স্থাপনের জন্য শোকগ্রস্ত ভগ্নতনুমন ললিত আবার মনকে মার পায়ে জোড়া লাগিয়ে অশেষ শ্রম করতে শুরু করলেন। অন্য মানুষ হলেন—ভক্তমানুষ হলেন। মার প্রতি ললিতের টান আঁকড়ে পাওয়া যেত না। মার স্নেহসিন্ধু তাঁকে দেখলে উথলে উঠত। এটি আমাদের স্বচ‌ক্ষে দেখা। ললিত তাঁর একটি জীবনকথা কতবারই না আমাদের প্রচুর গর্বভরে বলেছেন : “উদ্বোধন বাড়ি হওয়ার বহু আগে আমার শাঁখারিটোলার ভাড়াবাড়িতে গিয়ে মা তাঁর নিজের ‘অয়েল’ ছবিটিতে আমার কথায় নিজে ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করে আমাকে দী‌ক্ষা দেন। আমাকে, কী বলে, যা তা ভাবিস তোরা?”—এই তো ভক্তের আমি। মায়ের ঐ ছবিই ১৯২৩ সালে মার জন্মস্থানে শ্রীমন্দিরে বিগ্রহরূপে শরৎ মহারাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

বোসপাড়ায় ললিতবাবুর বাড়িতে তখন কেউ নেই। গৃহিণীর প্রচণ্ড পরদা। কর্তা না থাকলে আর কে সাড়া দেবে? যা নিয়ে সংসারীর সংসার—গদাধরের ইচ্ছায় সেই একগাদা ছেলের দফা তো গয়া! ঠিকে ঝি কাজ সেরে পিটটান। আমাদের আহ্বান করে ললিতবাবু দোকানে দই-মিষ্টি কিনতে বেরিয়েছেন। সাড়া আর কে বা দেবে? আমার সঙ্গীর মেজাজ সে-আমলে অত্যন্ত রু‌‌ক্ষ ভূতন্ত্রসম্মত। দাপট দেখে কে! দুই-চারবার ডাক দিয়ে ও সদরের কড়া নেড়ে যখন গৃহস্বামীর সাড়া মিলল না, যত বলি : “আরে আর খানিকটা দেখুন, বাজারে হয়তো বেরিয়েছে, কাছে।”—শোনে কে? বাবু বড় গরম।

মিলিটারি মানুষ। আমাকে হাত ধরে টেনে উদ্বোধনে চলে এল। বেলা পড়ে গেছে, আমাকে খেতে দিল না নিজেও খেল না। এককথা বারবার—“ললিতদার অন্যায়, বাসা ছেড়ে বাইরে যাওয়া। আমরা গণ্যমান্য অতিথি।” ইতিমধ্যে ললিত বাসায় ফিরেছেন। শুনলেন, সদরে আওয়াজ ও হাঁকাহাঁকি অন্তে অতিথিরা ফিরে গেছে।

তখনি ছুটে এসে একেবারে সরাসরি ‘সুপ্রীম কোর্ট’। মার কাছে ব্যাপারটা পেশ করলেন—“মা, তুমি এদের আচ্ছা করে বকুনি দাও তো। এদের মহা আস্পর্ধা। মহা অন্যায়। বেয়াড়া ছেলে সব।” কাঠফাটা রোদ্দুর, গ্রীষ্মকাল। ললিত কেঁদে ফেলেছিলেন। তার কারণ—ঐ সঙ্গীটি আবার, গোদের ওপর বিষফোঁড়া, গুরুবংশীয়ার স্বামী কুটুম্বানন্দ। ললিতকে ঠাণ্ডা করে মা বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে বললেন : “ওদের এখুনি আবার ফিরে পাঠাচ্ছি। এখুনি খেয়ে আসবে। তুমি বাবা নিশ্চিন্ত হয়ে যাও। আহা, বাছার খামকা খেতে বলে কী দিগদারি!”

তার পরেই সঙ্গে সঙ্গে আমার ডাক পড়ল। মা কুটুম্বানন্দকে কিছু বললেন না। এ যেন ঝিকে মেরে বউকে শেখানো! আমি ঐ একবারই মার কাছে ভীষণ বকুনি খেলাম। এখন বুঝছি। ঐ থেকে মহা কল্যাণ আমার হয়ে গেল। ঐ কটা কথার মাধ্যমে চরিত্রের কাঠামোয় দুষ্টস্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার দেওয়ার শক্তি শক্তিময়ী তৎ‌ক্ষণাৎ দিয়ে দিলেন। এত দয়া তখন কি বুঝি? ঠাকুরঘর বা তাঁর নিজের ঘরের রাস্তার দিকে বারান্দায় আমাকে আলাদা ডেকে নিেয় গিয়ে তীব্র তিরস্কার—“এই কি তোমার লেখাপড়া শেখা? ছিঃ, ছিঃ, তুমি সিয়ানা। কলেজে পড়। কলেজে পড়ে এই! তুমি জোর করে খানিকটা নলিত বাড়ি না আসা পর্যন্ত অপে‌ক্ষা করতে পারলেনি? কী তোমার এসময়ে তাড়াহুড়ো? (সেদিন রবিবার) ছুটির দিন। ও না হয় গণ্ডমুখ্যু, গোঁয়ার। ওকে তো কিছু বলা চলবেনি।” আমি লজ্জায় অধোবদন। মার সবদিকেই নজর। অসম্ভব তালবোধ। উদ্বোধনে তখন খুব ভিড়।

