শুধু দক্ষিণেশ্বরের দিনগুলিই নয়, আজীবন মায়ের জীবনযাপন দেখে মনে হয়, স্থিতপ্রজ্ঞার পরাকাষ্ঠা যেন তিনি। কিন্তু মনের এই অবস্থায় পৌঁছানো এত সহজসাধ্য কি? তাঁকে আমরা বহুরকমের অবাঞ্ছিত, দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি এবং নীরবে সব সহ্য করতেও দেখেছি।
মহাকবি কালিদাস শব্দে শব্দে আঁকছেন এক অপরূপ চিত্র : উমার তপস্যার ছবি— “শিলাশয়াং তামনিকেতবাসিনীং নিরন্তরাস্বন্তর-বাতবৃষ্টিষু।/ব্যলোকয়নুন্মিষিতৈস্তড়িন্ময়ৈর্মহাতপঃ-সাক্ষ্যে ইব স্থিতাঃ ক্ষপাঃ।।”১ প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের নিচে শিলাতলে দেবী পার্বতীর মহাতপস্যাকে তাঁর ক্ষণপ্রভাচক্ষু মেলে দেখে চলেন রাত্রিদেবী। মহাশক্তি ধ্যানে তন্ময় হয়ে আছেন শিবের সাথে সংযুক্তা হবেন বলে। শিব বা কল্যাণের সঙ্গে যখন শক্তি যুক্ত হয় তখনি তো কেবল জন্ম নেয় অন্যায়বিনাশী দেবশক্তি, যা শুধু প্রতীকী তারকাসুর নয়—ধ্বংস করে সবরকমের আসুরিক অশুভ এবং অমঙ্গল। দৃশ্যপট পরিবর্তন হয় যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এক অষ্টাদশী পা রাখলেন ভারতের রাজধানী কলকাতার উপকণ্ঠে একটি গ্রাম দক্ষিণেশ্বরে। সেখানে ভবতারিণীর মন্দিরপ্রাঙ্গণে দেবীশক্তি আবার জাগ্রতা হবেন, ফলহারিণী কালীপূজার এক অমাবস্যার রাতে যুগাবতারের প্রার্থনায় উদ্বোধিতা মহাশক্তি আবার শিবের সাথে সংযুক্ত হওয়ার মহাতপস্যায় রত হবেন। সেই দিনগুলির রূপচিত্র নিপুণ অক্ষরে লিখেছেন পুঁথিকার অক্ষয়কুমার সেন—“বাহির দুয়ারে মাতা জগৎ-জননী।/ সমাধিতে বসিয়া আছেন একাকিনী।/প্রকাশ্য বদন আবরণ নাহি তায়।/ চন্দ্র সূর্য পবনে যা দেখিতে না পায়।।/ যে ভাবে আছেন মাতা প্রত্যাকৃতি তাঁর।/ জানি না আঁকিতে শক্তি জগতে কাহার।।/ লজ্জা-পরিপূর্ণ দেহে মোটে নাহি মন।/ বিশ্বহিত-ধিয়ানে যেমন নিমগন।।”২ শঙ্করাচার্য বলেছেন, মন ও ইন্দ্রিয়গুলির একাগ্রতাই হলো পরম তপস্যা। মানুষ তপস্যা করে কিছু লাভ করার জন্য। ‘তপঃ’ শব্দটির সাথে যুক্ত থাকে ত্যাগ এবং কৃচ্ছ্রতার ধারণা। বৃহত্তরকে লাভ করার জন্য ক্ষুদ্রতরকে পরিত্যাগ এবং তার জন্য কঠোর প্রচেষ্টাই হলো তপস্যা। তাই শিবরাত্রির উপবাসকে আমরা ‘তপস্যা’ বলি, পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে একজন ভাগ্যপীড়িত অন্নহীনের উপবাসকে ‘তপস্যা’ বলি না। এক মহৎ লক্ষ্য থাকতে হয় তপস্বীর সামনে। ভৃগু বলেন : “তপো বিদ্যা চ বিপ্রস্য নিঃশ্রেয়সকরং পরম্।/ তপসা কিল্বিষং হন্তি বিদ্যয়াঽমৃতমশ্নুতে।।”৩ তপস্যা এবং বিদ্যা—এই দুটির সাহায্যে আমাদের আত্মজ্ঞান হয়। তার মধ্যে তপস্যার ফলে আমাদের পাপে আসক্তি যায় এবং জ্ঞানের দ্বারা মুক্তি হয়। প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, সারদাদেবী কেন তপস্যা করেছিলেন? যাঁর কটাক্ষে সৃজন-পালন হয়, তিনি কেন প্রতিদিন লক্ষ জপ করে যেতেন? কিসের কলুষ বিনাশ করার প্রয়োজন হয়েছিল পবিত্রতাস্বরূপিণীর?...
Read the Digital Edition of Udbodhan online!
Subscribe Now to continue reading
₹100/year
Start Digital SubscriptionAlready Subscribed? Sign in