ভক্তবৎসলা মা! পূর্ণচ্ছেদ পড়ল না। তখনি আবার শরৎ মহারাজকে হুকুম হলো—“এদের দুজনাকে তুমি নিজে এখুনি নলিতের বাসায় নিয়ে গিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে নলিতকে ঠাণ্ডা শান্ত করে দাও গে।” মনে ‌ক্ষুণ্ণ ‌ক্ষুব্ধ, দেহে খিন্ন ললিতকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদে আসলে পূর্ণ, প্রচুরভাবে বিপুল খুশি করার আয়োজন! কথামতো তৎ‌ক্ষণাৎ সৃষ্টিধর, পরম আজ্ঞাবহ, নিরভিমান শরৎ মহারাজ তাই করলেন।

শরৎ মহারাজেরও মজা দেখলাম। কুটুম্বু ছোকরাকে সামনে রেখে আমাকেই ভর্ৎসনা! গীতার নজির বললেন। সঙ্গ থেকে যাকিছু কুপ্রবৃত্তি-সঞ্জাত, তার থেকে ক্রোধ-মোহের উদ্ভব। তারপর একে একে, ধাপে ধাপে নেমে যাবে। স্মৃতিবিভ্রম, বুদ্ধিনাশ। পরিণামে প্রণশ্যতি। মুখটি বুজে ললিতবাবুর কাছে ‌ক্ষমা চেয়ে নেমতন্ন ‘গিলে’ ফিরতে হলো মার বাড়ি। সঙ্গদোষে, বিনা প্রয়োজনে পাহাড়-পর্বতকে নিয়ে সামান্য ব্যাপারে বৃথা নাড়া-চাড়া। সঙ্গীটি আমাপে‌ক্ষা বয়োধিক। ললিত শেষমেষ আহ্লাদে আটখানা—“আমি কি হেলনা-ফেলনা ভক্ত? কী বলে, আমার সঙ্গে চালাকি? মা আমার হাতধরা।” ললিত মাকে ‘তুমি’ জবানিতে বরাবর বাক্যালাপ চালাতেন। গোঁফের বহরের দরুন ‘কাইজার চ্যাটার্জি’ বলেও তাঁকে ডাকা হতো।

উপরি-উক্ত ব্যাপারে একটি অনুভব বড় চিত্তপ্রসাদ আনল। সংসারে যে অভাগা মর্যাদাচ্যুত, মা তাকে স্নেহভরে উদ্বুদ্ধ করে মর্যাদামণ্ডিত করছেন। যতই অন্যের চোখে সে-ছেলে ‘অখদ্যে, অবদ্যে, অ-নাথ!’—মা চাইতেন, বহু বহু ‌ক্ষেত্রে দেখেছি, যেন আমরা সর্বদা বিচারশীল হই। যেখানে যাবে, চারধার দেখেশুনে কাজ করবে। কর্তব্য অকর্তব্য বুঝে চলবে। বোকা হওয়া চলবে না। বুদ্ধিমান, দৃঢ় হতে হবে। উদ্ভ্রান্ত সাথিকে শক্ত হয়ে সৎপথে চালিত করতে হবে। তবেই মার ছেলে। মার স্পর্শ, মার আশীর্বাদকে জীবনে ফলাতে হবে। আমাদের গুরুদায়িত্ব মাথার ওপর সদাসর্বদা ঝুলছে।

ডাক্তার কাঞ্জিলাল বেশ চমৎকার বলতেন, বড় ডাকাবুকো ব্যক্তি—“মার কাছে জোর। মার কৃপায়, বড় মহারাজের কৃপায় (ব্রহ্মানন্দজী) নতুন মানুষ হব। মার কাছে এসে এইটে বুঝেছি। পূর্বের সবকিছু দুষ্কৃতি ঝেড়ে ফেলতে হবে। আর দেখে নিও, আমি থলথলে বুড়ো হয়ে ফোকলা-মুখে গুড়ুক টানতে টানতে নাতি-নাতনিদের কাছে খালি ফাঁকা হামবড়ামি করতে থাকব না। আমি মা ঠাকরুনকে দেখেছি, রাখাল মহারাজকে দেখেছি। শক্তি থাকতে থাকতে চলে যাব।” সারাদিন ডাক্তারির কঠোর শ্রম অন্তে সারা রাত প্রায়ই দেবীপূজায় কাটাতেন। বিশ্বাস অচলা। হলোও ঠিক তাই, তিন-চার দিনের জ্বরে হঠাৎ চলে গেলেন।

ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায় ইংল্যান্ড থেকে শ্রীশ্রীমায়ের
এই তৈলচিত্রখানি আঁকিয়ে এনেছিলেন

মার নামে ললিতবাবু অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। আমার জীবন তার দৃষ্টান্তস্থল। ১৯১৬-র পুজোর ছুুটির পূর্বে হিন্দু স্কুলে হেডমাস্টার স্বনামধন্য রসময়বাবু ডেকে তাঁর ঘরে বললেন : “তোদের কত আগে সব সাবধান করেছি। বয়স যদি ভুল লেখা থাকে শুদ্ধ করে নে। দরখাস্ত করে, প্রমাণ দিয়ে—এই বেলা। এখন সামনে টেস্ট। স্কুল কমিটি যা নাম পাঠিয়েছে, তাতে তোরও কম হচ্ছে। এবার ম্যাট্রিক দিতে পারবি না।” আমি তো সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাঁ করে খানিকটা কেঁদেই ফেললাম প্রথমে! অনাথ বালক। সন্ন্যিসী গারজেন। ফ্রি পড়ি। বই ধার করি। সর্বনাশ! কে আছে?—“ও ললিতবাবু, এর কোনো উপায় হয়?”

“নিশ্চয়ই হয়।” সকালবেলা মাকে প্রণাম করার পর ললিত বললেন : “মা, এটাকে ভাল করে আশীর্বাদ কর তো। এবার পরী‌ক্ষা দিতে না পারলে লেখাপড়া সব পণ্ড!” মা সঙ্গে সঙ্গে মাথায় দাড়িতে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন : “ঠিক হবে। নলিত, তুমি চেষ্টা কর।”

আর পায় কে! মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্টার—গিরিশ মুখুয্যে। লম্বা-চওড়া দশাসই দেহ। সমুন্নত সংযত চরিত্র। ধীমান। শরৎ মহারাজের চিঠি নেওয়া হলো। তাতে পরিষ্কার লেখা ছিল—ছেলেটির আগামী মার্চে ষোলো বছর কয়েক মাস বয়স হবে। এবিষয়ের সত্যতায় আমিই সা‌ক্ষ্য। সেই চিঠির আরেকটি বাক্য এখনো মনে আছে—“We remember your saintly father who used to visit the Master.”—শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট আপনার সাধুসদৃশ পিতৃদেব ঈশান মুখুয্যে মহাশয়কে খুব মনে পড়ে। ঈশানবাবুর এত দরাজ সাগরোপম হৃদয় ছিল যে, তিনি ঋণ করে দান করতেন। স্বামীজী তাই বলতেন, বিদ্যাসাগরের চেয়ে ঈশানবাবু বড় দাতা এক হিসাবে।

মা পাঠিয়েছেন ছেলেটিকে। ব্যবস্থা করতেই হবে। হতেই হবে। উপাচার্য দেবপ্রসাদের নিকট গিরিশবাবু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নিয়ে হাজির করলেন। রোগা লিকলিকে চেহারাদৃষ্টে দেববাবু বললেন : “Mr. Mukherjee, the boy hardly looks 16.” মালুম হয় না, ষোলো বলে এ-ছেলেকে? কিন্তু শ্রীমা ও শরৎ মহারাজ সে-ছেলের উকিল! গিরিশবাবু ও ললিত উভয়ই জোরের সঙ্গে ষোলো অব্যর্থ বলায় ললিতের জয়জয়কার। যেন আহ্লাদের পাখায় উড়ে কেল্লা ফতে করে উদ্বোধনে ফিরে এলেন! সেই বছরেই পরী‌ক্ষা দেওয়া হলো। কে জানে তখন, ছয় বছর পরে বড় সাধের বড় আকর্ষণের ইউনিভার্সিটির ঘাটের জল খাইয়ে মা-ই তাঁর আদর্শের বেদিতলে এই তৃণতুচ্ছ জীবন গ্রহণ করবেন, মূল্য দেবেন! যেন মা অল‌ক্ষ্যে বলেছিলেন—বাছা, এখন তড়পাচ্ছ, দিন কতক তড়পাও। শেষে ঠাকুরের ঘাটে শি‌ক্ষে নিতে হবে। পূর্বেই বলেছি—ভাগ্যিস! দিদিমা (যোগীন-মা) মার গণমধ্যে এক প্রধানা নায়িকা। তাই তো মা, শরৎ মহারাজের এত অপরিসীম অনুকম্পা! ললিতের এত মমত্ব! এত খাটুনি!

স্বামীজীকে ভাঙিয়ে খাবার কথা বেলুড়ে এক সাহিত্যরথী একবার তোলেন।—কতদিন আর? এতে তো একচেটিয়া কিছু নেই। অর্জুনের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে চরাচরের যেকেউ শ্রীকৃষ্ণকে আজও পিতা বলে প্রার্থনা করে তৃপ্তি পাচ্ছে। এতে বাধা দেওয়ার, আপত্তির কী আছে? ভাঙিয়ে খাওয়া বস্তুত সোজা নয়। মহা আহবে নেমে পড়লেই হয়। বাইরে পড়ে থেকে ফাঁকি পড়বে কেন? এক্ষেত্রে কেউ রব তুলেছেন—বলি বাবাজী, আর কতকাল মাকে, শরৎ মহারাজকে, যোগীন-মাকে ভাঙিয়ে খাবেন? বাবাজী ঠাণ্ডা হয়ে উত্তর দিচ্ছেন—প্রথমত, তাঁরাই যতদিন খাওয়াবেন। তারপর আসল আলোককথা। তাঁরা কি দশ-বিশ লাখ টাকার তোড়ামাত্র, যার সুদেই এজীবন আরামে নির্বাহ? তাঁরা যে গীতোক্ত, শাশ্বত ধর্ম-গোপ্তা। নিজেরাই একরকম সনাতন। তাঁদের অমরণ, নিত্য, সত্যময় সত্তা। তাঁরা যে আদর্শগত হীরে-জহরতের গুচ্ছ। পুরুষানুক্রমে, ব্রতধারীপ‌ক্ষে, চেলা-অনুক্রমে তাঁদের ভাঙিয়ে খাবারই কথা। দোহাই তো তাঁরাই। নজির তো তাঁরাই। তবে খুবই সত্য—নিজ নিজ জীবন স্বচ্ছ করা চাই। শুধু দোহাই, ফাঁকা, বড় বড় নামের মাহাত্ম্যমাত্রে মধ্যবিংশতি শতাব্দীর ভবিরা কোনোমতেই ভুলবে না! যারা তাঁদের কথামতো কাজ করবে, তাদের জন্য তাঁরা নিজেরাই সর্বকালস্থায়ী পাকা আয়োজন করে দিয়ে গেছেন। এ যেন গোড়ায় নিরী‌ক্ষে-পরী‌ক্ষে করে নিয়ে শেষে পাকাভোজে হাত ধরে বসিয়ে দেওয়া! কিন্তু এর মধ্যে একটা ট্র্যাজেডির, আ‌ক্ষেপের আমেজ রয়ে গেছে। একথা হাসতে হাসতে রাখাল মহারাজ বলেছিলেন : “হজমের শক্তি যখন ছিল, প্রথম বৈরাগ্যের উমেরে, তখন ঠাকুর জোটাননি। আর এখন শেষটায় হজম কেড়ে নিয়ে খাবারের ব়্যালা।” কঠোর পরিহাস!

কী সীমাহীন শুদ্ধতা, সরলতা, ঋজুতা দেহধারণ করে আমাদের উদ্ধার করতে, পথ দেখাতে এসেছিল দেবী সারদারূপে, তা আজকের দিনের এই দমবাজি ধাপ্পাবাজির রাজ্যে ভাবলে স্তম্ভিত আশ্চর্য হতে হয়। একদিন সকালে প্রণাম করার পর বললেন : “রাধিকে জিজ্ঞাসা করে এস, কী খাবে। আলমারির তাকে ঐ থলিতে খুচরা পয়সা আছে। নিয়ে, কিনে আন।” তেলেভাজাকে বাঁকুড়ার লোকেরা বলে ‘ভাবরা’। তাই অর্ডার। আর কী সব মিষ্টি—চমচম, পান্তুয়া। সবসুদ্ধ সাড়ে পাঁচ আনা হলেই হয়।

মাকে বলছি : “আমি কেন নেব? মা, আপনি নিজে গুনে-গেঁথে থলে থেকে বের করে দিন।” টাকা কাউকে দেওয়ার বেলায় দেখেছি, মা স্বীয় ললাটে ল‌ক্ষ্মীকে ঠেকিয়ে তবে হস্তান্তর করতেন। মা মিষ্টি মিষ্টি হাসতে হাসতে বলছেন : “না বাবা, তুমিই নাও।” তবু আমার জোর—“আপনি দিন।” তিনি এলোপাথাড়ি এক খামচা তুলে দিলেন। িঠক সাড়ে পাঁচ আনাই তা থেকে হলো। আমার কীরকম লাগল। পরে, যোগীন-মার কাছে জ্ঞাত হলাম : “মা গুনতে জানেন না তা বুঝি জানিস না?”

আমরা ব্যক্তিত্বের বড়াই করি!… বাজার-চলন, তথাকথিত সভ্য সমাজভূত মূল্যগুলোর অসারতা দেখিয়ে মা বিরাজ করছেন। মানুষের ভিতরটাই আসল—আন্তর সত্তা। ওখানে গোল থাকলে সব বিদ্যাবুদ্ধি জঞ্জালমাত্র। কদর্যতা শতচেষ্টাতেও ঢাকা থাকবে না শেষ অবধি। মার কালচার আত্মার কালচার, শুদ্ধমনের কালচার। মার তুল্য সেরা শিল্পী কে? সন্তানের ভিতর সত্যকে, সুন্দরকে, কল্যাণকে তিনিই তো প্রবুদ্ধ, উদ্বুদ্ধ করে গেলেন (ও করছেন), জাগিয়ে দিলেন। নিচু থাকের বুদ্ধিকে, গৃহমেধাকে বোধস্বরূপে, ব্রহ্মমেধায় উন্নীত, সমুন্নত করলেন। এই নিম্নপ্রকৃতিবদ্ধ মানুষই তাঁর দৌলতে বুদ্ধমুক্ত হয়। মা যে চলমানা বেদান্ত-বিদ্যা, জ্ঞানভক্তি দিতে এসেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদাদেবী দোঁহাকার জনমে জনমে দাস, তাঁদের হনুমান, বলবান পবননন্দনবৎ ভারতনন্দন ও ভুবননন্দন বিবেকানন্দ বজ্জাত বিদ্বানদের ল‌ক্ষ্য করেই বলেছেন : “Bring more Light to the Educated!” দেব ও দেবী দুজনেই একদম নির‌ক্ষর কেউই নন, অল্পস্বল্প পড়া। গদাধরের খাঁকের কলমে হাতের লেখা পাকা চমৎকার সুন্দর। গাঁয়ের মুদিখানায় তেল, নুন, লকড়ি কেনার হিসাব ও যাত্রাপালার নকল উপভোগ্য। আজ বেশি দরকার রাষ্ট্র ও সমাজের মাথা যাঁরা, নেতা যাঁরা—সেই বাইরে ‘শি‌ক্ষিত’দের অন্ধ স্বার্থপূতিপূর্ণ মনে ত্যাগের বাতি জ্বালানো। পেশারূপে দেশসেবার সঙ্গে যদি আদর্শের সেবারূপ মশলা না সংযুক্ত থাকে, তাহলে জনতার সম্মুখে সমূহ বিপদ। এই আলো আরো আরো আরো আনা। শুধু ভাতে-কাপড়ে ভাল বাসস্থান ও পেশাশি‌ক্ষার সুযোগে জড়জীবনে ক্রান্তি এলেই তো কাজ হবে না, ক্রান্তিকে মনের মণিকোঠায়, বুদ্ধির শুদ্ধিতে এবং আত্মার বিকাশে নিয়োজন প্রয়োজন। চালক ও চালিত উভয়েরই।

গোলাপ-মা

মূর্খ যে-স্থলে স্পষ্ট বলে-কয়ে দুষ্টুমি করে, নকল পণ্ডিতে সে-স্থলে মুখে কিছু বলে না। কথা স্পষ্ট নয়—ভিতরবুঁদে, অথচ ‌ক্ষেত্রকর্মে দুষ্টুমি চালিয়ে যায়। বর্ণচোরা আম বেশি বিপদস্থল। এমনতর কুপণ্ডিতদের রামকৃষ্ণ ছাগল-গোরু জ্ঞান করতেন। মুখেই কপচানো, নজর গো-ভাগাড়ে। আদর্শের বচনবাগীশ, জীবনে বঞ্চনবাগীশ।

আরেকটি ঘটনার উল্লেখ হলেই মা-শিরোনামা প্রসঙ্গের সমাপন। অত তো মার যোগীন-মাকে ভালবাসা, সমাদর, আদর-খাতির। যোগীন-মার ব্যক্তিত্ব এক অসাধারণ গোছের। সহজেই ভিতরে ডুবে যেতে পারতেন। খুব রাশভারী, অথচ খাটো মানুষটি। নিবেদিতা বর্ণনা করেছেন একটি প্রবন্ধে। তাঁর ভাবটা এই—আমার বাগবাজার বালিকা বিদ্যালয়ে মেয়েদের সভার মাঝে পূজনীয়া যোগীন-মা যেই এসে বসলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‌ক্ষত্রিয়োচিত তেজোবীর্যব্যঞ্জক অথচ পরম সাম্য মুখশ্রী একটা সূ‌ক্ষ্ম আবির্ভাবে সমস্ত পরিবেশকে ছেয়ে ফেলল। সভার চেহারা বদলে গেল। হ্যাঁ, একজন মানুষের মতোন মানুষ এলেন বটে। নিবেদিতার চোখ ও মনও খুব সূ‌ক্ষ্ম, বলা বাহুল্য।

বিকালবেলা মার কাছে নিত্য যেমন পিতৃগৃহ থেকে আসতেন, একদিন এসেছেন (১৯১৬ হবে)। ঠাকুরঘরের বারান্দায় মা। একথা সেকথা বলার পর বলছেন : “আচ্ছা, মা যোগীন! আজ সকালে কতকগুলি ছেলেমেয়েকে মন্তোর দিলাম—এই, এই। ঠিক হলো কি? তুমি বললে আমার মনটা ঠাণ্ডা হবে।” যোগীন-মা মন দিয়ে মন্ত্রগুলো শুনে বললেন : “মা! আমি একটা হতভাগী, আমাকে জিজ্ঞেস করছ? তুমি বড় বালিকার মতো সরল। তোমার মুখ দিয়ে যে-বাক্য বেরবে মা, সে যে বেদবাক্য। তাতে কি ভুলচুক হবার জো আছে? কখনোই নয়।” পরে যোগীন-মা শরৎ মহারাজকে বলছেন : “মার ঐ কথা শুনে আমি অবাক। মা আমাকে এত মনে করেছেন!” মার দেহান্তের পর বলরামের গৃহে রাখাল মহারাজ বলেছেন : “উদ্বোধনে তো সবাই হৈহৈ করছে। এক শরৎ মহারাজ আর যোগীন-মা—এঁরা ভজনে আছেন।” শিবানন্দজী আমাকে বলেছিলেন : “ঐ যেরে, তোরা যাকে দিদিমা বলিস, খুব সাধনভজন করেছে! করছে এখনো।”

কিন্তু যখনি ঐ মেয়ে যোগীন অবুঝের মতো কিছু বলেছেন, মা দৃঢ়কণ্ঠে তার প্রতিবাদ করতে ছাড়তেন না। যোগীন বাপের শুক্লপ‌ক্ষীয়, দ্বিতীয় খেপের একমাত্র কন্যাসন্তানবিধায়—তাতলে একটু বেশিই সময় সময় তেতে উঠতেন। এধারে আবার মাতালের মেয়ে!

মার সেবামণ্ডলীস্থ এক ব্রহ্মচারীর কী ব্যবহারে মনে নেই, চটে গিয়ে, নিত্যকার গঙ্গাস্নান জপাদি উপাসনান্তে উদ্বোধনে ঢুকে যোগীন-মা একদিন নিচ থেকে চিৎকার করে মাকে বললেন : “মা! তুমি অমুককে এখুনি তাড়াও। তা না হলে আমি আর এ-বাড়ি ঢুকব না। হয় ও যাবে, না হয় আমি যাব।” মা সব কলরব শুনতে পাচ্ছিলেন। ওপরে মেয়ে পৌঁছালে মা দৃঢ়স্বরে বললেন : “কেন মা যোগীন! ওকথা কি বলতে আছে, মা? অল‌ক্ষণে কথা। অবুঝ হয়োনি মা, অবুঝ হয়োনি। ঠাণ্ডা হও। ঠাকুরের পেসাদী মিছরির পানা খাও। ভুলে যাও ওর কথা। ও যা অন্যায় করেছে, আর করবেনি। আমি তার জামিন। তাড়ানোর কথা কি তোলে? ও ঘরবাড়ি ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে ঠাকুরের কাছে, আমার কাছে এসেছে। ওকে তো তাড়াতে আমি কোনোকালে পারবনি মা। তাতে তুমি না অাস আমি আর কী করব?”

একেই বলে যথার্থ ব্যক্তিত্ব-বিশিষ্টতা, অথচ গণনবিদ্যা, সংখ্যাবিজ্ঞানে অজ্ঞ! প্রকৃত শ্রীরামকৃষ্ণ-সহধর্মিণী। মার চরিত অপূর্ব সামঞ্জস্যপূর্ণ, সাম্য-সুষমাময়। যাকে যখন যেটি বলা দরকার, ঠিক সেইমতো বলা। তখনকার ঐ ব্রহ্মচারী যে সত্যিকারের খাঁটি মা—আসল মাকে পেয়েছিলেন। তাঁর মোহময়ী মা তখন পরলোকগতা। মনে পড়ছে, কত আগ্রহে দিনের পর দিন ঐ ব্রহ্মচারী মার কথাবার্তা নোট করতেন চুপি চুপি, নিচের ঘরে। ‘মার কথা’ বলতে আজ যা পাচ্ছ, তার মূলে তিনিই।

আশপাশের সর্বত্র সব সংসারের প্রতিচ্ছায়ামতো মার সংসারেও মাঝে মাঝে এইরকম একটু-আধটু বেসুরো বেজে উঠত। কিন্তু মা উপস্থিত থেকে সুরেলা আওয়াজকেই সবার ওপরে সর্বোচ্চে ধরে রাখতেন। মারও তো পাঁচজনকে নিয়েই কারবার।

গোলাপ-দিদিও ঐ তক্কে এক হাত ঝাড়লেন। তিনি কর্মে দ‌ক্ষা। জ্ঞানে কর্মে ভক্তিতে—সব দিকে নয়। “বলি ও যোগেন, গঙ্গাতীরে এক নোকখো (ল‌ক্ষ) জপ করে এলে তো কার বাবার মাথা কিনে এলে? এসেই গোটা বাড়ি কাঁপাচ্ছ?”

—“গোলাপ-দিদি, তুমি আমায় বরাবরই দেখতে পার না।

—“মধ্যে মধ্যে নারদ, নারদ না লাগলে খেলা জমে না।”

দুই বুড়িতে পর‌ক্ষণেই ভাবেরও গলাগলি। অসম্ভব টান পরস্পরের প্রতি! তবে এইরকম খুকি খুকি খেলাও কখনো কখনো হয়েছে।

ভারতের অধ্যাত্ম-কৃষ্টিগত কল্পনামূলে বলা চলে, মার শ্রীপদছায়ায় দীর্ঘকাল থেকে এইটি বুঝেছি—সীতাদেবী, শ্রীরাধা, বৈকুণ্ঠের নারায়ণী ল‌ক্ষ্মী, গৌরাঙ্গঘরনি ল‌ক্ষ্মী-বিষ্ণুপ্রিয়া, পুরাণের সতী সাবিত্রী দময়ন্তী, বেদের গার্গী মৈত্রেয়ী বিশ্ববারা, মধ্যযুগের মীরা, ইসলামের রাবেয়া—এঁদের সঙ্গে একত্র বাস করাও যা, সারদাদেবীর সকাশও তাই। মা, আমাদের শেষদিন পর্যন্ত ধরে রাখুন তাঁর আদর্শধারায়।

স্বামী শিবানন্দ

মায়ের ইতিহাস-নিবদ্ধ লীলাকায়ার দর্শন স্পর্শন, সঙ্গে সঙ্গে চলাফেরা, ওঠানামা। আবার আজ পুরো পঁয়ত্রিশ বছর স্বসংবেদ্য ইতিহাসাতীত, ইতিহাস-বাধিত, তর্কাতীত তাঁরই নিত্যকায়ার (ভক্তপিপাসুর নিকট সমসত্য। শ্রীঅরবিন্দ ইংরেজি পত্রে লিখেছেন, স্বামীজীর সঙ্গে কয়েকদিন মোলাকাত হচ্ছে একনাগাড়ে। বহুকাল স্বামীজীর শরীর চলে গেছে। বিলাতের শি‌ক্ষাদী‌ক্ষায় গোড়া বাঁধা শ্রীঅরবিন্দের। তাঁর যোগগম্যতাকে জড়বিজ্ঞানী না মানতে পারেন।), সক্রিয়তার বর্তমান পরিচয় ও ভবিষ্য কার্যকারিতার আভাস পেয়ে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ, গৌরবান্বিত। আমরা একাধারে তাঁরই এই দ্বিবিধ সত্তার দায়ভাক। এ দয়া কি ভাষায় সম্যক দ্যোতনীয়? তিনি এবং তাঁর স্বামী (মিসেস ও মিস্টার গদাধর চট্টোপাধ্যায় নামেও বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই) দেশে-বিদেশে বহুলোকের ইতিমধ্যেই নিত্য অখণ্ড অনুধ্যেয় ভাবালোকীয় সামগ্রী। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতভূখণ্ডে ধর্মানুরাগে সমানুষ্ঠিত সেবাব্রতের বাস্তব প্রেরণা হয়েছেন ও হতেই থাকবেন—অনন্ত কাল। তাঁরা কালগ এবং কালাতীত, একসঙ্গে দুই। ভক্তহৃদয়ে এখনো যেন সদ্য টাটকা তাজা সীতারাম। বাল্মীকির পুঁথি থেকে ধড়মড়িয়ে জেগে মাটিতে নেমেছেন। এমন ঝরঝরে দুই জীবন কোথা? নারীর মধ্যে সেরা নারী। নরের মধ্যে নরবর, নরমণি। প‌‌ক্ষিমাতার উপমায়—ভারতমাতার দুই ডানা। সঙ্গে সঙ্গে নিখিলেরও। এমন সার্বজনীন, সকলের উপযোগী জীবন আর কোথা?

তাঁদের মানবতাকে প্রথম জোর করে আঁকড়ে ধরতে হবে। তাঁদের মানবীয় দিকটা না ভুলি। হৃদিবান মহান মানব, মহারাজ ধর্মাশোকের সময় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পাটনা পাটলীপুত্রের রাজধানীতে এক বৌদ্ধ সংগীতি সভা বসার সংবাদ ‘কথাবথ্‌থু’ (-বস্তু) পালিগ্রন্থ বহন করে। বইটির বহুকাল তরজমা হয়েছে। তাতে আছে—একদল বুদ্ধভক্ত চটেই লাল, যখন বলা হলো—বুদ্ধশরীরে সাধারণ দেহধর্মসুলভ কোনো কোনো চেষ্টাও পরিল‌ক্ষিত হতো। অমনতর করলে যে তাঁর অবমাননা হবে।

মানুষের ভিতরে পশুত্বের আধিক্য আজ ঘটেছে। তাই যেন অগত্যা রজনীর ওপর সকল আধিপত্য সমর্পণ করে মনুষ্যত্ব রবিবৎ অস্তমিত। সারা দুনিয়া মনুষ্যত্বের ভিখারি। মনুষ্যত্বই কাম্য সর্বপ্রথম। মুক্তি মো‌ক্ষ যাকিছু এখন ঐতে। মনুষ্যত্বের পুনরুজ্জীবনই এখন একান্ত বাঞ্ছানিধি। এটাই একালের ডাক। মধ্যশতাব্দীর সন্ধি‌ক্ষণে এটাই চেতাবনী। প্রচলিত পরিস্থিতির তাগিদ। হাইড্রোজেন বোমায় পৃথিবী বুঝি ছারেখারে নির্মল হয়, রসাতলে যায়! চতুর্ভুজ, ষড়ভুজ, দশভুজ হওয়ার ‌ক্ষমতা থাকে থাক, পরিষ্কার পূর্বাভাস দেব রামকৃষ্ণে—২৪ মে ১৮৮৪—আন্তর আত্মচরিতের ক্রমবিকাশ জ্ঞাপন করছেন। “স্বভাব বদলে যাচ্ছে। সাকার। নররূপ। এইটে বলে দিচ্ছে।” এখনকার জীবনবোধ মানবকেন্দ্রিক। মধ্যযুগের মতো দেবকেন্দ্রিক নয়। মানুষকে তুলতেই তো, মানুষের মধ্যে কাজ করার জন্যই তো মহামানবের আসা। এক রামকে বহুবার ‘মানুষ দেলায় দে, রাম’—সব সমাজের দ্বারে দ্বারে বলার জন্যই, মানুষ মাগবার গরজেই বারবার নানা রূপে নানা নামে তাঁরই আসা।

সাকার, সৎমানুষে ঈশ্বর সর্বাধিক প্রত্যক্ষ। এটি আমাদের আগামী যুগের শ্লোগান, বাণী হোক। নরবপুর মাহাত্ম্যবর্ণনে বৈষ্ণবসাহিত্য মুখর। দ্বিভুজ মনুষ্যত্বের মান্যে, মর্যাদায় বিমণ্ডিত ও পরমেশ্বরের হুঁশে অন্বিত—মান+হুঁশই ঘাটে মাঠে বাটে, জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় শলা-পরামর্শের পার্লামেন্টে ও মঠে অধিক প্রয়োজনীয়। অধিক স্বাগতদ্বারা আদরণীয়, বরণীয়।

বহুমানব-অধ্যুষিত কলকাতা গঙ্গাকূলে জ্যোতির্ময়ী মা সারদা বিরাজিতা। বাগবাজারে দুর্গাচরণের ঘাটের সোপানাবলিতে নবদুর্গারূপে দশদিক আলো করে তিনিই দণ্ডায়মানা। যুগে যুগে তিনিই আসেন। সহজ কথ্যভাষায় মানুষের মনের বাতায়নে বাতায়নে মৃদুকরাঘাতে জানিয়ে দেন সেই মহান প্রাচীন ব্রহ্মবার্তা, যা যুগে যুগে মানুষ ভুলে গিয়ে অশেষ কষ্ট পাচ্ছে, প্রচণ্ড দুর্ঘট ঘটাচ্ছে।

“যোঽন্তঃসুখোঽন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ।
স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোঽধিগচ্ছতি।।”

—আত্মাতেই যাঁর সুখ, আত্মাতেই যাঁর প্রীতি, আত্মাতেই যাঁর দৃষ্টি সেই যোগী ব্রহ্মে অবস্থিত হয়ে ব্রহ্মেই শেষে লয়প্রাপ্ত হন।
সাদা কথায়, তিনিই তোমার আমার মা সারদাদেবী—সকলের। [সমাপ্ত]

‘স্বামী বিশুদ্ধানন্দ স্মারক রচনা’রূপে প্রকাশিত হলো।